গল্প
কুয়াশা পরী
রনি মনি বনি ক্লাস থ্রিতে পড়ে। একই বাড়িতে থাকে ওরা। তিনজনই যেমন বুদ্ধিমান, তেমন দুষ্টুমিতেও সেরা। স্কুল বাদে সারা দিন যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, এদিক-ওদিক টইটই করে ঘোরে। ফুটবল খেলে, ক্রিকেট খেলে, গোল্লাছুট খেলে আবার ব্রিজের ওপর থেকে খালের পানিতে লাফালাফিও খেলে। এসব করতে করতে দুপুরে খাওয়ার কথা মনে থাকে না প্রায়ই। তখন মা এদিক-ওদিক খুঁজে ধরে এনে খাওয়ায়, সাথে দু-চারটে বকাও! তবুও দুষ্টুমি রনি, মনি, বনির পিছু ছাড়ে না। ফলের সময় ওরা দুষ্টুমি করে চুপিচুপি এর ওর গাছ থেকে সবচেয়ে ভালো ফলগুলো পেড়ে মজা করে খায়- আমের সময়ে আম, জামের সময় জাম, জলপাইয়ের সময় জলপাই, যা পাওয়া যায় হাতের কাছে। রনি ও বনি ডাল ধরে গাছে উঠতে পারে, মনি পারে না মোটেই। তাই রনি, বনি গাছে উঠে ফল পেড়ে নিচে ফেলে, কুড়ানোর দায়িত্ব পড়ে মনির ঘাড়ে।
ওদের স্কুলে যাওয়ার রাস্তায় পড়ে জমির উদ্দীনের বাড়ি। জমির উদ্দীন রাসভারী গুরুগম্ভীর লোক, কৃপণ হিসেবেও বেশ পরিচিত। লোকে ডাকে কিপটা জমির নামে। শীতকালে এলাকার শিশুদের কাছে জমির উদ্দীনের বাড়ির আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। কারণ গ্রামগঞ্জে এখনো আম জাম গাছ বেশ খুঁজে পাওয়া গেলেও খেজুর গাছ তেমন একটা পাওয়া যায় না, অথচ জমির উদ্দীনের বাড়ির তিনপাশ ঘিরে রয়েছে বেশ কয়েকটি খেজুরগাছ, তাও প্রায় আট-দশটা তো হবেই। শীত পা ফেলতেই এই খেজুরগাছ ওই খেজুরগাছ নিয়েই জমির উদ্দীনের যত কারবার। শীত শুরু হলে কিছু লোক আছে যারা গ্রামের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ‘খেজুর গাছ পরিষ্কার করবেন?’ বলে হাঁক ছাড়ে। তারা টাকার বিনিময়ে খেজুর গাছের ডালপালা পরিষ্কার করে রস বের হওয়ার সুন্দর বন্দোবস্ত করে দেয়। তাদের কাউকে দিয়ে জমির উদ্দীন তাঁর সবগুলো গাছ পরিষ্কার করে নেন, ঘরে যত্ন করে উঠিয়ে রাখা মাটির হাঁড়িগুলো পরিষ্কার করে ধুয়েমুছে রোদে শুকোতে দেন। তারপর খেজুরগাছে রসের জোয়ার এলে শুরু হয় তাঁর রস সংগ্রহের কাজ। বুড়ো জমির উদ্দীন প্রতিদিন বিকেলে দা, ছেনা নিয়ে গাছে ওঠেন। রস বের হওয়ার জায়গাটুকু প্রতিদিন নতুন করে চেঁছে পরিষ্কার করতে হয়। জমির উদ্দীন সেটা পরিষ্কার করে রস বের হওয়ার জন্য সেখানে সুন্দর করে তৈরি একটা বাঁশের চোঙ্গা ঢুকিয়ে দেন। জমির উদ্দীনের স্ত্রী নিচে দাঁড়িয়ে ওপর থেকে নামিয়ে দেওয়া দড়ির মাথায় মাটির কলস বেঁধে দেন। জমির উদ্দীন দঁড়ি টেনে ওপরে তুলে গাছের সাথে শক্ত করে বেঁধে দেন। বাঁশের চোঙ্গা দিয়ে রস বের হয়ে হাঁড়িতে পড়তে থাকে। খেঁজুরের রসে আবার বাদুড় ও কাঠবিড়ালির বড়ই উপদ্রব। সেই উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে রস বের হওয়ার জায়গা কলসসহ সুন্দর করে বেঁধে দেন, যা রসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করে জমির উদ্দীন গাছ থেকে নেমে পড়েন। এভাবে প্রতি বিকেলে তিনি সবগুলো গাছে কলস বাঁধেন।
বাঁশের চোঙ্গা দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রস পড়ে সারা রাতে কলস প্রায় ভর্তি হয়ে যায়। রাত পেরুলে আবার শুরু হয় রস নামানোর কাজ। ভোর বেলায় কনকনে ঠান্ডার মধ্যে কুয়াশা পেরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে গাছে উঠে যান জমির উদ্দীন। কলসের মাথায় দড়ি বেঁধে নিচে নামিয়ে দেন, তাঁর স্ত্রী সেটা ধরেন। এভাবে সবগুলো গাছ থেকে হাঁড়ি পাড়ার পর বাড়িতে নিয়ে যান। জমির উদ্দীনের স্ত্রী সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রস জ্বাল দিয়ে ঘন গুড়ের মতো করে বয়ামে ভরে রাখেন, যা তাঁরা সারা বছর খান এবং বিক্রি করেন। জমির উদ্দীন দু-এক হাঁড়ি রস আবার বাজারেও নিয়ে যান। প্রতি গ্লাস পাঁচ টাকা করে বিক্রি করে বেশ ফুর্তিমনে বাড়ি ফেরেন।
শুধু রনি মনি বনিই নয়, এলাকার আরো অনেক ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আছে যাদের রস খাওয়ার ইচ্ছা জাগে। চাইলে দু-একদিন দেনও জমির উদ্দীন, তাই বলে প্রতিদিনই কি দেওয়া যায়। রনি মনি বনি খেজুর রস খাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে, কিন্তু কিপটে জমিরের কাছ থেকে তো রস এত সহজে বাগিয়ে নেওয়া যায় না। রনি মনি বনির প্রতিদিনই রস খাওয়া চাই-ই চাই, তা যেভাবেই হোক। ওরা রস চুরি করে খাওয়ার যুক্তি করল। যেই কথা, সেই কাজ। পরদিন ভোরে ওরা উঠে চলে গেল খেজুরগাছের তলায়। গিয়ে দেখে সব হাঁড়ি আগেই পাড়া হয়ে গেছে। চোঙ্গা বেয়ে দু-এক ফোঁটা করে রস নিচে পড়ছে। কী আর করার, ওরা তিনজন তিন গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে চোঙ্গা থেকে পড়া রস হাঁ করে খেল। কিন্তু এভাবে কি আর খাওয়া যায়? সেদিন ওরা হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে এলো। যুক্তি করল আরো সকালে উঠতে হবে তবে যদি রস পাওয়া যায়। ঘুম কি আর এত সহজে ছাড়ে? সেদিনও গিয়ে দেখল যে জমির উদ্দীন আগেই হাঁড়ি পেড়ে ফেলেছে। আগের মতোই চোঙ্গার নিচে দাঁড়িয়ে কয়েক ফোঁটা রস খেয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরল।
এভাবে কয়েকদিন চেষ্টার পর একদিন তারা ঠিকই জমির উদ্দীনের আগে ঘুম থেকে উঠল। চারদিকে ঘন কুয়াশা, ঠান্ডা। এর মধ্যেই কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে দেখে গাছে সবগুলো হাঁড়ি ঠিকঠাক। এই অবস্থা দেখে রনি মনি বনির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সব শীত যেন তাদের মধ্যে থেকে নিমিষেই দূর হয়ে গেল। রনি মনি মিলে বনিকে গাছে উঠিয়ে দিল, কিন্তু সে অর্ধেক উঠেই আর উঠতে পারল না। বনি নেমে এলে রনি বলল দেখি আমি উঠতে পারি কি না। তারপর রনি কষ্ট করেই হাঁড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেল। সেখানে পৌঁছে দেখে আরেক বিপত্তি। হাঁড়ি গাছ থেকে খুলতেই পারল না, খুলতে পারলেও সেখান থেকে হাঁড়ি নামানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। কী আর করার, মন খারাপ করে রনিও নিচে নেমে এলো। নিচে নেমে তিনজনই মন খারাপ করে হাঁড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর চলে যাবে এমন সময় ঘটে গেল এক অদ্ভুদ কাণ্ড। তাদের সামনে শো শো আওয়াজ করে কুয়াশা ঘন হতে লাগল। রনি মনি বনি ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল, চিৎকার করতে চেয়েও পারল না।
কুয়াশা আরো ঘন হয়ে পাখাওয়ালা মানুষের মতো আকৃতি ধারণ করল। কুয়াশা থেকে ভেসে এলো এক সুমিষ্ট কণ্ঠের আওয়াজ- ‘রনি মনি বনি তোমরা ভয় পেয়ো না, আমি তোমাদের বন্ধু হতে চাই।’ এবার রনি মনি বনি একটু অভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল তুমি কে? কুয়াশা বলল, ‘আমি কুয়াশা পরী, সেই দূর সাইবেরিয়া থেকে বেড়াতে এসেছি। তোমাদের রস খেতে না পারার মনঃকষ্ট দেখে আমি আর ঠিক থাকতে পারলাম না। তা ছাড়া এখানে আমার কোনো বন্ধুও নেই, আজ থেকে তোমরাই আমার বন্ধু, বল হবে?’ মনি বলল, বন্ধু হলে কী হবে? কুয়াশা পরী বলল, ‘প্রতিদিনই তোমাদের খেজুরের রস খাওয়াবে, এত কষ্ট করতে হবে না।’ বনি বলল, তবে বন্ধুত্ব পাক্কা। আমরা আজ থেকে তোমার বন্ধু। কুয়াশা পরী বলল, ‘তাহলে দাঁড়াও তোমাদের রস পেড়ে দেই।’ এমন সময় জমির উদ্দীনের কাশির আওয়াজ পাওয়া গেল, মনে হলো রস পাড়তে এদিকেই আসছে। পরী বলল, ‘তোমরা এখন চলে যাও, রাতে অপেক্ষা করো, দশটার সময় তোমাদের জন্য রস নিয়ে আসব।’ এই বলে কুয়াশা পরী কুয়াশার সাথে মিলিয়ে গেল। রনি মনি বনি মনের আনন্দে দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ি চলে গেল।
রাত হলে রনি মনি বনি ওদের শোয়ার ঘরে বসে পরীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। রাত দশটা বাজতেই ঘরে রসের হাঁড়ি হাতে কুয়াশা পরী হাজির। রসের হাঁড়ি দেখে রনি মনি বনি খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। কুয়াশা পরী বলল, ‘জমির উদ্দীনের গাছ থেকে পেড়ে আনলাম, আবার নিয়ে সেখানেই বেঁধে রাখব। তোমাদের ঘরে একটা হাঁড়ি রেখো, আমি ভোরে এসে রস রেখে যাব। তোমরা সকালেই খেতে পারবে।’ রনি মনি বনি তাই করল। কুয়াশা পরী সকালেও অন্য আরেকটা হাঁড়ি পেড়ে এনে অর্ধেক রস রেখে আবার গাছে বেঁধে রাখল। এভাবে জমির উদ্দীনের অগোচরেই কুয়াশা পরী রস এনে রনি মনি বনিকে খাওয়াতে লাগল। এমন বন্ধু পেয়ে রনি মনি বনি এখন খুব খুশি।