দুনিয়ার সেরা ১০ ছাদ
মানব সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বাড়িঘর। আর বাড়ি কি ছাদ ছাড়া হয়? ইংরেজিতে ছাদকে বলে সিলিং। বাড়ি বলি বা প্রাসাদ কিংবা মহল, এসবের সৌন্দর্য কিন্তু অনেকাংশে নির্ভর করে এই সিলিংয়ের ওপর। বিশ্বে কত স্থাপনায় যে কতশত অপরূপ সিলিং আছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। তবে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে দুনিয়ার সেরা ১০ সিলিংয়ের কথা। এসব ছাদ দেখলে আপনি মুগ্ধ না হয়ে থাকতেই পারবেন না।
১. কাসতেল্লো ডি সামমেতজান, লেচ্ছো, ইতালি
ফ্লোরেন্সের কাছাকাছি অবস্থিত ইতালির পালাজ্জোর ময়ূরকক্ষের অদ্ভুত সিলিং ও সাজসজ্জা আপনাকে মুগ্ধ করবেই। মনে হবে একরাশ ময়ূরের কাছ থেকে রং ধার করে এনে সিলিং সাজানো হয়েছে। সিলিংটি নকশা তৈরি করেছেন ফারদিনানদো পানচিয়াটিচি জেমেন্স ডি আরাগোনা। তাঁর জীবনের সেরা কাজ মনে করা হয় এই ময়ূরকক্ষকে। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে এর রং করার কাজ শুরু হয়, শেষ হয় ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে।
২. এলি ক্যাথিড্রাল, কেমব্রিজশায়ার
মধ্যযুগীয় নকশায় তৈরি সূক্ষ্ম কাঠের কারুকাজ। অষ্টকোণী সিলিংয়ের সঙ্গে ঝলমলে আলোকবাতি এলি ক্যাথিড্রাল চার্চকে দিয়েছে অন্য এক মাত্রা। ১৩৩৪ সালে রয়েল কারপেন্টার উইলিয়াম হার্লে এর নির্মাণকাজ শেষ করেন। চার্চের মেঝে থেকে ওপরে তাকালে সিলিংটিকে একটি অষ্টকোণী তারকা মনে হয়। আটটি ওক গাছ দিয়ে এ সিলিং নির্মাণ করা হয়। ৩০ ফুট উঁচু আলোকবাতিটিরও ভার বহন করছে ধনুকাকৃতির আটটি ওক গাছের বিম, যা প্রয়োজনে খোলা বা বন্ধ করা যায়। এ ছাড়া কাঠের মধ্যে খোদাই করা হয়েছে স্বর্গদূতের বিভিন্ন ছবি।
৩. সোলনা সেন্ট্রাম, মেট্রো স্টেশন, স্টোকহোম
মনে হবে যেন আপনি কোনো পৌরাণিক মায়াবী গুহা থেকে বের হচ্ছেন। আন্দ্রেস আর্বেগ ও অল্ভ বোজরকের তৈরি করা লোহিত বর্ণের ব্লু লাইন মেট্রো স্টেশন আপনাকে সে রকম অনুভূতিই দেবে। ১৯৭৫ সাল থেকে এই স্টেশন চালু হয়েছে। এটি মূলত মাটি দিয়ে তৈরি। ৭০ মাইল দীর্ঘ এই স্টেশন বিশ্বের সবচেয়ে বড় আর্ট গ্যালারি হিসেবে পরিচিত।
৪. গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশন, নিউইয়র্ক
সিগারেট আপনার দেহের ক্ষতি করে, কিন্তু ভাবতে পারেন শুধু সিগারেটের ধোঁয়ায় সৃষ্ট নিকোটিনের আলকাতরা দিয়ে একটি সিলিং ঢেকে যেতে পারে? এমনটাই হয়েছে নিউইয়র্কের গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনের বেলায়। মধ্যযুগীয় নকশায় তৈরি এর সিলিংটি আবৃত ছিল আলকাতরার নিচে। ১৯৯৮ সালে যা পুনরায় উদ্ধার করা হয়। সিলিংটির নকশা করেছেন ওয়ারেন-ওয়েটমোর, রিড ও স্ট্রেন। এর নকশার ভিত্তি ছিল মধ্যযুগীয় জ্যোতির্বিদ্যা। ফরাসি শিল্পী পল সিজার ও নিউইয়র্কের চার্লস ব্যাসিং সম্মিলিতভাবে এর অলংকরণ করেন।
৫. শাহ মসজিদ, ইস্পাহান, ইরান
১৯৫৮ সালে শাহ আব্বাস ইস্পাহানকে পারস্যের রাজধানী ঘোষণা করেন। তখন তিনি এখানে মনোমুগ্ধকর ও উচ্চাভিলাষী একটি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনাটি উচ্চাভিলাষী ছিল এই কারণেই যে, তখন ইস্পাহানের ভবন নির্মাণসামগ্রী বলতে ছিল শুধু কাদামাটি। শাহ আব্বাস মনে করলেন, মাটি দিয়ে নির্মিত মসজিদটি হয়তো সুন্দর দেখাবে না। তাই তিনি কাদামাটি থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি রঙিন মোজাইক টাইলস দিয়ে মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। এই পরিকল্পনাই স্থপতি রেজা আব্বাসিকে সুযোগ করে দেয় নীল, হলুদ, সবুজ, গোলাপি ও ফিরোজা রঙের টাইলস দিয়ে অপূর্ব সিলিংসহ মসজিদটি নির্মাণের। সূর্যের আলো মসজিদের সিলিংয়ের ওপর যখন প্রতিফলিত হয়ে একে আরো মোহনীয় লাগে।
৬. হ্যাসলে নাইন ব্রিজেস গলফ ক্লাব হাউস, ইয়েওজু-গান, সাউথ কোরিয়া
জাপানি প্রকৌশলী শিগেরু বান নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত এক নাম। তাঁর নকশায় ২০১০ সালে কাগজ, বাঁশ, কাঠ, ও পিচবোর্ড দিয়ে নির্মাণ হয় এই গলফ ক্লাব হাউসটি। একই উপাদানে তৈরি এর সিলিংটিও। গরমকালে এর ঠান্ডা ও শীতলতা এক অপরূপ কাব্যিক পরিবেশের সৃষ্টি করে।
৭. হেয়দার অ্যালিয়েভ সেন্টার, বাকু, আজারবাইজান
ভাবুন তো, অডিটরিয়ামের বসার পর মনে হলো আপনি ভাসছেন। কিন্তু বাইরে গিয়ে দেখলেন কোথায় কী, কিছুই তো হচ্ছে না। জাহা হাদিদের ব্রাকুরা কালচারাল সেন্টারের অডিটরিয়ামটি আপনাকে এমন অনুভূতিই দেবে। কম্পিউটারের সাহায্যে করা সূক্ষ্ম জ্যামিতিক হিসাবের সাহায্যে এমন তরঙ্গসদৃশ সিলিং নির্মাণ করা হয়েছে। স্টিলের ফ্রেমের ওপর সাদা ওক গাছের কাঠ দিয়ে জটিল ও নিখুঁত কারুকার্যমণ্ডিত এই সিলিং জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয় ২০১২ সালে।
৮. স্যান পেন্টালান, ডরসোডুরো, ভেনিস
বারক পেরিসের সিলিংটি দেখলে মনে হবে মাথার ওপর ক্যানভাসে আঁকা বিশাল কোনো তৈলচিত্র। সেখানে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন দেবদেবীর নানা ভঙ্গিমার চিত্র। গ্রায়ান অ্যান্থোনিও ফুমিয়ানির (১৬৪৫-১৭১০) জীবনের সেরা সৃষ্টিকর্ম বলে মনে করা হয় এই স্থাপত্যটিকে।
৯. হল অব প্রেয়ার ফর গুড হারবেস্ট, টেম্পল অব হেভেন, বেইজিং
নামের বাংলা করলেই এই টেম্পলে কিসের জন্য আরাধনা করা হতো তা পরিষ্কার হয়ে যায়। মিং রাজবংশের সম্রাট ঝু ভি ১৪২০ খ্রিস্টাব্দে টেম্পল অব হ্যাভেন নির্মাণ করেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য কাঠ দিয়ে নির্মিত এই মন্দির নির্মাণে কোনো পেরেক ব্যবহার করা হয়নি। সিলিংটির অদ্ভুত বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি জ্যামিতিকভাবে ঘণ্টা, দিন ও মাসের হিসাব রাখতে পারে। এর কারুকার্যে ব্যবহৃত বিভিন্ন রং আনন্দ, সমৃদ্ধি ও সাম্রাজ্যিক শাসনে গৌরব বহন করে। ১৮৮৯ সালে আগুনে পুড়ে যাওয়ার ফলে এটি নতুনভাবে সংস্কার করা হয়। ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকের পূর্বে একে আবারও রং করা হয়।
১০. সেন্ট স্টিফেন ওয়ালব্রুক, সিটি অব লন্ডন
দূর থেকে দেখলে মনে হয়, গির্জাটি বিনীত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ভেতরের কারুকার্য দেখে আপনি মানতে বাধ্য হবেন, এটি সপ্তদশ শতকে তৈরি স্থাপত্যকলার এক বিস্ময়। এর নকশা করেছেন ক্রিস্টোফার ওয়ারেন। আটটি করিনথিয়ান কলাম ও আটটি খিলান রয়েছে এ গির্জাটিতে। এ ছাড়া সিলিং হিসেবে নির্মিত গম্বুজের ভেতর দিয়ে হাওয়া চলাচলের জন্য রয়েছে জানালা। ৬৩ ফুট গম্বুজটি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে কাঠ, প্লাস্টার ও ধাতু।