চার্লির জন্মদিন
চ্যাপলিনের ‘দ্য কিড’
তখন চার্লির বয়স পাঁচ বছর। স্টেজে প্রতিদিনের মতো উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে চার্লি, আর স্টেজে গান গাইছেন মা। হঠাৎ মায়ের গলা ভেঙে গেল। বহুদিন ধরেই তিনি অসুস্থ ছিলেন, এদিন গান আর গাইতে পারছেন না তিনি। ওদিকে, দর্শকরা খুব হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে। স্টেজ ম্যানেজার অবস্থা বেগতিক দেখে মঞ্চে উঠিয়ে দিলেন শিশু চার্লিকে। লোকজন বাচ্চা একটা ছেলেকে দেখে হাসাহাসি শুরু করল। প্রথম মঞ্চে উঠেছে বেচারা চার্লি। কী করবে ভেবে না পেয়ে খুব পরিচিত একটি গান ধরল সে। চার্লির গলাটা ছিল বেশ মিষ্টি। দর্শকরা বাচ্চা ছেলের কণ্ঠে পরিচিত একটি গান শুনে বেশ মজা পেয়ে গেল। হাসাহাসি বন্ধ করে তারা শুনতে থাকে চার্লির গান। আর এভাবেই ছোট্ট বয়সে প্রথম সাফল্য পান চার্লি।
বড় হয়ে চ্যাপলিন প্রথমে শুরু করলেন মঞ্চে অভিনয়, এরপর চলচ্চিত্রে অভিনয় এবং সবশেষে চলচ্চিত্র নির্মাণ। চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন, সংক্ষেপে যাকে ডাকা হয় চার্লি বলে, তাঁর নাম শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক দরিদ্র লোক যার মাথায় কালো বৌলার বা বব হ্যাট, চঞ্চল দুটি চোখ, ছোট্ট করে ছাটা কালো গোঁফ, গায়ে তালি দেয়া স্যুট আর পায়ে বেঢপ মাপের কালো জুতো। এই চেহারাতে চ্যাপলিনকে আমরা অনেকবার দেখেছি চলচ্চিত্রে। বড়পর্দায় গরিব ট্রাম্পের ভূমিকায় অভিনয় করা চ্যাপলিন বাস্তবেই ছোটবেলায় ছিলেন দরিদ্র। বড় হয়ে তিনি কিন্তু সেটা ভুলে যাননি। সেজন্যই তো কষ্টে থাকা মানুষের জীবন নিয়ে তিনি বানিয়েছেন মর্মস্পর্শী সব ছবি।
১৯২১ সালে এমনি এক ছবির কাজ শেষ করেন চ্যাপলিন। ছবির নাম ‘দ্য কিড’। এতে কোনো সংলাপ নেই। ছেলেবেলায় বস্তির যে দুঃসহ অবস্থা দেখেছেন তারই কিছু খণ্ডচিত্র চার্লি তুলে এনেছেন এই নির্বাক ছবিতে। এটি ছিল চার্লির প্রথম পরিচালিত ছবি। শুধু পরিচালনা নয়, ছবির গল্পটিও লিখেছেন তিনি। তো কী আছে সেই গল্পে?
এক গরিব নারী, কোলে শিশু নিয়ে বেরিয়ে এলেন হাসপাতাল থেকে। গীর্জার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি দেখলেন একটা সুন্দর সাজানো গাড়ি থেকে বর-কনে নেমে গীর্জায় ঢুকল। বিয়ের অনুষ্ঠান। তখন সেই নারী চুপিচুপি কোলের শিশুকে গাড়ির পেছনে রেখে পালালেন। হয় তো ভেবেছেন- তিনি গরিব, বাচ্চাটাকে কী খাওয়াবে, কোথায় রাখবে! নতুন বর-কণের কাছে শিশুটি ভালো পরিবেশ পাবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই একদল চোর এসে গাড়িটি চুরি করে পালিয়ে যায়। গাড়ির ভেতর যে শিশু রয়েছে সেটা চোরেরা খেয়াল করেনি।
কিছু দূর যাওয়ার পর গাড়ির পেছন থেকে শিশুটি কেঁদে উঠল। ঘাবড়ে যায় চোরের দল। এই শিশু নিয়ে কী করবে তারা? এ তো মহা বিপদ! উপায় তারা একটা বের করল। শিশুটিকে ডাস্টবিনে ফেলে রেখে চম্পট দেয় চোরেরা। ওই ডাস্টবিনের পাশের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল আমাদের চার্লি চ্যাপলিন। আচমকা তার ওপর একগাদা ময়লা আবর্জনা এসে পড়ল। পাশের ভবন থেকে ফেলা হয়েছে। মন খারাপ করে চার্লি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। এরপর অভিযোগ জানাতে লাগল, ঠিক তখনই তার চোখে পড়ল- একটা শিশু। মায়া লাগল চার্লির। কোলে তুলে নিল সে। কিন্তু এই দুধের শিশু নিয়ে সে কোথায় রাখবে? সে তো নিজেই ভবঘুরে, থাকার জায়গা নেই, খাওয়াও জোটে না ঠিকঠাক। তাহলে এই শিশুটিকে রাখবে কোথায়, আর খাওয়াবেই বা কী? কাজেই যেখান থেকে একে পেয়েছে সেখানেই রেখে যাওয়া ভালো। বিধি বাম। কারণ পুলিশ দেখে ফেলে, চার্লি একটা বাচ্চা ফেলে দিচ্ছে। ডাস্টবিনে বাচ্চা ফেলার জন্য পুলিশ তাকে দিল ধমক। পুলিশের ভয়ে বাচ্চাটাকে নিজের কাছেই রাখতে হলো। শেষমেশ আর কি করা, বাচ্চাটাকে নিয়ে এলো নিজের ভাঙাচোরা ডেরায়। অনেক কষ্ট করে বড় করল শিশুটিকে।
পাঁচ পাঁচটি বছর কেটে গেল। চার্লি নিজে দিন আনে দিন খায়। এমন অবস্থায় একদিন ছেলেটিকে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল জীবিকার খোঁজে। কিন্তু কাজ পাওয়া কি হাতের মোয়া? দুজনে মিলে একটা বুদ্ধি বের করল। ছেলেটি লুকিয়ে ঢিল ছুঁড়ে বড় লোকদের জানালার কাঁচ ভেঙে দেবে, আর চার্লি সেখানে নতুন কাঁচ লাগিয়ে দেবে, বিনিময়ে পয়সা পাবে। দারুণ বুদ্ধি! তবে কারসাজিটা পুলিশের নজরে পড়ে গেল, বন্ধ হয়ে গেল রোজগারের পথ।
এদিকে, ছেলেটির মা ততদিনে বেশ বিখ্যাত গায়িকা হয়ে গেছেন। এখন তার প্রচুর অর্থকড়ি। তবু তার মন কাঁদে- ফেলে দেওয়া শিশুটির জন্য। মনের দুঃখ কমাতে আর ভুলের প্রায়শ্চিত্য করতে গায়িকা বস্তিতে বস্তিতে শিশুদের জন্য কাজ শুরু করলেন।
একদিন চার্লির ছেলেটি বস্তির আরেক ছেলের সঙ্গে মারামারি করতে গিয়ে জখম হলো। ঘটনাক্রমে গায়িকা তখন ওই বস্তিতেই ছিলেন। তিনি আহত ছেলেকে চার্লির কাছে নিয়ে এলেন। ডেকে আনলেন চিকিৎসক। চিকিৎসক এসেই টের পেলেন ছেলেটি আসলে চার্লির নয়। তিনি খবর দিলেন পুলিশকে। পুলিশ জানাল অনাথ আশ্রমকে। আশ্রমের লোকজন এলো ছেলেটিকে নিয়ে যেতে। দীর্ঘ পাঁচ বছর যে শিশুকে যত্ন করে বড় করেছে সে কেন এখন ছেলেটিকে দিয়ে দেবে? চার্লি কিছুতেই ছেলেটিকে দেবে না। ছেলেটিও চার্লিকে ছেড়ে যাবে না। অনেকক্ষণ দৌড়াদৌড়ির পর চার্লি আর ছেলেটি আশ্রয় নিল একটি ছোট সরাইখানায়।
ছেলেটির মা গীর্জার সামনে তাকে ফেলে আসার সময় গলায় একটা চিরকুট বেঁধে দিয়েছিলেন। চিকিৎসক সেই চিরকুট চুরি করলেন চার্লির ডেরা থেকে। এরপর তিনি তা দিলেন গায়িকার হাতে। চিরকুটে নিজের হাতের লেখা দেখে গায়িকা বুঝলেন, এটাই তার ফেলে দেওয়া মানিক। যার জন্য বুক ভাসিয়ে তিনি কাঁদেন। ছেলের একটা খোঁজ যখন পাওয়া গেছে তখন তাকে কাছে পাওয়া যাবেই। গায়িকা ঘোষণা করলেন, যে ছেলেটিকে এনে দেবে তাকে দেওয়া হবে মোটা অঙ্কের পুরস্কার। বিজ্ঞাপনটি চোখে পড়ল সরাইখানার মালিকের। তিনি আলগোছে, চার্লি যখন ঘুমিয়ে ছিল, তখন ছেলেটিকে কাপড়ে পেচিয়ে নিয়ে গেল পুলিশের কাছে। পুলিশ ছেলেকে তুলে দিল মায়ের হাতে।
অন্যদিকে, ঘুম থেকে উঠে চার্লি দেখে ছেলেটি নেই। মাথা খারাপ হয়ে গেল তার। এখানে খোঁজে, সেখানে খোঁজে। নেই, কোথাও নেই। শেষতক সে ফিরে আসে বস্তিতে। সারাদিন খোঁজাখুঁজির পর ক্লান্ত চার্লি নিজের ডেরার দরজার সামনেই বসে থাকে। একসময় বসে থেকেই সে ঘুমিয়ে যায়। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। চার্লি দেখল এই বস্তিটা আর নোংরা নেই। সেখানে স্বর্গের মতো সৌন্দর্য সবদিকে। সবাই দেবদূতের পোশাক পরে উড়ছে। একসময় ছেলেটি এসে দাঁড়াল চার্লির সামনে। হঠাৎ স্বর্গে ভীষণ হট্টগোল শুরু হলো। সেই শব্দে ঘুম ভেঙে গেল চার্লির। সে দেখলো সামনে পুলিশ দাঁড়িয়ে। চার্লিকে পুলিশ ভ্যানে উঠিয়ে নেওয়া হলো। সেটি থামল আলিসান এক ভবনের সামনে এসে। গাড়ি থেকে নামতেই চার্লি দেখল ছেলেটিকে। ছেলেটি তখন মায়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। চারদিকে শুধু আনন্দ। আনন্দ তো হবেই, হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে খুঁজে পেয়েছেন মা, ছেলেও ফিরে পেয়েছে মাকে।
এই হচ্ছে ‘দ্য কিড’ ছবির গল্প। খুব জনপ্রিয় হয়েছিলো ছবিটি। এখনো ছবিটিকে ভালোবাসে চলচ্চিত্রপ্রেমীরা। এ রকম আরো বহু ছবিতে চ্যাপলিন আমাদের জানিয়েছেন সমাজের হতভাগ্য মানুষের কথা। যে মানুষগুলো দুবেলা ভালো করে খেতে পায় না, রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁই পায় না, বেঁচে থাকার জন্য যাদের প্রতিদিনই লড়াই করতে হয়, পুলিশের নির্যাতনের শিকার হতে হয়- তেমন মানুষের চরিত্রেই অভিনয় করেছেন চার্লি- এক হতভাগা গরিব ভবঘুরের চরিত্র। দর্শকদের তিনি যেমন হাসাতে হাসাতে গড়াগড়ি খাওয়াতে পারতেন, তেমনি পারতেন চোখের কোনে জমিয়ে দিতে অশ্রু। এজন্যই চার্লি চ্যাপলিন আজও অদ্বিতীয়।