স্ট্রোক রোধে যা করবেন
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা যায়, প্রতিবছর সারাবিশ্বে সাত লাখ লোক স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। এদের মধ্যে এক লাখ ৬০ হাজার লোক মারা যায়। মার্কিন নাগরিকদের মৃত্যুর তৃতীয় কারণ স্ট্রোক। আমাদের দেশেও এ সংখ্যা কম নয়। স্ট্রোকে আক্রান্তদের দুই-তৃতীয়াংশই মারা যায় বা চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায়। মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে গেলে ও অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিলে মস্তিষ্কের কোষগুলো মারা যেতে শুরু করে। আর একে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় স্ট্রোক বলে।
স্ট্রোক দুই প্রকার। ইসকেমিক স্ট্রোকে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে যায়। সাধারণত রক্তনালির ভেতর জমাট বাধা রক্তপিণ্ড এ সমস্যা করে থাকে। মোট স্ট্রোকের শতকরা ৮০ ভাগই এ ধরনের স্ট্রোক। মস্তিষ্কের রক্তনালি ছিঁড়ে গেলে রক্তক্ষরণ হয়। এটি হেমোরেজিক স্ট্রোক।
স্ট্রোকের লক্ষণ
হঠাৎ করে শরীরের হাত-পা অবশ হয়ে যাওয়ায় কারণে তা নাড়াতে না পারা, মুখ বেঁকে যাওয়া, হাসলে মুখ অন্য পাশে চলে যায়, কথা জড়িয়ে যাওয়া। এ ছাড়া শরীরের একপাশ অবশ হওয়া, হঠাৎ চোখে না দেখা, গিলতে সমস্যা হওয়া, হাঁটতে না পারা। এ ছাড়া হতে পারে বমি বমি ভাব বা বমি, ঘুমঘুম ভাব, চোখে একটি জিনিস দুটি দেখা।
অনেক সময় দেখা যায় কারো কারো হঠাৎ করে কথা বন্ধ হয়ে যায়, চোখে দেখতে পারে না, শরীরের কোনো অংশ অবশ হয়ে যায়। আবার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা আপনা-আপনি ভালো হয়ে যায়। একে বলে ট্রানজিয়ান্ট ইসকেমিক অ্যাটাক সংক্ষেপে টিআইএ। এটাও কিন্তু এক ধরনের স্ট্রোক তবে মিনি স্ট্রোক। বড় ধরনের স্ট্রোকের পূর্ব লক্ষণ এটি। এ ধরনের সমস্যা দেখা দিলে অবজ্ঞা না করে স্ট্রোক প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঝুঁকিপূর্ণ যারা
বয়স্ক ও পুরুষ ব্যক্তি, বংশে স্ট্রোক আক্রান্ত কেউ থাকলে, আগে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক হলে তাদের আবার স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা বেশি। যাদের উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের অসুখ রয়েছে, যেমন- হার্ট ফেইলিউর, এনডোকার্ডাইটিস, অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন, ডায়াবেটিস, রক্তে কোলস্টেরল বেশি , ধূমপান, মদ্যপান, রক্তরোগ-পলিসাইথেমিয়া ও জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল সেবন করলে স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়ে।
প্রতিরোধে
স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তির বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। এ ছাড়া একবার স্ট্রোক বা টিআইএ হলে এক সপ্তাহের মধ্যে আবার স্ট্রোকে আক্রান্তের হার ৫-১০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। এক বছরের মধ্যে আরো ১৫ ভাগ ও পরের বছর থেকে যেকোনো সময় ৫ ভাগ আবার স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে দুচিন্তার কিছু নেই। একটু সচেতন হলে স্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আমেরিকান স্ট্রোক সোসাইটি স্ট্রোক প্রতিরোধে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে।
১. নিজের ঝুঁকি জানুন ও নিয়ন্ত্রণ করুন
উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও উচ্চ কোলেস্টেরল স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়। এ ঝুঁকিগুলো জানুন এবং নিয়ন্ত্রণ করুন। রক্তচাপ স্বাভাবিকের মধ্যে রাখুন। এজন্য অতিরিক্ত লবণ খাওয়া এড়িয়ে চলুন, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করুন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে নিয়মিত ওষুধ সেবন করুন। ডায়াবেটিস ও রক্তে কোলেস্টেরল বেশি হলে রক্তনালিতে চর্বি জমে যায়। ফলে রক্তনালি সরু হয়ে রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। হার্ট অ্যাটাক, অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দন, হার্ট বড় হয়ে গেলে, ভাল্বের সমস্যা ইত্যাদি কারণে রক্তজমাট বেঁধে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। এ রোগগুলোর চিকিৎসা করান।
২. কাজকর্ম ও ব্যায়াম করুন
নিজেকে অলস হতে দেবেন না। ব্যায়াম করুন। গবেষণায় দেখা গেছে যারা প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে পাঁচ দিন ব্যায়াম করে তাদের রক্তচাপ, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রেখে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। হাঁটা ভালো ব্যায়াম। হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলুন। প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় মেনে হাঁটুন। সপ্তাহে কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ মাইল হাঁটুন। এ ছাড়া সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো, নাচা, টেনিস, গলফ খেলতে পারেন। ব্যায়ামের সময় বুকে ব্যথা, মাথা ঝিম ঝিম ও শ্বাসকষ্ট হলে ব্যায়াম বন্ধ করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৩. ওজন কমান ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খান
প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল খান। প্রতিদিনের খাবারে পাঁচ ভাগের একভাগ ফলমূল ও শাকসবজি খান। স্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার যেমন গরু বা খাসি বা পাতিহাঁসের মাংস, শুকরের মাংস, চিজ, বিভিন্ন ধরনের কেক, আইসক্রিম, ইয়োগাট, কনডেন্সড মিল্ক ও কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাবার ডিমের কুসুম, চুপড়ি আলু, বিভিন্ন প্রাণীর মস্তিষ্ক ও যকৃত, চর্বিযুক্ত খাবার ও বাটার, ঘি, চিজ, ক্রিম, কেক, বিস্কুট পরিহার করুন। লবণ রক্তচাপ বাড়ায়। সব মিলিয়ে এক চামচের বেশি লবণ খাবেন না। আঁশযুক্ত খাবার বেশি বেশি করে খান। কমিয়ে ফেলুন শরীরের অতিরিক্ত ওজন। খাবার খান শারীরিক পরিশ্রমের সাথে মিল রেখে। সবুজ শাকসবজি, সয়াবিন ও অন্যান্য ভোজ্য তেল, মাছের তেল, যকৃত ও বাদাম খান।
৪. ধূমপান পরিহার করুন
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপান করলে স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। যেকোনো বয়সেই ধূমপান ত্যাগ করা হোক না কেন তা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। গবেষণায় আরো দেখা গেছে যেকোনো সময় ধূমপান ছাড়লে তা স্ট্রোকের ঝুঁকি অর্ধেক কমায়।
৫. মাদককে না বলুন
মদ্যপান করলে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। মদ্যপানে বিরত হোন।
৬. দ্রুত ব্যবস্তা নিন
স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে স্ট্রোকের জটিলতা থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
লেখক : মেডিকেল অফিসার, সিভিল সার্জন অফিস, গোপালগঞ্জ