মেরুদণ্ডের বিভিন্ন সমস্যা ও চিকিৎসা
বিশ্ব স্পাইন দিবস বুধবার (১৬ অক্টোবর) পালিত হয়েছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো ‘মুভ ইয়োর স্পাইন’ (আপনার মেরুদণ্ড সচল রাখুন)। এর লক্ষ্য মানুষকে মেরুদণ্ড-সম্পর্কিত সমস্যার প্রতিরোধে সচেতন করা এবং সক্রিয় জীবনযাপনের গুরুত্ব বোঝানো। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা বা সঠিক শারীরিক অভ্যাসের অভাবে ঘাড় ও পিঠের ব্যথা বাড়তে পারে, যা জীবনের গুণগত মানকে প্রভাবিত করে। তাই নিয়মিত ব্যায়াম, সঠিক ভঙ্গিতে বসা এবং ভারসাম্যপূর্ণ শারীরিক কার্যকলাপের মাধ্যমে মেরুদণ্ডের সুস্থতা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়। সাধারণত স্পাইনের যে সমস্যাগুলো নিয়ে রোগী ডাক্তারের কাছে যান, তা হলো ডিস্ক হার্নিয়েশন বা প্রলেপস, স্পাইনাল ক্যানেল স্টোনোসিস, ডিজেনারেটিভ ডিজিজ, স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি, স্কোলিওসিস ও টিবি স্পাইন ইত্যাদি।
ডিস্ক প্রলেপস
মানুষের মেরুদণ্ডের দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী স্থানে জেলির মতো বস্তু থাকে। একে বলে ‘ইন্টার ভার্টিব্যাল ডিস্ক’। কোনো কারণে সেখান থেকে তা সরে গেলে তাকে বলে ডিস্ক হার্নিয়েশন বা ডিস্ক প্রলেপস। এ ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার পাশাপাশি এমআরআই করা প্রয়োজন হয়। এ ধরনের সমস্যায় যেসব চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে তা হলো কিছু ওষুধ, ফিজিওথেরাপি, ব্যায়াম ও বিশ্রামে থাকা- এ চারটি জিনিসের সমন্বয় করতে পারলে রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
স্পাইনাল ক্যানেল সোটনোসিস
মেরুদণ্ডের গঠন অনুযায়ী প্রতিটি কশেরুকার দু‘পাশ দিয়ে স্পাইনাল নার্ভ বের হয়ে শরীরের দু‘পাশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে গেছে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন অনুভূতি হয়। একটি ক্যানেলের মাধ্যমে নার্ভটি বেরিয়ে আসে। কোনো কারণে এ ক্যানেলের মধ্যে কম্পন বা চাপ অনুভূত হলে আক্রান্ত স্থান থেকে নার্ভের ডিস্ট্রিবিউশন অনুযায়ী ব্যথা হয়। আক্রান্ত হাত বা পা ভারী মনে হয়। এ ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি রিজয়েন্ট ইমেজিং টেস্ট করলে রোগ ধরা পড়ে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও খুব বেশি ভাগে ভাগ করা হয়। রোগটি প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়ে থাকলে কনজারভেটিভ চিকিৎসার মাধ্যমে ঠিক করা যায়। কিন্তু খুব সিভিয়ার হলে স্পাইনালে সার্জারির প্রয়োজন পড়ে।
ডিজেনারেটিভ ডিজিজ–স্পনডাইলোসিস
বয়স ৪০ উপরে গেলে যেমন চুল পাকে, তেমনি মেরুদণ্ডের হাড়ের ক্ষয় শুরু করে। অনেক ক্ষেত্রে কশেরুকাগুলো পার্শ্ববর্তী অংশের হাড় বেড়ে যায়। একে বলে ‘অস্টিওফাইট’। দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী স্থানের স্পেস কমে তাতে। এ অবস্থার নাম স্পনডাইলোসিস। সমস্যাটি ঘাড়ের অংশে হলে সারভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস, লাম্বার স্পাইনে হলে বলা হয় লাম্বার স্পনডাইলোসিস। রোগ নির্ণয়ে এক্স-রের প্রয়োজন হয়। চিকিৎসার ক্ষেত্রে ওষুধের পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি প্রয়োজন। তবে যেহেতু এটি বয়সজনিত রোগ, তাই পুরোপুরি নির্মূল করা যায় না। তবে উপসর্গ কমিয়ে আনা যায়। সুস্থ থাকতে রোগীকে কিছু নিয়ম মানতে হয়। যেমন সামনের দিকে ঝুঁকে ভারী কাজ না করা। ভ্রমণ এমনভাবে করতে হয়, যাতে খুব বেশি ঝাঁকুনি না লাগে। নিচু হয়ে কিছু তোলার সময় হাঁটু ভেঙে বসে ওঠানো উচিত।
স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি
বাংলাদেশে স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি খুব কমন। রোড অ্যাকসিডেন্টে প্রায়ই ঘটে। এ ছাড়া বিভিন্ন কনস্ট্রাকশন সাইটে ইনজুরি, ওপর থেকে নিচে পড়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়মিতই ঘটে। এসবের মধ্যে ভার্টিক্যাল স্পাইন বা ঘাড়ের অংশে ইনজুরি হলে রোগীর চার হাত-পা প্যারালাইজড হয়ে যায়। পিঠের অংশে হলে বা লাম্বার স্পাইন বা কোমরের অংশে হলে দুই পা প্যারালাইজড বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে রোগীর সার্জারির প্রয়োজন হয়। পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন চিকিৎসার প্রয়োজন।
স্কোলিওসিস
রোগটি তরুণ-তরুণীদের বেশি হয়। আমাদের মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক যে গঠন, তা একপাশে বাঁকা হয়ে ‘এস’ আকৃতির হয়ে যায়। এ অবস্থার নাম স্কোলিওসিস। রোগের প্রাথমিক ও মধ্যম অবস্থায় ওষুধের পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ঠিক করা সম্ভব হয়। সিভিয়ার হলে সার্জিক্যাল ইন্টারসেকশনের মাধ্যমে ঠিক করা হয়। তবে সার্জারির আগে-পরে স্পাইনাল মাংশপেশি ও লিগামেন্টের ব্যাপ্তি বজায় রাখতে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
স্পাইন টিবি
এটি প্যাথলজিক্যাল ডিজিজ। সাধারণত স্পাইনে থোরাসিক বা পিঠের অংশে দেখা দেয়। এ রোগে অ্যান্টি-টিবি ড্রাগের পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে সার্জিক্যাল চিকিৎসায় প্রয়োজন হয়। এছাড়া কিছু ব্যায়ামের মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
প্রতিরোধ ও সুস্থতা টিপস
– নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করা।
– সঠিক ভঙ্গিতে বসা ও শোয়া।
– ভারী বস্তু তোলার সময় সাবধানতা অবলম্বন করা।
– দীর্ঘ সময় বসে থাকলে বিরতি নেওয়া।
মেরুদণ্ডের সমস্যা নিরসনে সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া এবং সক্রিয় জীবনধারা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।
লেখক : ডা. এম ইয়াছিন আলী, চেয়ারম্যান ও চিফ কনসালট্যান্ট ঢাকা সিটি ফিজিওথেরাপি হাসপাতাল।