গল্প
ইচ্ছেপূরণ প্রজা
ইচ্ছেপূরণ দেশ নামে একটি দেশ আছে। ওই দেশে আছে ইচ্ছেপূরণ রাজা। আছে ইচ্ছেপূরণ প্রজা। প্রজারা যা কিছু ইচ্ছে করে, রাজা তা পূরণ করেন। সে জন্যই তো দেশটির নাম ইচ্ছেপূরণ দেশ।
ওই ইচ্ছেপূরণ দেশেই ছিল এক টমেটো। কেবল পাকতে শুরু করেছে, হালকা হলুদ রং ধরেছে তার গায়ে। পাকতে আর বেশি দিন নেই। তাই টমেটোর মন খারাপ। আশপাশের গাছের অনেক টমেটোকে ও দেখেছে—পেকে পেকে ঝরে যাচ্ছে। পাকার পর আর বেশিদিন গাছে ঝুলে থাকতে পারে না ওরা। একসময় ওদের বোঁটা শুকিয়ে আসে। জোর কমে যায়। ব্যস। পাকা টমেটোর ভার রাখতে পারে না শুকিয়ে যাওয়া বোঁটা। তখন গাছ থেকে ঝরে পড়তেই হয়। কিন্তু এমন জীবন চায় না টমেটোটা। যে গাছে ও ঝুলে আছে, সেই গাছকে বলল, আমি পৃথিবী দেখতে চাই। কেমন করে দেখব?
টমেটো গাছ বলল, কেন এখন দেখতে পাচ্ছিস না?
টমেটো বলল, প্রতিদিন একই জিনিস দেখতে আর ভালো লাগছে না। আরো অনেক কিছু দেখতে চাই আমি। আমার অনেক ইচ্ছে ঘুরে ঘুরে দুনিয়া দেখব।
টমেটো গাছ বলল, দুনিয়াটা তো অনেক বড়। কতটুকু দেখবি? মানুষই পুরো ঘুরে দেখতে পারে না। আর আমি তো গাছ। গাছেরা না পারে নড়তে, না পারে চলতে। কেমন করে ঘুরে দেখবি?
টমেটো বলল, কোনো উপায়ই কি নেই?
টমেটো গাছ বলল, একটা উপায় অবশ্য আছে। তুই যখন পেকে ঝরে পড়বি, তারপর মাটির সঙ্গে মিশে যাবি। তোর ভেতরের বিচিগুলো মাটিতে বিছিয়ে যাবে। ওই বিচি থেকে নতুন চারাগাছ জন্মাবে। ওই চারাগাছ বড় হবে। সে গাছগুলোতে টমেটো হবে। সে টমেটো একসময় পেকে ঝরে পড়বে মাটিতে। আরো একটু ছড়িয়ে যাবে সেই পাকা টমেটোর বিচিগুলো। এই যে এখানে এতবড় টমেটোর বাগান দেখতে পাচ্ছিস, এটা কিন্তু এভাবেই হয়েছে। আবার কোনো পাখি ঠোঁটে করে পাকা টমেটো নিয়ে গেল অনেক দূরে। সেখানেও এমনি টমেটোর বাগান হবে। এভাবে টমেটোদের দুনিয়া দেখা ছাড়া গতি নেই।
দুনিয়া দেখার এমন পদ্ধতি মোটেও পছন্দ হলো না টমেটোটার। এটা খুবই ধীর একটা পদ্ধতি। সে নিজেই দুনিয়া দেখতে চায়। তার বিচি থেকে জন্ম নেওয়া গাছে ধরা টমেটোর মাধ্যমে নয়। কিন্তু কী ভাবে ভাবতে লাগল টমেটো।
আকাশের দিকে তাকাল। কী সুন্দর মেঘেরা উড়ে উড়ে যাচ্ছে। ভাবল, মেঘেদের নিশ্চয়ই অনেক মজা। অনেক উঁচু থেকে পৃথিবী দেখতে পাচ্ছে। এখান থেকে ওখানে চলে যাচ্ছে কত অল্প সময়ে। আহা! পৃথিবীটা না জানি কত সুন্দর! এর সামান্য একটু দেখেছে সে। তাও এই টমেটো বাগানের পুরোটাও দেখতে পারছে না। যতদূর দেখতে পাচ্ছে কেবল টমেটো গাছ আর টমেটো। আর ওপরে আকাশ। একই আকাশ দেখছে প্রতিদিন, প্রতিরাত। যদিও প্রতিদিন আর প্রতিরাতে আকাশ দেখতে একই রকম লাগছে না। কোনো দিন রোদ, কোনো দিন মেঘ, কোনো দিন রংধনু আরো কত কিছু। এটা তো এ মাঠের সব টমেটোই দেখতে পায়। সে চায় আরো বেশি কিছু দেখতে। দুনিয়ার সব জায়গা কি এমন টমেটো গাছেই ভরা? জানে না সে। জানতে চায়। দুনিয়ার সব জায়গাই কি এই টমেটো বাগানের মতো— জানতে চায় সে।
ধীরে ধীরে তার গায়ের রং আরো লালচে হয়ে যাচ্ছে। তার মানে ধীরে ধীরে আরো পেকে যাচ্ছে সে। যেভাবে পাকতে শুরু করেছে, তাতে দুদিনের মধ্যেই পেকে একেবারে লাল হয়ে যাবে। তখন আর কিছু ভাবার সময় থাকবে না। ভাবতে গেলেই আনমনা হয়ে যাবে। আর একটুখানি আনমনা হলেই সর্বনাশ। এক পলকা বাতাসের ঝাপটাতেই সোজা মাটিতে। মাটিতে পড়ার কথা মনে হতেই একটা পদ্ধতির কথা মনে হলো। আচ্ছা, গাছ থেকে মাটিতে পড়েই গড়িয়ে গড়িয়ে নিশ্চয়ই অনেক দূর যেতে পারবে। ওই গড়ানোর সময়ই দুনিয়ার অনেকখানি দেখে নিতে পারবে। সারা জীবন তো আর কেউ গড়ায় না। তারপর একসময় নিশ্চয়ই গড়ানো থেমে যাবে। আর গড়ানো থেমে যাওয়া মানেই দুনিয়া দেখা শেষ। তা ছাড়া গড়াতে গড়াতে শরীরে চোটও পেতে পারে। শরীরের কোথাও ছিদ্রও হয়ে যেতে পারে। ছিদ্র হলেই সর্বনাশ। ওখানেই থেমে যেতে হবে চিরদিনের জন্য। নাহ্। এটা কোনো পদ্ধতি হতে পারে না। নিজে নিজেই বাতিল করল পদ্ধতিটা। তাহলে?
পাকতে আর বেশি সময় নেই—ভাবে আর মুগ্ধ চোখে চারপাশে তাকায় পাকতে যাওয়া টমেটোটা। চারপাশে তাকিয়ে খানিকটা বিরক্তও হয়। টমেটো গাছ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। কিছু ঘাস আছে অবশ্য। ওই ঘাসগুলো পাকা টমেটোদের বন্ধুর মতো। ঘাসের কারণেই টুপ করে মাটিতে পড়লেও সঙ্গে সঙ্গে ফেটে যায় না অনেক পাকা টমেটো।
আনমনে ঘাসের দিকে তাকিয়ে আছে টমেটোটা। হঠাৎ কানে একটা শব্দ এলো থপ, থপ, থপ।
আনমনা ভাবটা কাটিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করে দিয়েছে টমেটো। শব্দটা কোথা থেকে আসছে বোঝার চেষ্টা করছে। থপ। আবার অনেকক্ষণ পর থপ। এবার আরো একটু কাছে। মনে হলো শব্দটা ওর দিকেই আসছে। ঠিক তাই। হঠাৎ কানে তালা লাগার মতো শব্দ হলো ধপ। একটি প্রাণী—ব্যাঙ। ওই ব্যাঙটাই তাহলে এতক্ষণ থপথপ করে আসছিল ওর দিকে। কাছে আসায় ধপ করে শব্দটা হলো। ও যে গাছে ঝুলে আছে ব্যাঙটা ঠিক তার নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। ব্যাঙটার সঙ্গে আলাপ জমানোর জন্য এর চেয়ে আর মোক্ষম সুযোগ হবে না।
টমেটো জানতে চাইল, কোথায় যাও ব্যাঙ ভাই?
ব্যাঙ বলল, ভাই না। বলো বোন। আমি পুরুষ ব্যাঙ না। যাই হোক। যাচ্ছি আমার ছানাদের কাছে। ওরা এখন পুকুরে আছে। জানিসই তো জন্মের পর ব্যাঙ ছানারা পুকুরেই কাটায় কিছুদিন। কিছুটা বড় হলে পরে ডাঙায় আসে। তা তুই তো বেশ পেকে যাচ্ছিস দেখছি। তোর গায়ের রংটা তো বেশ সুন্দর!
গায়ের রঙের প্রশংসা শুনেও খুশি হতে পারল না টমেটো। দুঃখ নিয়ে বলল, গায়ের সুন্দর রং হয়েই বা লাভটা কী। তোমার মতো তো ঘুরে ঘুরে দুনিয়া দেখতে পারছি না। তোমার কত মজা। পানিতেও থাকতে পারো, আবার ডাঙাতেও ঘুরতে পারো।
ব্যাঙ বলল, দুঃখ করে লাভ নেই রে টমেটো। সবার জীবন তো আর একরকম হয় না। তোর জীবনটাই এমন—গাছে ঝুলে ঝুলে দুনিয়া দেখা। তাও তো অনেক দিন ধরেই দুনিয়া দেখেছিস। ইঁচড়ে পাকা টমেটোগুলো তো সে কয়দিনও দেখতে পারে না। অনেক আগেই ঝরে যায়। ওগুলো থেকে টমেটো গাছও হয় না। এখন যাই। পুকুরে ডুব দিয়ে আসি। ছানাগুলোকেও দেখে আসতে হবে।
বলেই আবার ধপ করে একটা লাফ দিল ব্যাঙটা। তারপর থপ থপ করে চলে গেল পুকুরের দিকে। একমনে ব্যাঙটার চলে যাওয়া দেখল টমেটো। তার মনে হলো, এই ব্যাঙটার মতোও যদি হতে পারত সে! যদি ব্যাঙটার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে পারত!
ঠিক তখনই ঘটে গেল অদ্ভুত এক ব্যাপার। টমেটোটা হঠাৎ দেখল ও আর গাছে নেই। আনমনে ভাবতে ভাবতে কখন যে গাছ থেকে ঝরে পড়েছে, বলতে পারবে না। কিন্তু এই সময় তো ওর ঝরে পড়ার কথা নয়। তাহলে ঝরে পড়ল কেন? এখনো তো পুরোপুরি লাল হয়নি।
মাটিতে পড়ে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইল টমেটোটা। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। গড়ানো শুরু করে দেবে? তাহলে তো আরো কিছু দেখতে পাবে সে। গড়াতে গড়াতে যদি এই টমেটো বাগানটা পেরোতে পারে, তাহলে টমেটো বাগানের বাইরে কী আছে দেখতে পাবে। যেই গড়াতে যাবে অমনি অবাক বিস্ময়ে তাকাল নিজের শরীরের দিকে। এ কী! ওর পা গজিয়ে যাচ্ছে! একে একে চারটে পা গজাল। সামনে দুটো ও পেছনে দুটো। সামনের পা দুটো ছোট। পেছনের পা দুটো বড়।
কী হচ্ছে এসব! ভাবতে লাগল টমেটো। সত্যিই কি ওর পা হয়েছে! সত্যিই কি ও আর এখন গাছে ঝোলা সেই টমেটোটি নেই! ওকি তাহলে এখন ব্যাঙ হয়ে গিয়েছে?
সত্যি সত্যি সে ব্যাঙ হয়েছে কি-না দেখার জন্য লাফ দিতে চাইল। কিন্তু লাফের কথা মনে হতেই ভয় পেল। কিন্তু লাফ ওকে দিতেই হবে। ব্যাঙ হলে বাকি জীবনটা লাফিয়েই কাটাতে হবে। আবার ব্যাঙ হয়েছে কি না জানার জন্যও লাফ দিতে হবে। কাজেই চোখ বুঁজে পেছনের পা ভাঁজ করে পুরো শরীরটাকে ঠেলল সামনের দিকে। এবং সত্যি সত্যি সে লাফ দিতে পারল। লাফ দিয়ে যখন সে কিছুটা উপরে উঠেছিল, বেশ ভয় করছিল তখন। ওপরে উঠে মনে হয়েছিল, ঠিকমতো নিচে নামতে পারবে তো? নাকি আবার ফেটে যাবে। কিন্তু কিছুই হলো না। বেশ নিরাপদে জীবনের প্রথম লাফটি শেষ করল ব্যাঙটমেটো। খুশিতে বেশ কয়েকটা ডিগবাজি খেল ও। তারপর আবার আরেকটি লাফ দিল। তারপর আবার। লাফিয়ে উপরে উঠে আর সামনের দিকে তাকায়—দেখতে চেষ্টা করে টমেটো বাগানটা কত বড়।
এমন লাফালাফি দেখে কিন্তু টমেটো গাছগুলো অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ব্যাঙটমেটোর দিকে। বলাবলি করতে লাগল ওরা—দেখো, দেখো টমেটোটা লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে।
একটা টমেটো গাছ বলল, টমেটো কি লাফাতে জানে নাকি? এটা নিশ্চয়ই কোনো দুষ্ট খোকার কাজ। গাছ থেকে টমেটোটা ছিঁড়ে হাতে নিয়ে ছোড়াছুড়ি খেলতে খেলতে যাচ্ছে।
এটা শুনে বাগানের লম্বা গাছগুলো মাথা উঁচিয়ে ভালোমতো তাকাল ঘটনা কী দেখার জন্য। নাহ্। খোকা বা খুকি—কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি টমেটোটা একা একাই লাফাচ্ছে?
বাগানের সবচেয়ে বুড়ো টমেটো গাছটি বলল, এখনো ঠিকমতো লাল হয়ে উঠিসনি। আরো দেড় দিন গাছের বোঁটায় আটকে থাকতে পারতিস। তা-না লাফিয়ে পড়ার শখ হলো। এখন আবার লাফাচ্ছিস! ওরে বোকা টমেটো, এত লাফাস নে। ফেটে যাবি তো।
টমেটোব্যাঙ বলল, ফাটব না। আমি আর টমেটো নই। আমি এখন টমেটোব্যাঙ। বুঝেছ?
বলেই আবার একটা লাফ দিল টমেটোব্যাঙ। এবার এক লাফে অনেকদূর যেতে পারল। আর পাঁচ-সাত লাফেই পেরিয়ে এলো টমেটো বাগান। বাগানের শেষ মাথায় একটা পুকুর। পুকুরে টলটলে পানি। টলটলে পানি দেখেই পুকুরে ঝাঁপ দিতে মন চাইল ওর। কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। পুকুরপাড়ে আরো দুটো ব্যাঙ দেখতে পেল টমেটোব্যাঙ। পুকুরপাড়ে এসেই ওই ব্যাঙ দুটো দেরি করল না একমুহূর্ত। টপাটপ লাফিয়ে পড়ল পানিতে। দেখে সাহস হলো টমেটোব্যাঙটার। লাফিয়ে পড়তে যাবে এমন সময় একটা চিৎকার শুনতে পেল। সেই বুড়ো টমেটোগাছটা চিৎকার করে বলছে, পুকুরে লাফাস নে। পচে যাবি তো!
বুড়ো গাছটির কথা শুনে হাসল টমেটোব্যাঙ। বুড়োরা এত ভীতু কেন?
পুকুরের দিকে তাকাল আবার। কী সুন্দর টলটলে পানি। পুকুরে লাফ দেওয়ার ইচ্ছেটা আবারও চাঙ্গা দিল। কিন্তু লাফ দেওয়ার সাহস পাচ্ছে না। হঠাৎ চোখ বুঁজে লাফ দিল পুকুরে।
কিছুই হলো না টমেটোব্যাঙটার। পচল না। আর কী! এর পর থেকে কখনো পুকুরে, কখনো ডাঙায় লাফালাফি করতে থাকল টমেটোব্যাঙ। একসময় সত্যিকারের এক ব্যাঙ হয়ে ওঠল ও। ব্যাঙেরা যেমন হয়। কিন্তু টমেটোটা ব্যাঙ হলো কেমন করে? কারণ ও ছিল ইচ্ছেপূরণ দেশের এক প্রজা। ওর ইচ্ছে হয়েছিল ব্যাঙ হবে, হয়েছে। ইচ্ছেপূরণ দেশের নিয়মই এমন যে যেমনটি ইচ্ছে করে, তেমনটি হয়।