আবীরের বায়না
আবীর। রায়হান সাহেবের একমাত্র ছেলে। ক্লাস থ্রিতে পড়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। যদিও রায়হান সাহেব চেয়েছিলেন, আবীর বাংলা মিডিয়ামে পড়ুক; কিন্তু আবীরের আম্মু চাইলেন, ছেলে তার ইংলিশ মিডিয়ামে পড়বে। এ নিয়ে আবীরের আব্বু-আম্মুর মধ্যে অনেক ঝগড়া হলো; কিন্তু ফল হলো না।
আজ আবীর স্কুল থেকে এসেই তার মাটির ব্যাংকটা চুপিচুপি এক আছাড় মেরে ভেঙে ফেলল। তার আম্মু শুনতে পেল না। সব গুনেগুনে দেখা গেল, মোটে আট টাকা। আবীর হাতে করে কী যেন গুনে একাই বিড়বিড় করল, নাহ, এই টাকায় হবে না। এক সপ্তাহ ধরে টিফিন থেকে বাঁচানো এই আট টাকা প্যান্টের পকেটে ভরে আবীর রান্নাঘরে তার আম্মুর কাছে গিয়ে আমতা আমতা করতে করতে দাঁড়াল। আবীরের আম্মু আড়চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
—কী হয়েছে, কাচুমাচু করছ কেন?
—নাথিং মাম, এমনি।...আচ্ছা আম্মু, তুমি আমাকে ৩০ টাকা দিতে পারবে?
—কেন, কী করবে?
—দাও না আগে। শুনলে তো তুমি দিতে চাইবে না। সত্যি বলছি, আম্মু পচা কিছু করব না।
—কারণটা না বললে টাকা দেওয়া যাবে না। আগে কারণটা বলো। আর এত টাকার তোমার কোনো কাজ নেই। কিছু খেলে বলো, তোমার আব্বুকে ফোন করে দিই, নিয়ে আসবে।
—না, কিছু খাবো না। একটা বিশেষ কারণ আছে।
—সেটাই বলো। আর না বলতে পারলে টাকা দেওয়া যাবে না। যাও, নিজের ঘরে যাও, হোমওয়ার্ক সারো।
কথা শুনে আবীরের মনটা খারাপ হয়ে গেল। মুখটা ভার করে কিছুক্ষণ এখানেই ঘুরঘুর করে নিজের ঘরে চলে এলো। পড়ার টেবিল, খাতার ভাঁজ ঘুরে ঘুরে ওলটপালট করে আবীর বারবার দেখল, আরো কয়েকটা কয়েন পাওয়া যায় কি না; ভুলে যদি এদিক-সেদিক রেখে থাকে। কিন্তু কোথাও আর এক টাকাও পাওয়া না যাওয়ায় আবীর মন খারাপ করে বিছানায় শুয়ে রইল, আব্বু অফিস থেকে ফিরবে এই অপেক্ষায়।
বিকেলে রায়হান সাহেব বাসায় ফিরতেই আবীর দৌড়ে গিয়ে তার আব্বুকে জড়িয়ে ধরল। প্রতিদিনের মতো আজও আবীরের জন্য আনা ক্যাডবেরি চকলেটটি রায়হান সাহেব আবীরের হাতে দিতে চাইলেন। কিন্তু আবীর চকলেট হাতে না নিয়ে রায়হান সাহেবকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে গেল। রায়হান সাহেবও ছেলের হঠাৎ এমন আচরণে কী বলবেন ভেবে না পেয়ে আবীরের সাথে সাথে তার ঘরে গেলেন। আবীর তার আম্মুর ভয়ে দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে আব্বুর কাছে বলল,
—আব্বু, তুমি আমাকে ৩০ টাকা দিতে পারবে?
—কিন্তু কেন, টাকা দিয়ে কী করবে আব্বু? এই যে ক্যাডবেরি এনেছি, এটা নাও।
—না আব্বু, চকলেট লাগবে না। ৩০ টাকা লাগবে।
—আচ্ছা দেব, কিন্তু বলো কী করবে?
—বলো আম্মুকে বলবে না। আম্মু রাগ করবে, তাই আম্মুর কাছে টাকা চেয়েছিলাম; কিন্তু কারণ বলিনি। বলো আম্মুকে বলবে না?
—ঠিক আছে, বলব না। এবার বলো?
—আমার কাছে আট টাকা আছে। তুমি ৩০ টাকা দিলে ৩৮ টাকা দিয়ে একটা লাল-সবুজ জাতীয় পতাকা কিনব। মোড়ের দোকানের আঙ্কেল বলেছে, দাম ৪০ টাকা, দুই টাকা কম রাখবে।
প্রতিদিন চকলেট, আইসক্রিম, ক্রিকেট ব্যাট, শাকিব-তামিমের স্টিকারের বায়নার বদলে আজ ছেলের এমন বায়নায় রায়হান সাহেব একটু বিচলিত হলেন। একটু ভেবে তিনি আবার বললেন,
—জাতীয় পতাকা দিয়ে তুমি কী করবে, বাবা?
—আব্বু, এটা তো ডিসেম্বর মাস, বিজয়ের মাস। আমাদের স্বাধীন হওয়ার মাস। জাতীয় পতাকাটা আমার পড়ার টেবিলে ঝুলিয়ে রাখব। দিবে আব্বু?
—তুমি এত কিছু জানলে কখন, আগে তো বলোনি।
—টিচারের কাছে জেনেছি, এই মাসে আমরা স্বাধীন হয়েছি। আমাদের এই দেশটা পেয়েছি। লাল-সবুজের একটা নিজেদের পতাকা পেয়েছি। তাই তো আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারি। পড়তে পারি, লিখতে পারি।
রায়হান সাহেব ছেলের এমন কথায় কোনো উত্তর পেলেন না। ভেতরে ভেতরে ভালো লাগল। তিনি আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ আবীরের দিকে তাকিয়ে। তার পর কোনো কথা না বলে আবীরকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ার মোড়ের দোকানে গিয়ে বড় দেখে একটা পতাকা কিনে দিলেন ৯০ টাকা দিয়ে। আবীর পতাকাটা হাতে পেয়েই খুশিতে লাফাতে লাগল কাঠবিড়ালের মতো। ঘরে এসেও আবীর পতাকাটা দুই হাতে ধরে আনন্দে সারা ঘর মাথায় তুলে ফেলল। আর তার আম্মুকে বলতে লাগল,
—আম্মু, এই পতাকাটা কিনতেই টাকা চেয়েছিলাম, এই পতাকাটা...।