মানুষ কেন কাঁদে?
কান্না যেন কী ভীষণ একটা লজ্জার একটা বিষয়! কেউ কাঁদলে পরে তো তা স্বীকারই করতে চায় না। আর অন্যরা তাই নিয়ে যে কী খেপানোটাই না খেপায়। কান্না, কাঁদুনে, ছিঁচকাঁদুনে—এসব নিয়ে যে কত গল্প-লোককাহিনী-ছড়া প্রচলিত আছে, তারও ইয়ত্তা নেই। তবে কান্না কিন্তু একান্তই মানুষের বিশেষ গুণ, অন্য কোনো প্রাণী ঠিক কাঁদতে পারে না। আর মানুষের কান্নার পেছনেও রয়েছে হরেক কারণ-ব্যাখ্যা।
চোখ দিয়ে যখন নোনাপানি ঝরে, তাকেই কান্না বলে। এই কান্না বা চোখের জল আবার তিন রকমের। একটাকে বলে ব্যাসাল টিয়ার্স। এটা আমাদের চোখের একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রতিবার পলক ফেলার সময় চোখের পাতার পেছন থেকে চোখের ওপর এই পানি ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এটা চোখকে ধুলো-বালি থেকে রক্ষা করে। অনেকটা তেল বা লুব্রিকেন্টের মতো।
আরেক রকম পানির নাম দেওয়া হয়েছে রিফ্লেক্স টিয়ার্স। একটানা কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ দিয়ে এই পানি বের হয়। ওটাকে বলে রিফ্লেক্স টিয়ার্স। আমাদের চোখ কোনো কিছু দেখতে দেখতে যখন খুব বিরক্ত বা একঘেয়ে হয়ে যায়, তখন এই পানি বের হয়ে চোখকে রিফ্রেশ করে দেয়। অনেকটা কম্পিউটার রিফ্রেশ করার মতো ব্যাপার আর কী।
আর শেষ রকম চোখের পানির নাম ইমোশনাল টিয়ার্স, যে চোখের পানি নিয়ে আমাদের আলোচনা। এই ইমোশনাল টিয়ার্স কিন্তু শুধুই মানুষের সম্পত্তি। পশু-পাখিরা কিন্তু এই কান্না একদমই কাঁদতে পারে না। তবে অনেক বিজ্ঞানী বলেন, কিছু কিছু প্রাণীও এই কান্না কাঁদে। বিবর্তনবাদের জনক চার্লস ডারউইন তাঁর একটা বইয়ে লিখে গেছেন, ভারতের হাতিরাও নাকি ওদের কেউ মারা গেলে কান্নাকাটি করে। দূর-দূরান্ত থেকে মরা হাতির মৃতদেহ দেখতে যায়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনো এ ব্যাপারে একমত হতে পারেননি। অনেকেরই মত, ওসব মনের দুঃখে কান্না-ফান্না কিছু নয়, ওটা স্রেফ ওদের চোখ পরিষ্কার করার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ব্যাসাল টিয়ার্স আর কী।
এখন এই কান্নার জল, মানে ইমোশনাল টিয়ার্সে খুব বেশি থাকে ম্যাঙ্গানিজ নামে এক ধরনের লবণ আর প্রোল্যাক্টিন নামে এক ধরনের প্রোটিন। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই দুটো পদার্থ শরীর থেকে বের হয়ে গেলে মানুষ অনেকটা আরাম বোধ করে। মানে কারো খুব মন খারাপ, সে খানিকক্ষণ কাঁদল, আর তার সঙ্গে সঙ্গে এগুলো শরীর থেকে বের হয়ে গেল। তখন সে অনেকটাই হালকা বোধ করবে। তার মন খারাপও অনেকটাই কমে যাবে। ওই যে কথায় বলে, কাঁদলে মন হালকা হয়।
তবে কাঁদলে মন হালকা হওয়ার এর চেয়েও বড় কারণটা মানসিক। কেউ যখন কাঁদে, তখন আশপাশের মানুষ সবাই-ই বুঝতে পারে কোনো কারণে তার মন ভালো নেই। হয় মন খারাপ, নয়তো সে ভীষণ হতাশ, কিংবা চরম পরিমাণে দ্বিধান্বিত। আর এই যে তার আশপাশের মানুষের কাছে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারল, এটাই তার মনকে অনেকখানি হালকা করে দেবে।
এ তো গেল শুধু মনের ব্যথার কথা। শারীরিক ব্যথার কথা তো বলাই হয়নি। খুব ব্যথা পেলেও তো মানুষ কাঁদে। ওই যে, ব্যথা পেলে তো সেটা প্রকাশ করতে হবে। আশপাশের মানুষকে বোঝাতে হবে তো।
মোদ্দাকথা, কান্না মোটেও অপরাধ নয় কিংবা লজ্জা পাওয়ার বিষয় নয়; বরং খুবই স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া। মানুষের মন খারাপ হলে বা ব্যথা পেলে কাঁদবে, এটাই স্বাভাবিক। মানুষ বলেই না সে কাঁদতে পারে! পশু-পাখিরা কেবল চেঁচাতে-কোঁকাতে পারে, মোটেই কাঁদতে পারে না।