গল্প
হাড়ের বাঁশি
১.
তরু খুবই চমকে গেল। তার পর ভালো করে আশপাশে তাকাল। মেঝেতে ছোট্ট একটা হাড়ের টুকরো পড়ে আছে। কীভাবে হাড়টা মেঝেতে এলো? শঙ্খের মতো মায়াবী সাদা। মসৃণ মেঝেতে হাড়টাকে মনে হচ্ছে কাগজের পাখি। ভারি সুন্দর তো! না, কেউ ব্যাপারটা খেয়াল করছে না। তরু করল কী, হাতের রুমালটা কায়দা করে মেঝেতে ফেলে দিল। ভাবটা এ রকম, আপনা-আপনি তরুর হাত থেকে মেঝেতে পড়ে গেছে। তারপর নিচু হয়ে পড়ে থাকা রুমাল কুড়িয়ে পকেটে পুরে নিল তরু।
কী রে, দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? সবাই তো সামনে চলে যাচ্ছে? পেছন থেকে বাদল বলল। খুব চঞ্চল স্বভাবের। এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতে পারে না সে। ক্লাসের প্রিয়লাল সিং তাই বাদলের নাম দিয়েছে বাইম মাছ।
তোর তাড়া থাকলে তুই দৌড়া, আমার কথা শুনে বাদল ভ্রূ কোঁচকাল। আমি মনোযোগ দিয়ে ঘরের দেয়ালে থরেথরে সাজানো হাড়গোড়, খুলি, পিস্তল, বন্দুক, গুলি, মান পোশাক-আশাক, ডায়েরি, দেখতে থাকি। চোখের সামনে আরো কত কী! দেখতে দেখতে আমার চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। বাবার কথাও মনে হলো। বাবা যদি আজ বেঁচে থাকতেন!
বাসে করে ফিরছি। বাসের মধ্যে ধুমসে আড্ডা মারছে সবাই। তরু প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে টের পেল, তরুকে ঘিরে রইল এক ধরনের শিহরণ। ধলেশ্বরী সেতুর ওপর দিয়ে যখন আমরা যাচ্ছি, তখন আমাদের প্রধান শিক্ষক কালীকৃষ্ণ বড়াল বলেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর দেইখা তোমাগো কেমন লাগল হেইডা তোমরা লেইখা আমারে জানাইবা। কী কইছি বুঝছো? কালীকৃষ্ণ বড়াল স্যারের এই এক মুদ্রা দোষ। সব কথার শেষে তিনি বলবেন, কী কইছি বুঝছ?
বাসে আমরা সবাই স্যারের কথায় গলা মিলিয়ে কোরামের মতো বললাম, জি স্যার, বুঝছি।
বাসটা নিমতলা পেরিয়ে চৌধুরী রোডে এসে নেমে পড়ল বাঁ দিকে। রাস্তাটা সরু। দুটো গাড়ি কোনোরকমে পাশাপাশি চলাফেরা করতে পারে। বিকেলের শেষ দিকে তরুদের বাস শিংপাড়া বাজারে এসে থামল। তরুরা সবাই নেমে পড়ল বাস থেকে। নামার সময় বাদল, রঞ্জন, ঝিলু, রনি, আখতার একজোট হয়ে নামল। তরু নামল একা। একটা চাপা উত্তেজনা তার ভেতরে কাজ করছে। তরুকে একা নামতে দেখে বাদলই বলে উঠল, দেখ, দেখ আখতাইরা আমাগো তরু কেমন ভাবুক হইয়া গেছে।
আখতারও কম যায় না। সে বাদলকে বলল, আরে বাদলা গাছপালা, তরুলতা তো একটু ভাবুকই হইব। কী কইছি বুঝছস? বলে আখতার হেসে দিল।
তরু কোনো কথা বলল না। সে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। বাকি পথটুকু সে একাই হেঁটে যাবে। শিংপাড়া থেকে ছাতিয়ানতলী যেতে কতক্ষণ লাগবে? ১০ মিনিট না ১৫ মিনিট?
বাড়ি ফেরার পর মা বলল, মনটা খারাপ রে?
খুব ভালো মা।
রাতেরবেলা ঢেঁড়শ ভাজি, শিম দিয়ে পুঁটি মাছের পাতুড়ি, মুলো দিয়ে ডাল চচড়ি আর টমেটোর টক দিয়ে পেট ভরে ভালো খেল তরু। ক্ষিদেও পেয়েছিল বেশ। খাবার সময় তরু শব্দ করে খাচ্ছে। মা দেখলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। অন্য সময় হলে মা নির্ঘাত তরুকে ধমক দিতেন। খাওয়ার সময় শব্দ হলে মা খুব রেগে যান। ভাত খাওয়ার পর তার দুই চোখ বেয়ে গেছো সাপের মতো ঘুম নেমে এলো। ঘুমাতে যাওয়ার আগে তরু হাড়ের টুকরোটাকে বিছানার নিচে কাগজ দিয়ে লুকিয়ে রাখল।
২.
রাতেরবেলা ঘুম ভেঙে গেল তরুর। বাঁশি দিয়ে কে যেন গান গাইছে।
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে।
তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবো রে।
কে অমন সুন্দর করে বাঁশি বাজিয়ে গান করে!
তরু ঘরের মধ্যে কাউকে দেখতে পেল না। কিন্তু পরিষ্কার গান শোনা যাচ্ছে। পাশের ঘরে মা আর মিলি আপা ঘুমাচ্ছে। নানা-নানি তাদের ঘরে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে।
পরদিন।
তার পরের দিন।
তারও পরের দিন
বাঁশির শব্দে তরুর ঘুম ভেঙে যায়।
ভেবো নাকো মা তোমার ছেলেরা হারিয়ে গেছে পথে।
পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল।
জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো...
তরু বিছানার নিচে থেকে হাড়টাকে বের করে আনে। নেড়েচেড়ে দেখে।
৩.
একদিন তরু নানাকে সব ঘটনা খুলে বলল।
সব শুনে নানা গম্ভীর হয়ে তরুকে বলল, নানাভাই সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধাগো কবর ছড়ায়া-ছিটায়া রইছে।
তুমি যে হাড়ের বাঁশির কথা কইতাছো, হেইডা হইলো মুক্তিযোদ্ধাগো চিহ্ন। যতদিন মুক্তিযোদ্ধারা এই দেশের মাটিতে মিশা থাকব, ততদিন দেশপ্রেমের গান বাজব এই গান। কান পাতলেই দেশের মানুষ এই গান হুনবার পারব।
নানার সামনে তরু দাঁড়িয়ে থাকে। তার মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বের হয় না।