কিশোর উপন্যাস
ঘুণে খাওয়া বাঁশি
নববর্ষের দুদিন বাদে ছোট মামা ভাগ্নেকে নিয়ে রাজাপুকুর এসেছেন। নিজ গাঁয়ে পা রাখতেই বালক যেন একটা ধাক্কা খেল। গাঁয়ের চারপাশটা কেমন জানি অপরিচিত অপরিচিত ঠেকছে। মাস দু’য়েকের মধ্যেই গাঁয়ের চেহারাটা এতখানিই বদলে গেছে যে এখন চিনতেই কষ্ট হচ্ছে। হিজলতলায় যাওয়ার আগে গাঁয়ের গাছ-গাছালিগুলোকে নেড়া দেখে গেছে। রাস্তাঘাটে এত ধুলাবালি ছিল না তখন। হালকা বাতাসের ঝাপটায় এখন গাঁয়ের মেঠোপথ থেকে ধুলা উড়ছে। পুকুর-কুয়া-ডোবার জল শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। ন্যাড়ামাথার গাছগুলোতে সবুজ পত্র-পল্লবে চেয়ে গেছে। অসংখ্য কচি আম, ঝুলে মাটি ছুঁই ছুঁই করছে। জারুল-সোনালু-কৃষ্ণচূড়ার মাথায় থোঁকায় থোঁকায় ফুল ফুটেছে। খেজুরগাছের মাথায় ঝুলে থাকা খেজুরের ছড়াগুলো হলুদাভ কমলা রূপ ধারণ করেছে। তালপাতার ডগায় বাবুই পাখিগুলো অসংখ্য বাসা বেঁধেছে, বাসাগুলো নিম্নমুখী হয়ে লাউয়ের মতো ঝুলছে। তালের ক্রিম-সাদা-সবুজ মিশ্রিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফুলগুলো থেকে ম ম করে মিষ্টি সৌরভ ভেসে আসছে। সৌরভ ভেসে আসছে নিমফুল থেকেও। রাস্তার দুই ধারে অসংখ্য ছোট ছোট ভাটগাছ দাঁড়িয়ে আছে মাথাভর্তি দুধসাদা-গোলাপি ফুল ধারণ করে, যার সৌরভও ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশে। নাম না জানা লতাগুল্মের বাহারি ফুল থেকেও সৌরভ ভেসে আসছে। বুনোফুলের রসপানে ব্যস্ত মৌমাছিরা এদিক সেদিক ওড়াউড়ি করছে। নির্জনতা ভেঙে খানিকটা পর পর ভেসে আসছে কামারের হাতুড়ি পেটানোর মতো বসন্ত বউরি’র ‘টুক..টুক..’ আওয়াজ। সঙ্গে যোগ হয়েছে বাতাসে ভেসে আসা ঝিঁঝিঁ পোকার অনবরত ঝিঁ..ঝিঁ..ঝিঁ.. স্লোগান। মনে হচ্ছে কোনো এক স্বপ্নপুরীতে এসে পৌঁছেছে বালক। রাজাপুকুরের অমন রূপ আগে দেখেনি সে। অথচ এই রাজাপুকুরে ওর জন্ম! ভাবতেই যেন স্বর্গসুখ উপলব্ধি করল বালক।
মাস দুয়েক পর নিজ বাড়িতে এসেছে বালক। মাকে দেখে কেন জানি খুশি হতে পারেনি আজ। মা ছেলেকে জাপটে ধরলেও বালক আরেকদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। ছোট ভাই কাছে এলেও আদর করার চেষ্টা করেনি ওকে। কী জানি কোন অভিমানে বালক মুখ ফিরিয়ে রেখেছে মা তা উপলদ্ধি করতে পারিনি এখনো।
ছেলের ঘর্মাক্ত মুখটা কাপড়ের আঁচল দিয়ে বারকয়েক মুছে দিয়েছেন মা। দুপুরের তপ্তরোদ মাথায় নিয়ে অনেকখানি পথ হেঁটে আসায় বালকের রাঙা মুখটা আরো রঙিন হয়ে গোলাপরূপ ধারণ করেছে। কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। মা বারবার মুছে দিচ্ছেন। শরীরে ধুলা-বালি লেগে থাকায় মা কলপাড়ে নিয়ে ভালো করে ধুয়ে দিলেন। ঘরে এনে ছেলেকে চিনি মিশ্রিত লেবুজল গুলিয়ে শরবত বানিয়ে খেতে দিলেন। তৃষ্ণার্ত ছোট ভাই ঢকঢক করে শরবত গিললেও ছেলে তা ছুঁয়ে দেখেনি। মা বারবার চেষ্টা করেও শরবতের গ্লাসটা ফুটনের হাতে দিতে পারেননি। পরিশেষে ব্যর্থ হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,‘কিরে শরবত খাবি না’?
‘না’।
‘কী খাবি? পিডা খাবি? নাকি কুমড়া ফুলের বরা ভাইজ্যা দিমু’?
‘কিচ্ছু খামু না’।
‘আইচ্ছা আগে ভাত খাইয়া নে, হের বাদে শুকনা পিডা ভাইজ্যা দিমু’।
‘না খামু না’।
‘তোর না শুকনা পিডা খাওনের শখ’।
‘কইলাম না কিচ্ছু খামু না’।
‘ওম্মা পোলা দেহি কেবল রাগ দেহায়। কিছু না খাইলে বাড়ি আইলি ক্যান? আমারে দেখতে আইলি বুঝি বাপ?’
‘না, তোমারে দেখতে আহি না।’ এহনি আবার চইলা যামু’।
ছেলের কথা শুনে মা হতবাক হয়ে গেলেন। ছোট ভাইয়ের উদ্দেশে বললেন, ‘কিরে অনু অর কি হইছে? কিচ্ছু খাইব না আবার চইলা যাইতে চায় এহনি। কারণডা কিরে? তোরা বুঝি অনেক আদর-যত্ন করস অরে’?
‘বুবু ফুটন রাগ করছে। অনেকদিন থেইকা তোমারে দেহে নাই তো হের লাইগা অর রাগ জমছে। রাগ পড়লে ঠিক হইয়া যাইব।’
মা এতক্ষণে বিষয়টা বুঝতে পেরে চোখের জল ছেড়ে দিলেন। সে সুযোগে বালক ঘর থেকে বেরিয়ে এক দৌড়ে উত্তরের মাঠের হাজির হলো। বন্ধুরা ওখানে ফুটবল খেলছে। অনেকদিন পর এই মাঠে এসেছে সে। ওকে দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ল বন্ধুরা। সবাই খেলা থামিয়ে দিল। রাশেদ-মুকুল-কবির দৌড়ে কাছে এলো। বন্ধুর হাত ধরে মুকুল জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছসরে ফুটন’?
‘ভালা আছি, তোরা কেমুন আছস’?
‘আমরাও ভালা আছি। তুই এইবার কয়দিন থাকবি রে’?
‘দুই সপ্তা থাকমু। কয়দিন পরে ইস্কুলে গরমের ছুটি পড়ব। পুরা ছুটিডা বাড়িতে কাটায়া যামু এবার।’
কবির জিজ্ঞেস করল, ‘কার লগে আইছস’?
‘ছোট মামার লগে’।
‘তোর মামাও কি তোর লগে থাকব?’
‘জানি না, থাকতেও পারেন’।
কুশলাদি শেষ হয়েছে। খেলা নতুন করে শুরু হবে, নতুন দল গঠন হবে। জানিয়ে দিল কবির। অনেকদিন পর বন্ধু এসেছে, ওর সৌজন্যে এ আয়োজন।
ফুটনকে বাড়ির আশপাশের ছেলেরা বেশ খাতির-যত্ন করে। থানা সদরের নামকরা স্কুল রায়পুর স্টেশন মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র সে। অত্র এলাকার মধ্যে এ স্কুলটি শ্রেষ্ঠ। সেই স্কুলের ছাত্র ফুটন, এটি কম কথা নয়। তা ছাড়া ছাত্র হিসেবেও সে ভালো। আবার বাবা সৈনিকের চাকরি করেন। তার ওপর তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাও। সে সময় সৈনিকের চাকরি মানেই বিরাট কিছু। দু-চার গাঁয়ে একজন সৈনিক খুঁজে বের করা সত্যিই কঠিন ছিল। ইত্যাদি সব কারণে বন্ধুদের কাছে ফুটনের কদর একটু বেশিই।
খেলাধুলা শেষ করে গোধূলিলগ্নে বাড়ি ফিরেছে ফুটন। মা ওর জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন। কত কী যে পিঠা বানিয়েছেন। এরই মধ্যে অনু খেয়েদেয়ে বোনের কাছ থেকে পাওয়া পকেট খরচের টাকা নিয়ে দোকানে আড্ডা দিতে গেছে। রাজাপুকুরে ওর মেলা বন্ধু-বান্ধব। ওরা বেশির ভাগই সিগারেট ফুঁকার দল। ফুটনের জেঠাতো ভাই আজিম-শাহেদ আছে এই দলে। অনু এ বাড়ি এলে ওরা ভীষণ খুশি হয়। ওকে নিয়ে দূর-দূরান্তে আড্ডায় যাওয়ার সুযোগ হয়। অন্য সময় এ ধরনের সুযোগ পাওয়া যায় না। ফুটনের মায়ের কড়া শাসন ওদেরকে দমিয়ে রাখে।
ফুটনের জেঠার পাঁচ ছেলে। জেঠি মারা গেছেন ছেলেরা ছোট থাকতেই। জেঠা ছেলেদের মুখেরদিকে তাকিয়ে দ্বিতীয়বার বিয়ে-টিয়ে করেননি। সংসারের প্রতি তিনি ছিলেন বিরাগভাজন। ফলে ওদের সংসারের দায়িত্ব ফুটনের বাবার কাঁধে তুলে নেন, যা পরবর্তীতে মায়ের কাঁধে বর্তায়।
বাড়তি এই ছয়জনের ভরণপোষণের দায়িত্ব বাবা মনির আহমেদ কাঁধে তুলে নিলেও মা হোসনেয়ারা বেগমের কাছে এটি কঠিনতর একটি কাজ মনে হলো। তার নিজের এক সন্তান এবং বাড়তি ছয়জনের খাবার-দাবার, তার ওপর সংসার গোছানো মহা এক ঝামেলার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফুটনকে ওর নানাবাড়ি রেখে পড়ালেও ভাসুর, ছেলেদেরকে সামলানো কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠল। ওদেরকে স্কুলে পাঠানো থেকে শুরু করে সব দায়িত্বই পালন করতে হয় টুনটুনিকে।
সংসার সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে মাঝেমধ্যে রেগে যেত টুনটুনি। তখন পাড়াপড়শি-আত্মীয়-স্বজনরা তাকে সান্তনা দিত, ‘পাঁচ পোলা বড় হইলে আফনার কোনো দুঃখ থাকব না। অরা চাকরি-বাকরি করলে আফনারে মাথায় তুইলা রাখব।’
হোসনেয়ারা বেগম জানতেন এটি মিথ্যে আশ্বাস। ছেলেরা বড় কিছু হলে যে তার খবরও নেবে না এ তিনি ভালো করেই জানেন। তথাপি মুখ বুজে সংসারের সব কিছু সামলে নিচ্ছেন।
ফুটনকে কাছে পেয়ে জেঠাতো ভাইয়েরা ভীষণ খুশি। অনেক দিন পর ছোট ভাই বাড়ি এসেছে। মেজ ভাই জুলফিকারের ইচ্ছা ফুটনকে নিয়ে দোকানে যাওয়ার। বাড়ির পাশের দোকানগুলোতে তখনো শুভ হালখাতা চলছে। দোকানিরা মাইকে পুরনো দিনের বাংলা-হিন্দি এবং যাত্রাপালার গান বাজিয়ে উৎসব পালন করছেন। বাকি দেওয়া টাকাটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তুলে নিতে এত সব আয়োজন।
রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসার আগেই মেজ ভাই ফুটনের হাত ধরে কাজিম উদ্দিনের দোকানের সামনে হাজির হয়েছে। এই দোকানে পরিবারের লোকজন বাকি-টাকি খায়। বেশ কিছু টাকা দোকানির পাওনা হয়েছে। যার অর্ধেকটা গতকাল শোধ হয়েছে। কাজেই ছোট ভাইকে এ দোকানে নিয়ে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ, তাতে ইজ্জত বাঁচবে।
কাজিম উদ্দিন অন্যসব দোকানিদের তুলনায় কিছুটা নমনীয় প্রকৃতির। জুলফিকারের বিশ্বাস ভাইকে দেখলে দোকানি অন্তত হাতে একটা জিলাপি তুলে দিবেন। মূলত ওই বিশ্বাসেই ভাইয়ের হাতধরে দোকানে নিয়ে আসা।
মেজ ভাইয়ের হাত আঁকড়ে ধরা নাদুস-নুদুস ফুটফুটে ছেলেটিকে দেখে দোকানি ইশারায় কাছে ডাকলেন। মেজ ভাই এটাই চেয়েছেন এতক্ষণ। বালক কাছে যেতেই দোকানি ওর থুঁতনিতে হাত দিয়ে আদর করে জিজ্ঞেস করলেন,‘তোমার নাম কি’?
‘ফুটন’।
‘কই থাহ বাবা? টাউনে থাহ বুঝি’?
‘নানাবাড়ি থাহি’।
‘এই জুলফিকার, রাজপুত্রডা কে রে? টাউনের পোলাপানের মতো দেহা যায়।
দোকানির প্রশ্নে মেজো ভাই গর্বিত হলেন। ঝটফট জবাব দিলেন,‘আমার ছোড ভাই, ছোড চাচার বড় ছেলে। লেখাপড়ায় ভালা। আগে চাচার লগে ঢাকায় থাকত। ওইহানের ইস্কুলে পড়ত। চাচা বদলি অওনের পর গেরামে চইল্যা আইছে অরা। এহন নানাবাড়ি থাইক্যা থানা সদরের ইস্কুলে পড়ে। বাড়ি আইছে দুপুর বেলায়। হালখাতা দেখাইতে নিয়া আইলাম দোকানে তাই।’
‘ভালা করছো। হালখাতা দেহুক আবার গেরামের মাইনষেরও চিনুক। ধরো বাবা, জিলাফি দুইডা ধরো।’ ফুটনের দিকে জিলাপি দুটি বাড়িয়ে দিলেন দোকানি।
বালক হাত বাড়িয়ে জিলাপি দুটি নিল। এতক্ষণ দোকানিকে ভালোমতো দেখতে পায়নি সে। হ্যারিকেনের বিপরীত দিকটায় পাতলা কাগজ গুঁজে দেওয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকায় লোকটিকে দেখা যায়নি। এবার ঠিক ঠিক দেখতে পেয়েছে। ঘাড়টানা দিয়ে ফুটনের দিকে ঝুঁকে জিলাপি দেওয়ার সময় ভালোমতো দেখেছে। লোকটিকে এ গাঁয়ে আর দেখেনি, এবারই প্রথম দেখেছে। দেখে মনে হচ্ছে লোকটি ওর বাবার বয়সী। কথাবার্তা শুনে গাঁয়ের অন্যদের চেয়ে একটু আলাদাই মনে হলো দোকানিকে।
দোকানে কিছু সময় কাটিয়ে ছোট ভাইকে নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়াল মেজো ভাই। আঁধারে বালক ভয় পেতে পারে ভেবে ওর হাতের কব্জি শক্ত করে ধরল। হাঁটতে হাঁটেত দুই ভাই এটা-সেটা বলে এগুতে লাগল। কথা প্রসঙ্গে মেজ ভাই জিজ্ঞেস করল, ‘নানাবাড়ি ক্যামন লাগেরে ফুটন’?
‘ভা-লা’।
‘ভা-লা কথাটা যে কইলি, তা কিন্তুক আমার কাছে ভালা মনে হইল না। তুই হাচা ইরা ক’ কেমন লাগে ওই বাড়িতে’?
‘না, ভালা-ই’।
‘দেখ তুই আমার লগে চালাকি করিস না, আমি কিন্তুক হগলই বুঝি। আমি কাউরেই কিচ্ছু কমু না, আমারে সব খুইলা ক’।
বালক কী যেন চেপে যাচ্ছে, তা টের পাচ্ছেন মেজ ভাই। তিনি নিজেও মেধাবী ছাত্র। মেট্রিকে ভালো রেজাল্ট করেছেন। এখন চট্টগ্রামে ডাক্তারি পড়ছেন। বছর খানেক আগে ছোট ভাইকে তার কলেজ ছাত্রাবাসে নিয়ে গেছেন একবার। দু’দিন নিজের কাছে রেখে পরে ফুটনের বাবার কাছে পৌঁছে দেন। বাবা তখন হালিশহরে থাকতেন। সে সুবাদে বালকের চট্টগ্রাম শহরটাও দেখা হয়ে যায়।
জুলফিকার বেশ বুদ্ধিমান ছেলে। ছোট ভাইয়ের মনোভাব বুঝার মতো জ্ঞান তার ঠিকই হয়েছে। ভাই যখন মাস দুয়েক আগে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে হিজলতলায় যায় তখন ওকে আরো প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিল। দেখতেও বেশ নাদুস-নদুস ছিল। অথচ এ ক’দিনে কেমন শীর্ণ হয়ে গেছে। আগের মতো চঞ্চলতাও নেই ওর মধ্যে। আগে ভাইদেরকে দেখলে জড়িয়ে ধরতো, চুলটেনে দিত, শুয়ে থাকলে পেটের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তো, হাঁটতে গেলে কত কথা জিজ্ঞেস করতো। আজ কেমন জানি চুপসে আছে বালক।
মেজ ভাই পরিস্থিতি গুমোট হতে দিচ্ছেন না। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিলেন। ‘ফুটন, ওই যে সামনে তেঁতুল গাছটা দেহস না, ওইডা কিন্তুক ভালা না, ওইখানে..’।
কথা শেষ করার প্রয়োজন পড়েনি, বালক বুঝে ফেলেছে সব। মেজ ভাইয়ের গায়ের সঙ্গে নিজের গা’টা লাগিয়ে হাঁটছে সে। গাছটার ওপর কাদের বাস, তা গাঁয়ের সবারই জানা। অধিক রাত হলে কেউ সহজে তেঁতুলতলা দিয়ে যাতায়াত করে না। শুধু রাতেই নয়, তিনসন্ধ্যেও কেউ তেঁতুলতলায় আসে না। এখানে যাদের বাস তাদের নাম মুখে নিতে নেই। যে কোন সময় ক্ষতি করতে পারে। গাঁয়ের মোবাশ্বের আলী সেটা বিশ্বাস করেনি। নাম নিয়ে মশকারা করেছে, ব্যস্ বেচারি একেবারেই গাছের নিচেই মারা পড়েছেন। নাকেমুখে রক্তবেরিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্মমভাবে মরেছেন। পুরো এলাকা চাউর হয়ে যাওয়ার পর থেকে আর কেউ-ই ওদের নাম মুখে নেয় না।
তেঁতুলগাছের প্রায় কাছাকাছি এসেছে দুই ভাই। বালক মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়ছে। মেজ ভাই নিজেও কী যেন সব দোয়া-টোয়া পড়ছেন। বালক আরো ভয় পেয়ে গেছে। ভাইয়ের হাতটা খামছে ধরেছে, ভাই ওকে জাপটে ধরে হাঁটছেন। আহ! কত স্নেহ যে করেন জেঠাত ভাইয়েরা ওকে। অথচ নানা বাড়ির সবাই জেঠাত ভাইদের বদনাম দেয়।
মেজ ভাইয়ের হাত আঁকড়ে ধরে চোখ বুজে হাঁটছে বালক। রাস্তাটা ফাঁকা। রাস্তার দু’ধারে হালকা ঝোঁপজঙ্গল, পাশেই খোলাবিল। জলশূন্য বিলে এখন ফসলাদি নেই। নেই জন-মানবের আনাগোনাও। দু’ভাই ছাড়া আর কোন পথিকের যাতায়াত নেই পথটায়। একাকী বাড়ির দিকে রওনা করছে তারা। ওদের সঙ্গী এখন একমাত্র জোনাকি পোকাগুলো। জোনাকি পোকাগুলো সামনাসামনি উড়ছে আর উড়োজাহাজের সাংকেতিক বাতির মতো যৎকিঞ্চিত আলো জ্বালিয়ে পথ দেখাতে সাহায্য করছে। রাস্তার আশপাশে অবস্থান নিয়ে উইচিংড়ি কোনো রকম বিরতি না দিয়ে প্রাণপণে ডাকছে। মাথার ওপর দিয়ে পতপত করে ডানা ঝাঁপটিয়ে দু’একটা কলাবাদুড় এদিক-সেদিক উড়ছে। বিলের দক্ষিণপ্রান্তে থেকে ভেসে আসছে খেঁক শেয়ালের উল্লাস। শেয়ালের উল্লাসে বালকের কলজে কেঁপে উঠছে, সেটি অবশ্য তেঁতুলগাছ আতঙ্কের চেয়ে বেশি নয়। তবে কানের দু’পাশ কেটে বৈশাখী তপ্তহাওয়া বয়ে যাওয়াতে ভয়টা আরো ঝাঁকিয়ে ধরেছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন ফিসফিস করে কিছু একটা বলে সাবধান করছে। বৈশাখী হাওয়ার গতিবিধি দেখে ঝড়ের আবাসও টের পাওয়া যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কাল বৈশাখী ঝড় বইতে পারে যে কোনো সময়। কাজেই দ্রুত বাড়ি ফিরতে হবে। সমস্যা এখন একটাই আর সেটি হচ্ছে তেঁতুলগাছটা পেরুনো।
সন্ধ্যার পর পর সাধারণত এ পথ কেউ মাড়ায় না। তখন নাকি তেনাদের ঘুম ভাঙে। এ সময় বিরক্ত করলে তারা মাইন্ড করে, ফলে রেগে গিয়ে কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলতে পারে। এখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি! এ মুহূর্তে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকাটাও সমীচীন নয়। একমাত্র ভরসা যদি দু’একজন হাটুরে মিলে যায়, তাহলে এ যাত্রায় রক্ষা হয়। মেজ ভাই নিজেও যে ভয় পেয়েছেন তা স্পষ্ট, তার আচরণে টের পাওয়া যাচ্ছে। তিনি সামনে অগ্রসর হতে চাচ্ছেন না, কথা থামিয়ে দিয়েছেন হঠাৎ করেই। পেছন ফিরে যাবেন ভাবছেন, অমনি পেছন থেকে এলেন গাঁয়ের আরো দুই যুবক। মোট চারজন হয়েছেন, এবার ভয় নেই। তেঁতুলতলা দিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
যুবকেরা কোরাস গাচ্ছে। মেজ ভাই দু’একবার তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন পর্যন্ত। তেঁতুলতলা পেরুতেই যেন সবাই বীর বাহাদুর হয়ে উঠলেন। আহ! কী তেজ একেকজনের। এতক্ষণ জিভ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে সবার। স্বয়ং মেজ ভাই পর্যন্ত ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে গেছেন। সেটি টের পেয়ে বালক মনে মনে দিব্যি কেটেছে আর কখনো রাত-বিরাতে তেঁতুলতলা দিয়ে যাতায়াত করবে না।
ঘরে পা রাখতেই বালকের বুক হাঁপরের মতো ওঠানামা করতে লাগল। মা লক্ষ্য করলেন ছেলের দু’চোখ টকটকে লাল এবং মুখটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। কারণটা জানতে চাইলে তেঁতুলতলার ঘটনাটা পুরোপুরি জানাল বালক। সব শুনে মা ক্ষেপে গেলেন মেজ ভাইয়ের ওপর। এতটুকু ছেলেকে নিয়ে কী প্রয়োজন ছিল রাত-বিরাতে বেরুনোর। যেতে হয় একাই যাও। ফুটনকে নিয়ে কেন? এখন তো ছেলে ভয়ে অস্থির। মা নিজেও ভয় পেয়ে গেছেন। লবণ ছেঁকে ছেলের মুখে দিচ্ছেন, ঘরে একবোতল পানিপড়া ছিল, বোতলের ছিপি খুলে পানি নিয়ে ছেলের গায়ে ছিটিয়ে দিলেন। বিষয়টা জটিল হতেই মেজ ভাই ইতস্ততবোধ করতে লাগলেন। ছোট ভাইকে যে জিলাপি খাওয়াতে নিয়ে গেছে, এখন ওই কথা বলাও যাবে না। কাকিমা আরো রেগে যেতে পারেন। রাগ পড়ে গেলে না হয় পরে সব খুলে বলবেন।
জুলফিকার জানেন কাকিমা মানুষ হিসেবে মন্দ নয়। ভালোদের কাতারেই পড়েন। একটু সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ। যখন যে যাই-ই বোঝায়, তাই-ই বোঝেন তিনি। বাড়ির অন্যরা তেঁতুলগাছ আতঙ্কে আতঙ্কিত করেছেন কাকিমা’কে। কাজেই আপাতত রেগে থাকাটাই স্বাভাবিক। তার ওপর নিজ ছেলে বলে কথা। একটু রাগ হতেই পারে। তবে ভুলটা তার নিজেরই। ভাইকে আগে বারণ করে দিলেই পারত। অথবা আতঙ্ক কেটে গেলে ঘরে ফিরলে ভালো হতো। দু’টির একটিও যখন করেনি তখন একটু বকাঝকা হজম করতেই হবে। রাগ পড়ে গেলে কাকিমা নিজেই অনুতপ্ত হয়ে পড়বেন এবং হয়েছেনও অল্প সময়ের মধ্যে। কাকিমা’র সেই কঠিন রাগ নিমেষেই নেমে গেছে। তার প্রধান কারণটি হচ্ছে কাল বৈশাখীর ঝড়। বিনা নোটিশে কাল বৈশাখী ঝড় বইতে শুরু করায় ঘরের দরজা-জানালায় খিড়কি লাগাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেলেন কাকিমা। তার ওপরে বজ্রের হুঙ্কার আর শো শো বাতাসের ঝাঁপটানি এবং শীলের তাণ্ডবে ভয়ে গুটিয়ে গেছেন তিনি। ভুলে গেছেন পেছনের ঘটনাটি তাই।