ভয়াল সব মানুষখেকো
মানুষ খাওয়াটা ঠিক বন্য প্রাণীদের স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে পড়ে না। তবে ব্যতিক্রম তো থাকেই। শিকারির গুলিতে আহত হয়ে কিংবা দুর্ঘটনাবশত স্বাভাবিক শিকারের ক্ষমতা হারিয়ে অনেক বন্য প্রাণীই মানুষের মাংসে আসক্ত হয়ে পড়ে, সৃষ্টি করে ত্রাসের রাজত্ব।
লিস্টভার্স ডট কমের সৌজন্যে পাওয়া গেল এমনই কিছু বন্য প্রাণীর তালিকা, যারা মানুষ মারার দৌরাত্মে রীতিমতো কিংবদন্তির গল্পগাথায় স্থান পেয়েছে।
এনজম্বের সিংহ
সিংহরা দল বেঁধে শিকার করে। একেকটি দলকে বলা হয় ‘প্রাইড’। ১৯৩২ সালে আফ্রিকার তাঞ্জানিয়ার এনজম্বে শহরের কাছে এমনই একটি ‘প্রাইড’ কুখ্যাত হয়ে ওঠে তাদের মানুষ মারার নেশার কারণে। সরকারি হিসেবে প্রায় দেড় হাজার মানুষ এই সিংহদের কবলে প্রাণ হারায়, যদিও কেউ কেউ সংখ্যাটা দুই হাজার বলে ধারণা করেন।
স্থানীয়রা ধারণা করত, মাতামুলা মাঙ্গেরা নামের এক স্থানীয় কবিরাজকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার কারণেই তিনি জাদুমন্ত্রবলে ওই সব সিংহকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন। সিংহদের দলটি এমনই ত্রাস সৃষ্টি করেছিল যে মানুষেরা ওদের নামও মুখে আনতে সাহস করত না, পাছে তারা কোনো ক্ষতি করে বসে। শেষমেশ জর্জ রুশবি নামের এক বিখ্যাত শিকারি সিংহদের এই অত্যাচারের অবসান ঘটান। তিনি প্রাইডের প্রায় ১৫টি সিংহ শিকার করলে বাদবাকি সিংহগুলো ওই অঞ্চল ছেড়ে চলে যায়।
দুই আঙুলে টম
বিদ্ঘুটে এই কুমিরের বাস ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা আর ফ্লোরিডার মধ্যবর্তী জলায়। এই অদ্ভুত নামকরণের মর্মার্থ হলো, টমের সামনের বাম পায়ে মাত্র দুটি আঙুল ছিল। দুই আঙুলে টমের শিকার তালিকায় ছিল সবকিছুই- গরু, ভেড়া থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত। বিশেষ করে মহিলাদের ওপর সে ছিল বেজায় খাপ্পা।
১৯২০ সালের দিকে দুই আঙুলে টমের আক্রমণে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়। প্রায় ১৪ ফুট লম্বা এই কুমিরটিকে কেউ শেষ পর্যন্ত মারতে পারেনি। এমনকি বিশ্বাস করা হয় ১৯৮০-এর দশকেও দুই আঙুলে টম দিব্যি বহাল তবিয়তে বেঁচে ছিল।
মহীশূরের স্লথ ভালুক
মোগলির বালুকে দেখে ভালুককে দুধে ধোয়া তুলসিপাতা ভাবলে ভুল হবে। আক্রান্ত হলে ঢিলেঢালা এই জানোয়ারটি হয়ে ওঠে ভয়ংকর। ভালুকের আক্রমণের ধরনটি বড়ই বিদঘুটে। সাধারণত এরা মানুষ খায় না, তবে ক্ষেপে গেলে আঁচড়ে, কামড়ে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়।
ভারতের মহীশূরের শ্লথ ভালুক ছিল ব্যতিক্রম। সে শুধু মানুষই মারত না, পরে খেয়েও ফেলত। ধারণা করা হয় ভালুকটির বাচ্চাকে কোনো এক শিকারি মেরে ফেলার পর পরই সে মানুষখেকো হয়ে ওঠে। শেষমেশ বিখ্যাত শিকারি কেনেথ অ্যান্ডারসনের গুলিতে প্রাণ হারায় এই ভালুক।
সাভোর সিংহ
১৮৯৮ সালে তখনকার ব্রিটিশ কলোনি কেনিয়ায় সাভো নদীর ওপরে এক রেলসেতু নির্মাণের সময় দেখা দেয় এক বিপত্তি। এক জোড়া বিশালকার সিংহ হামলা চালাতে থাকে কুলি-মজুরদের ওপর। পুরুষ সিংহদের সাধারণত কেশর থাকে। কিন্তু সাভোর এই সিংহ দুটি পুরুষ হলেও তাদের কোনো কেশর ছিল না। স্থানীয়রা বিশ্বাস করত ওই অঞ্চলের প্রাচীন রাজারা সিংহের রূপ ধরে ব্রিটিশদের তাড়ানোর জন্য এই তাণ্ডব শুরু করেছেন। প্রায় ১৪০ জন মানুষ এই সিংহদের আক্রমণে প্রাণ হারায়। পরে হেনরি প্যাটারসন নামের এক ইংরেজ শিকারির গুলিতে সিংহ দুটি মারা যায়। বর্তমানে শিকাগোর একটি জাদুঘরে এদের মরদেহ সংরক্ষিত আছে। কেনীয় কর্তৃপক্ষ সাভোতে এই সিংহদের স্মরণে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে ‘ঘোস্ট অ্যান্ড দ্য ডার্কনেস’ নামের একটি চলচ্চিত্রও বানানো হয়েছিল এই সিংহ দুটির কাহিনীকে উপজীব্য করে।
পানারের মানুষখেকো
চাতুর্য আর হিংস্রতার কারণে চিতাবাঘের সুনাম আছে। যদিও এরা সচরাচর মানুষ মারে না, কিন্তু একবার মানুষখেকো হয়ে গেলে এদের সামলানো খুবই কঠিন। এ রকম একটি উদাহরণ হলো পানারের মানুষখেকো চিতাবাঘ। ভারতের কুমায়ুন জেলার পানার গ্রামের কাছাকাছি এই চিতাবাঘের মানুষ মারা শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে।
কমবেশি ৪০০ মানুষ এর পেটে যায়। পরবর্তীকালে বিখ্যাত শিকারি জিম করবেটের গুলিতে ১৯১০ সালে পানারের ত্রাস প্রাণ হারায়। তবে তা হলে কী হবে, সংখ্যার দিক থেকে মানুষ হত্যায় এখনো পানারের চিতাবাঘকে অন্য কোনো চিতাবাঘ ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।
চম্পাবতের বাঘিনী
চম্পাবতের বাঘিনীর পেটে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ৪৩৬। যদিও আসল সংখ্যাটা আরো বেশি বলে ধরা হয়। তার মানুষখেকো জীবনের শুরু হয় নেপালে। দুই শতাধিক মানুষ মারার পর নেপালি সেনাবাহিনীর জওয়ানদের তাড়া খেয়ে সে ভারতে আসে। এখানে এসেও মানুষ মারায় কোনো খামতি দেয়নি ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর এই বাঘ। দিনে-রাতে সব সময় বেমক্কা হামলা চালিয়ে পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষদের একরকম গৃহবন্দি করে ফেলে সে।
অবশেষে জিম করবেটের গুলিতে ১৯১১ সালে প্রাণ হারায় এই বাঘিনী। স্থানীয় মানুষ এই ঘটনায় এতই খুশি হয়েছিল যে তারা করবেটকে রীতিমতো সাধু বলে সম্মান দেখানো শুরু করে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো সিরিয়াল কিলারও চম্পাবতের বাঘিনীর মতো এত মানুষ হত্যা করেনি।
গুস্তাভ
৩০০ মানুষের প্রাণ হরণকারী ‘গুস্তাভ’ নামের এই কুমিরের প্রথম দেখা মেলে আফ্রিকার দেশ বুরুন্ডিতে। গুস্তাভের আকৃতিটি প্রকাণ্ড, প্রায় ২৫ ফুট লম্বা আর ওজন এক টন। প্যাট্রিস ফে নামের এক ফরাসি প্রকৃতিবিদ এই নামকরণ করেন। ফে গুস্তাভকে অনেক শিকারিই জীবন্ত ধরার প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু তাকে কখনই ধরা যায়নি। গুস্তাভ খুব সম্ভবত একমাত্র মানুষখেকো যার জীবন্ত ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে। ধারণা করা হয়, কুমিরটির বয়স প্রায় ৬০ বছর। গুস্তাভের খাদ্যতালিকায় আছে মোষ, গরু, মানুষ এমনকি জলহস্তী পর্যন্ত।
এখন পর্যন্ত গুলি করে ফাঁদ পেতে অনেকবারই গুস্তাভকে মারার চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু চতুর কুমিরটি সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ করে দিয়ে দিব্যি বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। শেষবারের মতো গুস্তাভকে দেখা যায় ২০১৫ সালের জুনে। ২০০৭ সালে ‘গুস্তাভ’ নাম দিয়ে একটি সিনেমা বানানো হয় এই কুমিরকে ভিত্তি করে।