কীভাবে এলো পেন্সিল?
প্রথম পেন্সিল কে আবিষ্কার করেন, সেটা তো জানা যায়-ই না, এমনকি প্রথম কারা পেন্সিল আবিষ্কার করেন, সেটা নিয়েও আছে ধোঁয়াশা। তবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত, প্রথম পেন্সিল ব্যবহার করে রোমানরা। তবে ওই রোমানদের পেন্সিল এখনকার প্রচলিত পেন্সিলের মতো ছিল না মোটেই। রং করতে যে রকম তুলি ব্যবহার করা হয়, রোমানরা সে রকম এক ধরনের পেন্সিল ব্যবহার করত প্যাপিরাসে লেখালেখির জন্য।
প্যাপিরাসকে সে সময়কার কাগজ বলা যায়। প্যাপিরাস নামক গাছের বাকল শুকিয়ে তাতে রোমানরা লেখালেখি করত। তাই ওই কাগজ-ধরনের জিনিসটার নামও হয়ে গিয়েছিল প্যাপিরাস। আর পেন্সিল নামটা এসেছে লাতিন শব্দ ‘পেনিসিলিয়াস’ থেকে। পেনিসিলিয়াস মানেই হচ্ছে ছোট্ট লেজ।
তাহলে এখনকার যে পেন্সিল, সেটা কীভাবে এলো? এই গল্পের শুরুটাও অনেক দিন আগের কথা। ১৫৬৫ সালের কিছু আগে, অনেকে আরো পিছিয়ে বলে প্রায় ১৫০০ সালের দিকে, ইংল্যান্ডের বোরোডেল নামে এক জায়গায় গ্রাফাইটের একটা বিশাল খনি পাওয়া যায়। আর সেই গ্রাফাইটগুলোও ছিল যাকে বলে একদম খাঁটি গ্রাফাইট। সেই খনি-আবিষ্কার থেকেই আধুনিক পেন্সিলের ইতিহাসের শুরু।
তো, গ্রাফাইট আবিষ্কার হলো বটে, কিন্তু মানুষ তো তখনো জানে না গ্রাফাইট দিয়ে কী করা যায়! তারা দেখল, এই জিনিস দিয়ে খুব সুন্দর দাগ দেওয়া যায়। তারা জাহাজে চিহ্ন দেওয়ার জন্য গ্রাফাইটের ব্যবহার করতে লাগল। এভাবেই গ্রাফাইট দিয়ে লেখালেখি আরম্ভ হলো। এখনো পেন্সিলের যে শিস থাকে, সেটাই গ্রাফাইট।
কিছুদিনের মধ্যেই গ্রাফাইটের আরো একটা ব্যবহার আবিষ্কৃত হলো। সে আবিষ্কার আবার বেশ শক্তিশালীও। দেখা গেল, কামানের গোলায় গ্রাফাইট ব্যবহার করলে বেশ কাজে দেয়। এবার গ্রাফাইট বেশ দরকারি হয়ে উঠল। তখন কামানই ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর মারণাস্ত্র। সুতরাং গ্রাফাইটের খনি সরাসরি ব্রিটেনের রাজার অধীনে চলে গেল। আর প্রয়োজনীয় গ্রাফাইট মজুদ করে খনিতে কৃত্রিমভাবে বন্যার সৃষ্টি করা হলো, যাতে কেউ গ্রাফাইট চুরি করে কামানের গোলা বানাতে না পারে।
তদ্দিনে ইংল্যান্ডে পেন্সিল হিসেবে গ্রাফাইটের ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। খনি থেকে গ্রাফাইট বের করে কেটে কেটে সেগুলো পেন্সিল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু পৃথিবীর অন্য কোথাও আর ও রকম খাঁটি গ্রাফাইটের খনি পাওয়া গেল না। যে কয়েকটা গ্রাফাইটের খনি পাওয়া গেল, সব কটিতেই গ্রাফাইটের সঙ্গে অন্য কোনো না কোনো ধাতু মিশে থাকে। তখন গ্রাফাইটকে আলাদা করতে গেলে আগে গুঁড়া করতে হয়। সেই গুঁড়া কামানের গোলায় ব্যবহার করা যায় বটে, কিন্তু পেন্সিল হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। সুতরাং, পেন্সিলের ওপর ব্রিটিশদের একচ্ছত্র আধিপত্য থেকেই গেল।
প্রথম গ্রাফাইটের গুঁড়াকে আবার কঠিন গ্রাফাইটে রূপান্তরিত করে পেন্সিল বানানো শুরু হয় জার্মানির ন্যুরেমবার্গে। তবে সেই পেন্সিল ব্রিটিশদের পেন্সিলের মতো অত ভালো ছিল না। পরে আস্তে আস্তে গ্রাফাইটের গুঁড়াকে সুন্দর করে কঠিন গ্রাফাইটে রূপান্তরিত করার কৌশলও বের করে ফেলে মানুষ।
আর এখনকার পেন্সিলে তো গ্রাফাইটের শিসটা কাঠ দিয়ে মোড়ানো থাকে। পেন্সিলের শিসকে এভাবে কাঠ দিয়ে মোড়ানোর কৃতিত্ব এক ইতালিয়ান দম্পতির। নাম তাঁদের সিমোনিয়ো বার্নাকোত্তি আর লিন্দিয়ানা বার্নাকোত্তি। তাঁরা একটা কাঠের মাঝে গর্ত খুঁড়ে তাতে গ্রাফাইটের শিস ঢুকিয়ে দিতেন। তবে কিছুদিনের মধ্যেই এর চেয়ে ভালো বুদ্ধি বের হয়ে গেল। কাঠের টুকরোকে দুই ভাগ করে দুই টুকরোতেই গর্ত করা হলো। তার পর মাঝখানে গ্রাফাইটের শিস ভরে আঠা দিয়ে টুকরো দুটো লাগিয়ে দিলেই হলো। হয়ে গেল সুন্দর একটা পেন্সিল। এখনো পেন্সিল এভাবেই বানানো হয়।
পরে পেন্সিলের আরেকটা বড় পরিবর্তন ঘটল। পেন্সিলের শেষ মাথায় রাবার জুড়ে দেওয়া হলো। আর এ রকম পেন্সিলের নকশা করে তার পেটেন্ট করিয়ে নিলেন হেইমেন লিপম্যান নামের এক ভদ্রলোক। পরে তিনি জোসেফ রেকেনডরফার নামের আরেক ভদ্রলোকের কাছে বেশ চড়া দামে সেই পেটেন্ট বিক্রি করে দিলেন। বিখ্যাত পেন্সিল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফেবার-ক্যাসলের সঙ্গে এই পেটেন্ট নিয়ে একসময় খিটিমিটি লেগে যায় জোসেফের। শেষমেশ আদালতের রায়ে অবৈধ ঘোষিত হয় তাঁর সেই পেটেন্ট। অর্থাৎ, এখন যে কেউ রাবারওয়ালা পেন্সিল বানাতে পারে।