গল্প
শেয়ালের রাজত্ব
সন্ধ্যা হওয়ার তখনো এক ঘণ্টা বাকি। মধুপুরের গজারির গড়ের ভেতর থেকে হয়তো সূর্যটা দেখাই যাচ্ছে না। সন্ধ্যা নেমে এসেছে বনের ভেতর। বাইরে সন্ধ্যা নামার একটু আগেই সন্ধ্যা নেমে আসে এখানে। এই গড়টি আগে মধুপুরের একটি বিরাট অংশজুড়ে ছিল। মানুষ বন উজাড় করতে করতে এখন প্রায় আগের তিন ভাগের এক ভাগে নামিয়ে এনেছে।
লোকমুখে শোনা যায়, আগে নাকি দিনের বেলাতেও এখানে আবছা আবছা অন্ধকার থাকত। ঝোপঝাড়ে নাকি ভর্তি ছিল ভেতরটা। এখানে থাকত নানা রকমের হিংস্র প্রাণী, যেমন- বাঘ, ভালুক, হরিণ, সজারু, সাপ, শেয়াল ইত্যাদি। তা ছাড়া আরো ছিল সুন্দর সুন্দর সব পাখপাখালি। পাখপাখালির ডাকে বনের সব পশুপাখি জেগে উঠত। তাদের মাঝে ছিল বড়ই সখ্য। পাখপাখালির কলতান বাতাসে ভেসে যেত বহুদূরের লোকালয় পর্যন্ত। আর হিংস্র পশুর ভয়ে তো মানুষ বনের ভেতর যাওয়ার সাহসই ততটা পেত না। কিন্তু এখন বন ছোট হয়ে যাওয়ায় হিংস্র প্রাণী তেমন একটা নেই। তাই মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। ঝোপঝাড় কেটে ফেলছে, ভেতর থেকে কেটে আনছে গাছ। এখন পাখপাখালি আগের মতো তেমনটা নেই। আর তাদের কলতান শুনে ঘুম থেকে জাগার মতোও কেউ নেই। এই বনে এখন প্রাণী বলতে কয়েক ঘর শেয়ালের বাস। বড় সাপ তো নেই, মাঝে মাঝে ছোট সাপ দেখা যায় দু-একটা। জীবনের মায়ায় বাঘ, ভালুক সবাই বন ছেড়ে চলে গেছে অন্য কোথাও। হয়তো যেখানে তাদের চেয়ে হিংস্র ও পোষা- মানুষ নামের অমানুষগুলোর বিচরণ নেই। কিন্তু শেয়াল, এরা আর কী করবে? এই বনের প্রতি এদের মায়া এতটাই বেড়ে গেছে যে, তারা বন থেকে আর যেতে পারল না।
শেয়ালগুলোর বাসা মাটির নিচে। ওপর দিয়ে ঝোপঝাড়ে ভরা। তারা সারাক্ষণ শুধু বনের দুঃখ নিয়ে চিন্তা করে আর কাঁদে। খাবারটাবার আগের মতো তেমনটা জোটে না। আগে তো শান্তিমতো চলাফেরা করতে পারত, আপাতত জীবনের নিরাপত্তা ছিল, এখন তাও নেই। বাইরে বের হলে যদি কোনো মানুষ দেখে ফেলে, তাহলে তো জীবন নিয়ে ফেরা দায়। আবার কোনো কোনো শেয়াল পরিবারে দু-একটা বাচ্চাও আছে। তাই তারা জীবনের মায়া ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়ে খাবার সংগ্রহের জন্য। তবে বনের ভেতর তাদের হালকা একটু নিরাপত্তা আছে। সবার ঘরই মাটির নিচে থাকায় এবং উপরে হালকা ঝোপঝাড় থাকায় বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না যে এখানে গর্ত আছে। সে জন্য তারা একটু রক্ষা পায়। শেয়ালগুলো এত অসুবিধার মধ্যে থাকা সত্ত্বেও কিছু মনে করে না। তারা ভাবে এটাই আমাদের জীবনযুদ্ধ, এ যুদ্ধে এমন কষ্ট করেই টিকে থাকতে হবে, এটাই আমাদের সুখ। কিন্তু এই সুখ কি আর সত্যিকারের সুখ? একদিন দুপুর বেলা, চৈত্র মাস, বাইরে খা খা রোদ, যেন গা পুড়ে যায়। কিন্তু বনের ভেতর ততটা গরম নয়। প্রচণ্ড গরমে গর্তের ভেতর থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই তারা সবাই বাইরে বেরিয়ে এলো। কেউ কেউ ঝোপঝাড়ের নিচে বসে রইল, আবার কেউ কেউ দল বেঁধে গাছের ছায়ায় হাঁটছিল আর পাখির গান শুনছিল। ওদিকে কয়েকজন লোক গাছ কাটছিল, শেয়ালগুলো মনের আনন্দে আর ওসব খেয়াল করেনি। কিন্তু কাঠ চোরগুলো শেয়ালদের ঠিকই দেখছিল। তারা হঠাৎ করে শেয়ালগুলোকে আক্রমণ করে বসল। কী মর্মান্তিক সেই ঘটনা!
মানুষের লোহার অস্ত্র দা, কুঠার এগুলোর সামনে শেয়ালগুলো আর কী। তাই শেয়ালগুলো পালাতে চেষ্টা করল। কেউ কেউ পারল, অনেকে আবার আহত হলো। সবাই দৌড়াতে পারলেও একটি বাচ্চা শেয়াল আর দৌড়াতে পারল না। মানুষগুলো মজা করে কুপিয়ে হত্যা করল শেয়ালছানাটিকে। মজার কথা হলো তাদের একজন দলপতি আছে। সে আহত সবাইকে চিকিৎসার নির্দেশ দিলে এবং মৃত ছানাটিকে দেখতে গেলে। এদিকে চিকিৎসক শেয়ালটি গাছের ছাল-মূল দিয়ে তৈরি ওষুধ দ্বারা আহতদের চিকিৎসা করাতে লাগল। মৃত ছানার বৃদ্ধ বাবা-মা দলপতির কাছে বিচার চাইল তাদের একমাত্র বাচ্চাটি হত্যার। দলপতি বলল, মানুষের অত্যাচার আমরা আর সহ্য করব না। রাতে তোমরা সবাই একত্রিত হবে, আলোচনা সভা করব। দলপতির কথামত জ্যোছনাভরা রাতে সবাই একত্রিত হলো। জোছনার আলো গাছের পাতা ভেদ করে ভেতরে এসে পড়ছিল। তাই ভেতরটাতে সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হলো। দলপতি সবার সামনে বসল। সব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হলো। সবাই মিলে দলপতিকে রাজা উপাধি দিয়ে গজারির পাতা দ্বারা তৈরি মুকুট পরিয়ে দিল। সবাই শপথ করল জীবনের বিনিময়ে হলেও আমরা এই বনকে রক্ষা করব, বনের পশুপাখিদের রক্ষা করব। এভাবে গঠিত হয়ে গেল শেয়ালের রাজত্ব। তারা আইনকানুন গঠন করল। সবার সচেতনতার জন্য রাজা স্কুল তৈরি করলে এবং দুর্নীতি না করে পরীক্ষার মাধ্যমে ভালো শিক্ষক নিয়োগ দিল। শিক্ষক ছাত্রদের শিক্ষা দিতে শুরু করল। শেয়ালদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো- কীভাবে আক্রমণ করতে হবে, কীভাবে পালাতে হবে, ইত্যাদি।
প্রতি রাতেই তাদের ট্রেনিং চলতে থাকল। সবাই হয়ে উঠল দক্ষ, শিক্ষিত এবং সচেতন। রাজার সুযোগ্য নেতৃত্বে সবাই সাহস খুঁজে পেল। রাজা উপলব্ধি করল এখন থেকেই শুরু করা যায় আমাদের বন রক্ষা আর ছোট্ট ছানাটি হত্যার প্রতিশোধ। তার পর থেকে কেউ গাছ কাটতে এলে সবাই আক্রমণ করে তাদের হটিয়ে দিত। কেউ আহত হলে চিকিৎসক তাদের সুস্থ করে তুলত। যেমন সেদিন কাঠচোর কদম আলী বনে গিয়েছিল কাঠ কাটতে। আচমকা তাকে আক্রমণ করে বসল প্রশিক্ষিত শেয়ালের দল, কামড়ে দু-দুই জায়গা থেকে মাংস ছিঁড়ে নিল। কদম আলী কোনোমতে জীবন নিয়ে ফিরে আসে সেদিন। এভাবে শেয়ালগুলো বনকে রক্ষা করে চলল।
মানুষ ভয়ে এখন আবার বনে আসা বন্ধ করে দিল। যে কাজ মানুষের, মানুষের অবহেলায় সেই কাজ হাতে নিয়েছে শেয়ালগুলো। তাদের তো খাবারেরও প্রয়োজন আছে। যে শেয়ালছানাটি নিহত হয়েছে তার খুনিদের অনেকে চিনতে পেরেছে। তাই তারা ঠিক করল তাদের বাড়ি থেকে একে একে হাঁস, মুরগি, ছাগল, যা পাওয়া যায় ধড়ে আনা হবে। প্রথমে তারা হামলা চালাল কাঠ চোর করিম শাহ বাড়িতে। তার পোলট্রি ফার্মের সব মুরগি নিয়ে এলো সবার অগোচরে। সকালে উঠে বাড়ির মানুষ দেখল একটি মুরগিও নেই। করিম শাহর বউ তাকে গাল দিয়ে বলল তুমি যেমন কাঠ চুরি কর, তেমনি হয়তো কোনো দক্ষ মুরগি চোর মুরগিগুলো চুরি করে নিয়ে গেছে। এভাবে কাঠচোরদের বাড়ি থেকে মুরগি ধরে এনে মজা করে খেতে লাগল শেয়ালগুলো।
এদিকে মানুষগুলো পড়ে গেল মহাচিন্তায়। একদিকে তারা বনে যেতে পারছে না অন্যদিকে হাঁস, মুরগি সব সাবাড় হয়ে যাচ্ছে। তাই তারা চোর ধরার জন্য মিটিং করল। এভাবে দেখতে দেখতে বর্ষা চলে এলো। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে টইটম্বুর হয়ে গেল চারদিক। গর্তে পানি যাওয়ায় শেয়ালগুলো ওপরে উঠে এলো। খাবার শেষ হয়ে যাওয়ায় আরেকদিন হামলা চালাল আরেক বাড়িতে। সব মুরগি ধরে এনে মনের আনন্দে ভোজ করতে লাগল। মাটি ভেজা থাকায় শেয়ালের পায়ের ছাপ পড়ে রয়েছে ওই বাড়িতে। পা পিছলে একটি শেয়াল অগাধ পানিতে পড়ে গিয়েছিল। আর উঠতে পারেনি, সেখানেই মারা গেছে।
এত সব দেখে মানুষগুলো বুঝল যে এসব শেয়ালদেরই কাজ। তাই তারা সন্ধ্যার সময় সবাই মিলে লাঠি, দা নিয়ে সমগ্র বন ঘেরাও করে ফেলল। এদিকে শেয়ালগুলো মজা করে খাচ্ছিল। তারা ভাবতেই পারেনি এই মুহূর্তে তাদের ওপর আক্রমণ হতে পারে। সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় মানুষের আক্রমণের প্রতিরোধ না গড়তে পেরে তারা দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করল। দু-একটি পালাতে পারলেও বেশির ভাগ শেয়ালই মারা গেল। ধ্বংস হয়ে গেল শেয়ালের রাজত্ব।
মানুষ আবার নির্ভয়ে বনে আসা শুরু করল, গাছ কাটতে শুরু করল। বন আবার উজাড় হতে লাগল। যে দু-একটা শেয়াল পালাতে পেরেছিল তারা মনের দুঃখে বলতে লাগল, বনটাকে আর রক্ষা করা গেল না।