রাবেয়াদের শহীদ মিনারে
না, রাবেয়াদের স্কুলে শহীদ মিনার নেই। থাকবে কী করে? স্কুলটাই তো এই টুকুন। একটা মাত্র বেড়ার ঘর। উপরে টিনের চাল। সামনে এক চিলতে জায়গা। ওই জায়গায় বড়জোর কুত কুত খেলা যায়। এমন স্কুলে কি শহীদ মিনার থাকে? থাকে না। তার ওপর রুনিখালার টিপ্পনি, ‘যে-ই না স্কুল। তার আবার শহীদ মিনার?’
কথাটা শুনে রাবেয়ার চোখ দুটো ছল ছল করে উঠল। রুনিখালার মেয়ে পড়ে আদর্শ বিদ্যানিকেতনে। বিশাল স্কুল। বিশাল মাঠ। স্কুলের মাঠের এক কোণায় বড় অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শহীদ মিনার। কেবল একুশে ফেব্রুয়ারির দিন ওটা পরিষ্কার করা হয়। বছরের বাকি সময় ওখানে কত রকম নোংরা যে থাকে।
রাবেয়ারা প্রতি বছর আদর্শ বিদ্যানিকেতনের শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দিয়ে আসে। এবার বাধ সাধল রাবেয়া নিজেই। আগের দিন ক্লাসে বলল, ‘আপা, এবার আমরা আর ওই স্কুলের শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাব না। অনেক দূরে হয়ে যায়। দূরের কারণে আমাদের স্কুলের সবাই যেতে পারে না।’
আপা চোখ দুটো কপালে তুলে দিয়ে বললেন, ‘তাহলে কোথায় যেতে চাও? জেলা স্কুলে? ওটা তো আরো অনেক দূর।’
‘না আপা। আমরা নিজেরাই আমাদের স্কুলে শহীদ মিনার বানাব।’
আপার চোখ দুটো কপালেই স্থির হয়ে রইল কিছুক্ষণ। কিছু বলার ভাষাও হারিয়ে ফেললেন কিছুক্ষণের জন্য। মনে হয় কী বলবেন সে কারণে মনে মনে কথা গুছিয়ে নিচ্ছেন।
খানিকপরে বললেন, ‘কিন্তু এক দিনের মধ্যে কি শহীদ মিনার বানানো যাবে? তা ছাড়া বানাবেই বা কারা?’
‘আমরাই বানাবো আপা। একদিনের মধ্যেই বানিয়ে ফেলব।’
তবু আপার সন্দেহ। বললেন, ‘স্কুলের সামনে অতটুকুন জায়গায় কি শহীদ মিনার হবে?’
‘হবে আপা।’
আপা এবার হতাশ কণ্ঠে বললেন, ‘বেশ।’
তাঁর কণ্ঠ শুনেই রাবেয়া বুঝে গিয়েছে, আপা নিশ্চিত শহীদ মিনার হবে না।
কিন্তু পরের দিন সকালে স্কুলে এসে আপার চোখ দুটো ছানাবড়া। ওরে বাবা! কী সুন্দর একটা শহীদ মিনার দাঁড়িয়ে আছে স্কুলের ছোট্ট আঙিনায়। তিনটা স্তম্ভ। মাঝেরটা একটু বড়। দুপাশের দুটো এক সমান। আহা! মা যেন তাঁর সন্তানদের আগলে আছেন। যদিও মাটির তৈরি। কিন্তু এত হুট করে কেমন করে করল ওরা?
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শহীদ মিনার দেখলেন আপা। কিন্তু কারো দেখা নেই কেন? ওরা কি তবে ফুল আনতে গেছে?
একটু পর ছোট্ট একটা ফুলের ডালা নিয়ে এলো রাবেয়া। ফুলের ডালার পেছনে স্কুলের প্রায় সব শিক্ষার্থী। স্কুলটা ছোট। একজন মাত্র শিক্ষক। কিন্তু ওদের আকাঙ্ক্ষা দেখে ভীষণ মুগ্ধ হলেন আপা। জানতে চাইলেন, ‘শহীদ মিনারটা তোমরা কখন বানালে রাবেয়া?’
রাবেয়া লাজুক হেসে বলল, ‘কাল বিকেলে।’
‘খুব সুন্দর হয়েছে।’
‘ধন্যবাদ আপা।’
‘কিন্তু ফুল কোথায়? আরো ফুল লাগবে তো!’
এবার রাবেয়ার চোখ দুটো ছল ছল করে উঠল। বলল, ‘ফুল তো নেই আপা।’
‘আচ্ছা, দেখি। আমিও কিছু ফুল জোগাড় করতে পারি কি না!’
বলে আপা চলে গেলেন। রাবেয়া আর ওর বন্ধুরাও বেরিয়ে পড়ল ফুল জোগাড় করতে। যদিও এখন আর সময় নেই। কারণ ভোর হয়ে গেছে সে-ই কখন। ধীরে সূর্যের আলো উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। এ সময় ওরা ফুল পাবে কোথায়? তবু চেষ্টা করা যাক।
ঘণ্টাখানেক এখানে ওখানে চেষ্টা করল ওরা। বুনোফুলও নেই। পুরো এলাকা খাঁ খাঁ করছে। মন খারাপ নিয়ে স্কুলের পথ ধরল ওরা। আর পথেই দেখা হলো আপার সঙ্গে। আপা বললেন, ‘নিশ্চয়ই ফুল পাওনি, তাই না?’
মুখ ভার করে জবাব দিল রাবেয়া, ‘জ্বি আপা।’
‘মন খারাপ করো না। ফুলের যে ছোট্ট ডালাটা তোমরা এনেছ, ওতেই চলবে। আসলে ভাষাশহীদদের ভালোবাসাটাই হলো বড় কথা। ফুলটা বড় কথা নয়।’
নাহ। এ রকম মধুর কথায়ও ওদের মন ভরল না। ওদের মুখটা ভার হয়েই রইল। আর এই মুখ ভারের কারণে বাকি রাস্তা চুপচাপ পথ চলল ওরা। চলতে চলতে চলে এলো স্কুলে। আর স্কুলের সেই ছোট্ট আঙিনার দিকে তাকাতেই...
অনেক জোড়া চোখ হয়ে গেল রসগোল্লার মতো গোল গোল ইয়া বড়। আরে! স্কুলের পুরো আঙিনা ফুলে ফুলে ঢাকা। যেন ফুলের কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে কেউ। লাল লাল ফুল। কিন্তু এত ফুল এলো কোত্থেকে?
ধীরে ধীরে চোখগুলো উপরের দিকে তাকাল। আর বুঝল এত ফুল এলো কোথা থেকে?
শহীদ মিনারের ঠিক উপরে কী সুন্দর একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। সেই গাছ থেকে ঝুর ঝুর করে পড়েছে ফুল আর ফুলের পাঁপড়িগুলো। লাল লাল পাঁপড়িতে ভরে আছে শহীদ মিনারের চারপাশ।
কিন্তু এ সময় এত ফুল পড়ল কেন?
অবাক হয়ে সেটাই ভাবতে লাগল ওরা।