ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে ওঠা এক শহর
ক্ষমতা সুন্দর একটি প্রক্রিয়া যদি সেটা মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়। আর ক্ষমতা তখনই অসুন্দর হয় যখন সেটার অপব্যবহার করা হয়। মানুষের ভেতর ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রবণতা সেই আদিকাল থেকে চলে আসছে। ক্ষমতার লড়াইয়ে কেউ পিছিয়ে থাকতে চায় না। যে যেভাবে পারে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চায়। প্রযোজনে হিংস্র হতেও আপত্তি নেই। এই হিংস্রতা কখনো কখনো তাদের সৃষ্টিছাড়া ভয়ংকর করে তোলে। ইদানীং পৃথিবীর শক্তিশালী দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তারা কী কী করছে! দেশ ধ্বংস করছে। মানুষ মারছে। শক্তিশালী দেশগুলো মূলত অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই বীভৎস হামলা চালিয়ে নিজেদের ক্ষমতার জানান দেয়। আবার কখনো রাজায় রাজায় দ্বন্দ্বে বলির পাঠা হয় সাধারণ মানুষ। আজ থেকে ঠিক সত্তর বছর আগে এমনই এক ঘটনা ঘটেছিল জাপানের হিরোশিমা নগরীতে। একটি মাত্র বোমার আঘাতে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছিল নগরীটি। থমকে গিয়েছিল পুরো বিশ্ব। লাশের গন্ধে ভারি হয়ে উঠেছিল বাতাস। সেদিন কি ঘটেছিল সেটা জানতে হলে আমাদের আলতো করে চোখ বুজতে হবে। চলে যেতে হবে অতীতে। ফ্ল্যাশব্যাকে। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট ঘুম থেকে ওঠা স্নিগ্ধ সকালের কথা মনে করতে হবে।
হিরোশিমায় তখন সবেমাত্র সকাল হয়েছে। ঘড়িতে তখন প্রায় ৮টা বেজে ১৫ মিনিট। হিরোশিমার মানুষ সকালের স্নিগ্ধতায় নিজেকে সপে দেওয়ায় ব্যস্ত। ঠিক সেই সময় ঘটল ইতিহাসের ভয়ংকরতম ন্যক্কারজনক ঘটনা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের পূর্ব নির্ধারিত আদেশ অনুযায়ী বোমারু বিমান ‘এনোলা গে’তে করে বয়ে আনা আনবিক বোমা ‘লিটল বয়’ নিক্ষেপ করা হয় হিরোশিমার ভূমিতে। বিমানটির পাইলটের গুরুদায়িত্ব পালন করেন কর্নেল পল ওয়ার ফিল্ড টিবেটস। তিনিয়ান দ্বীপ হতে রাত ২টা ৩০ মিনিটে রওয়ানা দিয়ে এক হাজার ৭০০ মাইল পথ অতিক্রম করে হিরোশিমার আকাশে পৌঁছায় বিমানটি।
এখানে বলে রাখা ভালো, হামলা শুরুর আগের দিন ৫ আগস্ট মেজর জেমস আবি হপকিং হিরোশিমা আক্রমণের নির্দেশনায় স্বাক্ষর করার পর চূড়ান্ত হয় মিশন। এদিকে হামলার কিছু সময় আগে হিরোশিমায় পর পর তিনবার সতর্ক সাইরেন বেজে ওঠে। আতঙ্কিত হিরোশিমাবাসী আকাশে তাকিয়ে কয়েকটি বিমানকে চক্কর দিতে দেখে। স্থানীয় সময় তখন আনুমানিক সকাল ৭.০০ টা। কিছু সময় পর বিমানগুলো চলে গেলে হিরোশিমার সাধারণ জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বাজানো হয় বিপদমুক্ত সাইরেন। তারপর যে তাদের সামনে আবারো বিপদ এসে হাজির হবে তা তারা আঁচ করতে পারেনি। আর সে কারণে পরে যখন আরো তিনটি বিমান আকাশে চক্কর দেয় তখন তারা সেটা আমলে নেয়নি। বাজানো হয়নি সতর্ক সাইরেন। তারপর বিশ্ববাসী দেখল ইতিহাসের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। মুহূর্তেই পুড়ে ছারখার হয়ে যায় নগরীটি। স্নিগ্ধ কোমল সকাল পরিণত হলো ধ্বংস্তূপে। মার্কিন এই হামলা বিশ্ববাসীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ক্ষমতার লড়াই কতটা ভয়াবহ হতে পারে।
বোমা হামলার জন্য জাপানের তিনটি নগরীকে নির্বাচিত করা হয়। নগরী তিনটি হলো কোকুরা, নাগাসাকি ও হিরোশিমা। হিরোশিমায় হামলা চালানোর পিছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। হিরোশিমা শহরটি তখন শিল্প ও সামরিক দিক থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তা ছাড়া শহরের খুব কাছেই ছিল সেনা ছাউনি এবং পঞ্চ ডিভিশনের প্রধান কার্যালয়।
আমরা এখনো চোখ বুজে আছি। চোখ খোলার সময় হয়নি। হিরোশিমার অতীতে আরো কিছু সময় থাকতে হবে। এবার হামলায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে আলোচনার দিকে নজর দিতে হবে। মৃত্যুর হিংস্রতার কথা ভাবতেই চোখের কোনে দু’ফোটা জল এসে ভিড় করতে পারে। আপাতত সেটাকে প্রশ্রয় না দিয়ে ভাবনার দিকে মন দেওয়া যাক।
উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত ঘেটে জানা যায় হামলার বছরের শেষ নাগাদ প্রায় ৬০ হাজারেরর মতো মানুষ মারা যায়। আনবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তা, পুড়ে যাওয়া এবং আহত হওয়ার কারণে তাদের মৃত্যু হয়। পারমাণবিক বোমার এই তেজস্ক্রিয়তার কারণে হামলার পাঁচ বছর পর সবমিলিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজারে।
এবার চোখ খোলা যেতে পারে। ধীরে ধীরে। আমরা এখন ফ্ল্যাশব্যাক থেকে বর্তমানে। চোখের কোনে সত্যিই দু’ফোট জল জমে গেল, তাই না? হিরোশিমাবাসীর চোখের জল কিন্তু এখনো শুকায়নি। হামলার এত বছর পর অর্থাৎ ২০১৬ সালে এসেও হিরোশিমাবাসী বিষাক্ত আনবিক বোমার হাত থেকে মুক্তি পায়নি। এখনো সেখানে সন্তান বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মগ্রহণ করাসহ নানা রকম অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে।
প্রতিবছর এই দিন ফুল দিয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে স্মৃতিস্তম্ভগুলোতে শ্রদ্ধা জানায় জাপানের মানুষ। উপাসানালয়ে করা হয় বিশেষ প্রার্থনা। এতে শামিল হয় পৃথিবীর অন্য দেশগুলো। যে যার অবস্থান থেকে হিরোশিমায় নিহতদের স্মরণ করে থাকে।
এ ছাড়া ১৯৪৯ সালে হিরোশিমা শান্তি স্মৃতি পার্ক স্থাপন করা হয়। একই বছর শহরটিকে শান্তি শহর হিসেবে ঘোষণা দেয় জাপানের পার্লামেন্ট। হিরোশিমা শহরকে এখন ঝিনুকের শহর বলা হয়। বলা যেতে পারে হিরোশিমা ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে ওঠা এক শহরের নাম, যে শহর হেরে যেতে শেখেনি। আর সে কারণেই শহরটি উন্নয়ন আর শান্তির সহাবস্থানের দিক থেকে বিশ্ববাসীর কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।