ছোটদের শামসুর রাহমান
আড়াই বছরের ছোট্ট সুহাকে কবিতা বলতে বললেই সে মাথা দুলিয়ে বলা শুরু করে-
“ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই?”
এই ছড়াটা সুহার বড্ড প্রিয়। ছোট্ট সুহার মতো আরো অসংখ্য শিশুর বেড়ে ওঠার সঙ্গে একই সুতায় গেঁথে আছে শামসুর রাহমানের ‘ট্রেন’ কবিতাটি। শুধু ‘ট্রেন’ কবিতা কেন, আরো কত অসংখ্য লেখা কবি শামসুর রাহমান লিখে গেছেন শিশুদের জন্য, যেগুলো পড়লে মনে হবে এই লোকটা হয়তো তার শৈশব অসংখ্য ছড়া পড়েই কাটিয়েছেন। কিন্তু অদ্ভুত সত্য হলো এই লোকটা নাকি শৈশবে কোনো ছড়া পড়ার সুযোগই পাননি। কবির ভাষ্যমতে, ‘যখন খুব ছোট ছিলাম, কারো মুখে ছড়া শুনেছিলাম বলে মনে পড়ে না। এটা কোনো শিশু কিংবা বালকের জন্য সুখকর কথা নয়। অথচ আজকাল কত শিশুকে চমৎকার ছড়া বলতে শুনি। আমার ছেলেবেলায় যারা ছোট ছিল তারা অনেকেই নিশ্চয়ই ছড়া শুনত, আর নিজেরা দুলে দুলে আওড়াত। আমার বেলা সেটি ঘটেনি বলে আমার অনেক কষ্ট হয় আজও।’
হয়তো কবির নিজের শৈশবে ছড়ার অভাববোধই তাকে ছোটদের জন্য অনেক বেশি লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। শামসুর রাহমান যে সকল ছড়া লিখেছেন, তার বেশির ভাগই ছোটদের জন্য ছড়া। আরো ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, শুধু তাঁর দুই নাতিন নয়না ও দীপিতাকে নিয়েই অনেক ছড়া লিখেছেন তিনি। কবির সেই লেখাগুলো এখনো অপার মুগ্ধতা পড়ে কত অসংখ্য শিশুরা। ছোটদের জন্য তাঁর শিশুতোষ গ্রন্থগুলো হলো : এলাটিং-বেলাটিং, ধান ভানলে কুঁড়ো দেবো, গোলাপ ফোটে খুকির হাতে, স্মৃতির শহর, রংধনু সাঁকো, লাল ফুলকির ছড়া, নির্বাচিত ছড়া-কবিতা, নয়নার জন্য, তারার দোলনায় দীপিতা, ছড়াসমগ্র, আমের কুঁড়ি, ইচ্ছে হলো যাই ছুটে, চাঁদ জেগেছে নদীর বুকে ও সবার চোখে স্বপ্ন।
ছোটদের জন্য কবির লেখা প্রথম ছড়ার বইটির নাম ছিল ‘এলাটিং-বেলাটিং’। এই বইটা পড়লে ছোট্ট তো সোনামণিরা বটেই, বড়রাও কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাবে। কবির ভাষায়,
‘যারা বেড়ায় উড়ে পঙ্ক্ষীরাজের পিঠে,
যারা জিরোয় বসে স্বপ্নবাড়ির ভিটে,
যারা ভেলকি বোঝে হঠাৎ মিলের ফাঁদের,
ফাঁদের ফাঁদের ফাঁদের।
আমার ছড়ার এ বই পড়তে দেবে
তাদের তাদের তাদের তাদের।’
(ছড়ার এ-বই, এলাটিং বেলাটিং)
কবির কিছু কিছু ছড়া বড়দের মনেও নাড়া দিয়ে যাওয়ার মতো এবং এখনো পড়লে মনে হবে যেন বিষয়টা খুব বেশি রকম সমসাময়িক। যেমন :
‘মোল্লাগুলো যখন-তখন
ফতোয়া জারি করে-
পাড়াগাঁয়ের দুলালিরা
দোররা খেয়ে মরে।
...মোল্লাগুলোর জুলুমবাজি
খতম করার তরে
দেশের মানুষ সবাই মিলে
যেতে হবে লড়ে।’
তবে কবির সব ছড়ার ভেতরে ব্যক্তিগতভাবে আমি যেটা সব থেকে পছন্দ করি সেটা হলো ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতাটি। আমরা জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে কত অলীক গুজবের পেছনে ছুটে মরি আর তারপর একসময় আবিষ্কার করি যার পেছনে আমরা সবাই মিলে ছুটেছি তা আসলে নিছক গুজব! এ রকম আদলেই লেখা ‘পণ্ডশ্রম’ ছড়াটি। অসাধারণ এই কবিতাটির শুরুটাও বেশ নাটকীয় :
‘এই নিয়েছে ঔ নিল যা
কান নিয়েছে চিলে।
চিলের পিছে ঘুরছি মরে
আমরা সবাই মিলে।’
শামসুর রাহমানের আরেকটি দারুণ চমৎকার কবিতা হলো ‘যা রাজাকার’। কাদের নিয়ে লেখা তা নিশ্চয়ই নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে।
‘যা রাজাকার ভেগে যা,
এদেশ ছেড়ে ভেগে যা
খোকার সাহস দেখে যা,
মারের মজা চেখে যা।
তোদের হাতে খুনের দাগ
ভাগ রে তোরা জোরসে ভাগ।’
কবির আরেকটি ভীষণ জনপ্রিয় কবিতার নাম রূপকথা। একজন স্বৈরাচারী এক শাসকের গল্প যেখানে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় এই ছড়াটা ছিল মানুষের মুখে মুখে।
“আজব দেশের ধন্য রাজা
দেশজোড়া তাঁর নাম
বসলে বলেন, ‘হাঁট রে তোরা’,
চললে বলেন, ‘থাম’।”
(রূপকথা)
কবির দুই নাতনিকে নিয়েও কবি লিখেছিলেন বেশ কিছু কবিতা। নাতনি দীপিতার জন্য লিখেছিলেন :
‘ছোট্ট মেয়ে দীপিতা রোজ
আদর কুড়ায় ছোট বড় সবার
ঘুমায় যখন মায়ের পাশে
স্বপ্ন দ্যাখে নীল পরীদের সভার।’
যে মানুষটা শৈশবে কোনো ছড়া শোনেননি, সেই মানুষটা জীবনভর শিশুদের জন্য লিখে গেছেন অগণিত ছড়া-কবিতা। কবি আজ আমাদের মাঝে না থাকলেও তিনি বেঁচে আছেন তাঁর ছড়া আর কবিতায় যা হাজার শিশুর মুখে ফেরে আজও। কবির প্রতি রইল সশ্রদ্ধ সালাম।