নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র
একজন রোগী যখন খুব জটিল অবস্থায় পড়েন তখন অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসকরা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। তবে আইসিইউতে রাখা মানেই রোগীর জীবনের শেষ নয়। এখান থেকে সঠিক পর্যবেক্ষণ বা চিকিৎসা পেলে রোগী আবারও সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে। আজ বৃহস্পতিবার (১৯ মার্চ ২০১৫) এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ১৯৭৯তম পর্বে এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন নিউইয়র্কের কুইন্স হাসাপাতালের বিশিষ্ট এনেসথেসিউলজিস্ট সিনহা আবুল মনসুর।
প্রশ্ন : ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট বা আইসিইউ বিষয়টি আসলে কী এবং এর গুরুত্ব কী?
উত্তর : ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটকে বলা যেতে পারে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র। একজন রোগী যখন খুবই জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়, এমন হয় যে জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে, সেই রোগীকে আমরা খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতে চাই। তাঁর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া, মস্তিষ্কের ক্রিয়া, ফুসফুসের ক্রিয়া- এগুলো পর্যবেক্ষণ করতে চাই এবং সবোর্চ্চ সহযোগিতার মধ্যে রাখতে চাই, তখন তাকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়।
প্রশ্ন : এই নিবিড় পরিচর্যা কাদের ক্ষেত্রে আপনারা নির্ধারণ করেন বা কারা এই আইসিইউয়ের মধ্যে থাকবে সেটি নির্ভর করে কিসের ওপর?
উত্তর : মস্তিস্কের রক্তক্ষরণের রোগী বা কোনো ধরনের সমস্যা হয়েছে, দুর্ঘটনা জনিত ঘটনায়, হৃদযন্ত্রের কোনো সমস্যায়, কিডনির কোনো সমস্যায় (কিডনি একেবারেই কাজ করছে না), ফুসফুসের সমস্যা; ফুসফুসে হয়তো এত খারাপ পর্যায়ে সংক্রমণ বা ইনফেকশন হয়েছে যা নিয়মিত ইউনিটে রেখে চিকিৎসা করা সম্ভব না, সেই সব রোগীকে আমরা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রাখার চিন্তা করি।
প্রশ্ন : এখানে রোগীকে পাঠালে কী দেখেন আপনারা? আমরা একটি শব্দ প্রায় শুনি, লাইফ সাপোর্ট। লাইফ সাপোর্টে যখন রোগীকে রাখা হয় সেখানে পর্যবেক্ষণ কীভাবে করা হয়?
উত্তর : একটি রোগী যখন জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে, শ্বাস নিতে পারছে না বা নিতে পারলেও তা জীবন ধারনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ নয় তখন আমরা তাকে কৃত্রিমভাবে ভেন্টিলেশনে নিই। ভেন্টিলেটর তার শ্বাস প্রশ্বাস সচল রাখে। তবে এটি কিন্তু শেষ চিকিৎসা না। আমরা কিছু সময় নিই। ওই সময়ের মধ্যে চিকিৎসকরা বের করেন রোগীর অবস্থা এত খারাপ কেন হলো।
এরপর রোগীর হার্ট রেট, রক্তচাপ, ইকেজি লাগাতার দেখা হয়। তারপর রোগী প্রতি ঘণ্টায় কতটা ইউরিন তৈরি করতে পারছে, সেটাও পর্যবেক্ষণ করা হয়। মোদ্দাকথা দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর কাজ ঠিক মতো করছে কি না সেটি সঠিক পর্যবেক্ষণ করা হয় ইনটেনসিভ কেয়ারে।
প্রশ্ন : যারা আইসিউতে আছে তাদের সম্বন্ধে অনেক সময় একটি কথা শুনি, ক্লিনিক্যালি ডেথ বা ক্লিনিক্যালি মৃত্যু। এই ক্লিনিক্যালি ডেথ বিষয়টি কীসের সঙ্গে জড়িত?
উত্তর : প্রথমে বলি মৃত্যু বিষয়টি কী। মৃত্যুকে মেডিকেলের ভাষায় বিভিন্নভাবে সঙ্গায়িত করা হয়। মূলত এ সময় দেহের জরুরি অঙ্গগুলো কাজ করতে পারে না। মৃত্যুর ক্ষেত্রে আমরা যেটা বুঝি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে অথবা মস্তিস্কের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এ বিষয় নিয়ে একটি বিতর্ক আছে। বিতর্কটি হচ্ছে, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বা মস্তিষ্কের ক্রিয়া যখন বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তো সেটা মৃত্যু। তবে মৃত্যুর আগের অবস্থানটা কী। এর উত্তর হলো, আগের অবস্থাটি হচ্ছে ক্লিনিক্যাল ডেথ।
রোগীর সব অঙ্গই বন্ধ হয় যায় না। দেখা গেল রোগীর মস্তিস্ক মরে গেছে। হৃদযন্ত্র কোনো মতে একটু কাজ করছে। তখন আমরা রোগীর কিছু ক্লিনিক্যাল জিনিস দেখি। ক্লিনিক্যাল বিষয় বলতে রোগী কোনো ব্যথায় সারা দেয় কি না, রোগীর কর্নিয়ায় আলো ফেললে কোনো প্রতিবিম্ব হয় কি না, গলা পরীক্ষা করে দেখা গেল কোনো গেগ হয় কি না। যদি এই বিষয় গুলো একদমই না থাকে তখন রোগীর ওই্ জটিল অবস্থায় আমরা আরো কিছু টেস্ট করি । পরীক্ষা করে যদি নিশ্চিত হই আসলেই অঙ্গগুলো কাজ করছে না তখন তাকে ক্লিনিক্যাল ডেথ বলি।
এখন ক্লিনিক্যাল ডেথ আর স্বাভাবিক মৃত্যুর রোগী কিন্তু এক রকম নয়। একটি ক্লিনিক্যাল ডেথের রোগী তার অঙ্গপ্রতঙ্গ দান ( ডোনেট) করতে পারবে। সে যদি তার অঙ্গ আগে থেকে দান করে যায় তখন ক্লিনিক্যাল ডেথ অবস্থায় তার সেটা নেওয়া যাবে।
আজকাল যুক্তরাষ্ট্রে এই বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। কারণ ওখানে প্রচুর অঙ্গপ্রতঙ্গ প্রতিস্থাপন হচ্ছে এবং ওখানে মানুষ অঙ্গপ্রতঙ্গ দান করে। ক্লিনিক্যাল মৃত্যু বিষয়টি অঙ্গপ্রতঙ্গ প্রতিস্থাপনের সঙ্গে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আমি মনে করি, আমাদের দেশেও একটি পর্যায়ে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আসবে। কারণ আমাদের দেশে অঙ্গ প্রতিস্থাপন হচ্ছে।
প্রশ্ন : আইসিইউতে যাওয়া মানেই কি খুব ভয়ের কিছু?
উত্তর : যখন একটি রোগীকে ভেন্টিলেটরে দেওয়া হয় তখন কিন্তু মনে করার কোনো কারণ নেই এটা জীবনের শেষ। বরং মনে করতে পারে রোগীর এখনো সময় শেষ হয়নি। এখনো আশা আছে। এর মধ্যে কেন রোগীর এই অবস্থা হলো সেটি যদি সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় এবং তার চিকিৎসা করা যায় তাহলে ভেন্টিলেটর থেকে তাকে আস্তে আস্তে বের করে নিয়মিত শ্বাসপ্রশ্বাসে নিয়ে আসা যায়। ওই সময়ে সঠিক চিকিৎসায় রোগী বেঁচে উঠবে। এটা খুব আশার কথা হতাশার কথা নয়।