সাত স্বর্ণশহরের খোঁজে
পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরোপে শুরু হয় আবিষ্কারের যুগ। সমুদ্রে তখন স্পেন ও পর্তুগালের রাজত্ব বেড়েই চলেছে। নানা সামুদ্রিক অভিযানের পেছনে বেহিসেবী অর্থ ঢালা হচ্ছে। রহস্য উন্মোচনের নেশায় তখন সারা পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছেন তাঁরা। পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল থেকে পূর্ব দেশ পর্যন্ত, পুরো এলাকা ঘুরে অনেক সম্পদও সংগ্রহ করেন তাঁরা। অভিযানের নেশা এবং সোনার লোভ তখন পেয়ে বসেছে অভিযাত্রীদের। এই সময়েই ছড়িয়ে পড়ে সিবোলার কথা। যেখানে রয়েছে সোনার তৈরি সাতটি শহর।
পৌরাণিক কাহিনী হলেও মানুষের মনে এখনো বিশ্বাস সিবোলার অস্তিত্ব রয়েছে। আর এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে স্পেনের রাজা ডন রদ্রিগোর পরিণতির জন্য। ৮০০ খ্রিস্টাব্দে মুসলমান শাসকের কাছে নিজের সাম্রাজ্য হারিয়েছিলেন তিনি। প্রচলিত আছে পরাজিত হওয়ার পর সাতজন বিশপ এবং আরো বেশ কিছু লোক নিয়ে আন্তিলিয়া নামের এক দ্বীপে পাড়ি জমিয়েছিলেন রদ্রিগো। সেই দ্বীপে সাত বিশপের সবাই আলাদা করে শহর নির্মাণ করেছিলেন এবং সেই দ্বীপ থেকে যেন কেউ স্পেনে ফিরে যেতে না পারে সে জন্য জাহাজ ও দিকনির্দেশকারী সব যন্ত্র পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল।
ইতিহাসটা ওই দ্বীপেই চাপা পড়ে যেতে পারত কিন্তু ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দের দিকে নারভায়েজ অভিযানের চার অভিযাত্রী ওই দ্বীপ থেকে স্পেনে বেঁচে ফিরেছিলেন। ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়া ওই অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল ফ্লোরিডায় উপনিবেশ স্থাপন করা। ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা মেক্সিকো থেকে ফ্লোরিডায় যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু টেক্সাসের উপকূলে গিয়ে জাহাজ ধ্বংস হয়ে মারা পড়েন অভিযাত্রীরা। যারা দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন, তাঁরা ধরা পড়ে সেখানকার আদিবাসীদের হাতে। চার বছর বন্দী থাকার পর দ্বীপটি থেকে পালাতে সক্ষম হন তাঁরা। কিন্তু পথ খুঁজে না পেয়ে সমুদ্রেই ঘুরতে থাকেন চার অভিযাত্রী। এর মধ্যে যে দীর্ঘ চার বছর পেরিয়ে গেছে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না তাঁদের।
৬০০ জনের বিশাল অভিযাত্রীর দল থেকে চার বছর পর মাত্র চার জন জীবিত ছিলেন। মেক্সিকোর সিনালোয়াতে স্পেনের সেনাদের সাথে দেখা হয়ে যায় তাঁদের। সেই বেঁচে ফেরা অভিযাত্রীরাই পরে আদিবাসীদের মুখে শোনা বিভিন্ন গল্প শুনিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন সোনা দিয়ে বানানো সাত শহরের কথা। সনোরান মরুভূমির কোথাও ওই শহরগুলো রয়েছে বলে প্রচলিত রয়েছে।
১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে নিউ স্পেনের ভাইসরয় অ্যান্টোনিও দে মেনদোজা ওই দ্বীপ থেকে বেঁচে ফেরা একজনকে সোনার শহর খুঁজে বের করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর সাথে অভিযানে একজন উত্তর আফ্রিকান ক্রীতদাস এবং একজন ফ্রান্সিসকান সম্প্রদায়ের ধর্মযাজক ছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গ সেই ক্রীতদাস অভিযানে মারা পড়েন জুনিদের হাতে। প্রাণ নিয়ে ফেরা ওই ধর্মযাজক দাবি করেছিলেন সেই সাত স্বর্ণশহরকে তিনি দূর থেকে দেখেছেন কিন্তু প্রাণের ভয়ে কাছে যাওয়ার সাহস পাননি।
ধর্মযাজকের কথা শুনে ভাইসরয় নতুন আরেকটি বড় অভিযাত্রীর দল পাঠান স্বর্ণশহরের খোঁজে। এবারকার দলের নেতৃত্ব দেন ভাজকুয়েজ দে করোনাদোকে। ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাড়ে ৩০০ স্প্যানিশ সেনা এবং ৯০০ থেকে এক হাজার ৩০০ আদিবাসীকে নিয়ে সাত স্বর্ণ শহরের খোঁজে অভিযান পরিচালনা করা হয়।
প্রায় দুই বছর ধরে চালানো সেই অভিযান পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। স্বর্ণ শহরের খোঁজে গিয়ে অভিযাত্রীরা শুধু আদিবাসীদের কিছু মাটির তৈরি ঘর খুঁজে পায়। খালি হাতে মেক্সিকো ফিরে সেই অভিযাত্রী দলের প্রায় সবাই দেউলিয়া হয়ে যায়।
তবে স্বর্ণশহরের খোঁজ না পেলেও ওই অভিযানে স্পেনের হয়ে আরিজোনা, নিউ মেক্সিকো, টেক্সাস ও কানসাসের মতো এলাকাগুলো দখল করেন করোনাদো। আর এর মাধ্যমে আমেরিকার দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে স্থাপিত হয় ইউরোপীয় উপনিবেশ।