ক্ষুদিরাম বসু
অগ্নিযুগের মহান বিপ্লবী কিশোর
ছোটবেলা থেকেই ছেলেটি দুরন্ত, ডানপিটে আর বাউণ্ডুলে স্বভাবের ছিল। সেই সঙ্গে মনে ছিল বিপ্লবের নেশা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে হাসতে হাসতে গলায় ফাঁসির দড়ি পড়েছেন কিশোর বয়সে। বীরের মতো আলিঙ্গন করেছেন মৃত্যুকে। ইতিহাসের পাতায় অনেকটা জায়গা জুড়ে আছেন তিনি। বলছি ক্ষুদিরাম বসুর কথা।
ক্ষুদিরাম বসুকে কেন হত্যা করা হয়েছিল, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা কী ছিল, সে বিষয়ে জানতে হলে ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে হবে।
ক্ষুদিরামের জন্ম ১৮৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর। তাঁর জন্মের আগে আরো দুই ভাই জন্মগ্রহণ করেছিল, যদিও তারা মারা যায়। তখনকার নিয়ম ছিল পরপর কয়েকটি পুত্রসন্তান মারা গেলে পরে জন্মানো ছেলেকে বাঁচাতে কড়ি অথবা ক্ষুদ দিয়ে বিক্রি করে দিতে হয়। নিয়ম অনুযায়ী ক্ষুদিরামের মা লক্ষ্মীপ্রিয় দেবী বড় মেয়ের কাছে তিন মুঠি ক্ষুদের বিনিময়ে বিক্রি করে দেন ক্ষুদিরামকে। সেই থেকে তিনি দিদি অপরূপা দেবীর সংসারে বেড়ে ওঠেন।
কিশোর ক্ষুদিরাম বসুর বিপ্লবী হয়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল সত্যেন্দ্রনাথ বসুর। তাঁর কাছ থেকেই পবিত্র গীতা পড়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করতে অনুপ্রাণিত হন।
ক্ষুদিরামের দুঃসাহসিকতা আর দেশের জন্য কিছু করার আগ্রহ দেখে তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সশস্ত্র সংগঠন ‘যুগান্তর’-এর সদস্য করে নেন। শুরু হয় ক্ষুদিরামের বিপ্লবী জীবনের পথচলা। এই সংগঠনেই তিনি বোমা ফাটানো, পিস্তল চালানো, লাঠিখেলা ইত্যাদি প্রশিক্ষণ নেন। এসবে দক্ষ হতে তিনি খুব বেশি সময় নেননি।
এর আগে ১৯০২-৩ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবী নেতা অরবিন্দ ও সিস্টার নিবেদিতা যখন জনসমক্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভাষণ দেন, তখন থেকে ধীরে ধীরে তাঁর ভেতর বিপ্লবের স্বপ্ন দানা বাঁধতে শুরু করে, যার পূর্ণতা পায় শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মাধ্যমে।
১৯০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মেদিনীপুরের মারাঠা কেল্লার এক শিল্প প্রদর্শনীতে রাজদ্রোহমূলক পত্রিকা ‘সোনার বাংলা’ বিলি করার সময় পুলিশ তাঁকে ধরতে গেলে তিনি পুলিশকে আঘাত করে পালিয়ে যান। পরে অবশ্য তিনি ধরা পড়লেও অল্প বয়সী হওয়ার কারণে পুলিশ মামলা প্রত্যাহার করে নেয়।
তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আসামিদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার জন্য কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড মরিয়া হয়ে ওঠেন। এ কারণে বিপ্লবীরা তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। দুঃসাহসী ক্ষুদিরামের ওপর বর্তায় তাকে হত্যার দায়িত্ব। তাঁর সহযোগী করা হয় আরেক বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকীকে, যার বাড়ি ছিল রংপুরে। কিংসফোর্ডের ওপর হামলা হতে পারে—এমন আশঙ্কা করে তাঁকে বদলি করে পাঠানো হয় মোজাফফরপুর। এটা জানতে পেরে ক্ষুদিরাম সহযোগীকে নিয়ে মোজাফফরপুর চলে যান। চোখে চোখে রাখেন কিংসফোর্ডকে।
কিংসফোর্ড তখন অফিস আর ক্লাব ছাড়া বাইরে বের হতেন না আক্রমণের ভয়ে। ক্লাবে কিংসফোর্ডের খেলার সঙ্গী ছিলেন সেদিন অ্যাডভোকেট কেনেডির স্ত্রী ও মেয়ে। খেলা শেষ করে তারা কিংসফোর্ডের গাড়ির মতো দেখতে হবহু একটি গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়েন। পথে ওত পেতে ছিলেন ক্ষুদিরাম ও তাঁর সহযোগী। গাড়ি লক্ষ্য করে বোমার বিস্ফোরণ ঘটান তাঁরা। সঙ্গে সঙ্গেই নিহত হন কেনেডির স্ত্রী ও মেয়ে। আর কিংসফোর্ড থেকে যান অক্ষত।
বোমা বিস্ফোরণের পর দুই বিপ্লবী দুই দিক পালিয়ে যান। পরদিন সকালে ওয়াসি রেলস্টেশনে ধরা পড়লেন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম। ওদিকে প্রফুল্ল চাকী পুলিশের হাতে ধরা পড়তেই গুলি করে আত্মহত্যা করেন। ক্ষুদিরামকে আটক করার পর সমগ্র ভারতবর্ষ উত্তাল হয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ক্ষুদিরামের মুক্তি চেয়ে চলে মিছিল-মিটিং। সাধারণ জনগণ ক্ষুদিরামকে দেখার জন্য পাগল হয়ে যায়। ব্রিটিশ সরকার এমন পরিস্থিতিতে বেশ বিপাকে পড়ে যায়। সিদ্ধান্ত নেয় ক্ষুদিরামকে ফাঁসি দেওয়ার। ১৯০৮ সালের ১৩ জুন ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুযায়ী তাঁর ফাঁসির রায় দেওয়া হয়। রায় শুনে ক্ষুদিরামকে বিচলিত হতে দেখা যায়নি, বরং তিনি হেসে রায় গ্রহণ করেন।
তাঁর মৃত্যুর রায় কার্যকরের তারিখ ধার্য করা হয় একই বছরের ১১ আগস্ট। কারাফটকের বাইরে তখন লাখো জনতার মুখে উচ্চরিত হতে লাগল ‘বন্দেমাতারম’ স্লোগান।
ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে তাঁর কাছে শেষ ইচ্ছা জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি বীরদর্পে বলেছিলেন, ‘আমি ভালো বোমা বানাতে পারি, মৃত্যুর আগে সারা ভারতবাসীকে সেটা শিখিয়ে দিয়ে যেতে চাই।’
এই হলো দেশের জন্য ক্ষুদিরাম বসুর আত্মত্যাগ। নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায় করতে গিয়ে মাত্র ১৯ বছর বয়সে হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় নেন।
ক্ষুদিরাম বসুকে হত্যা করা হলেও তিনি যে বিপ্লবী চেতনার তেজদীপ্ত মশাল জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, তাতে ব্রিটিশরা একসময় বাধ্য হয়ে ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যায়।
আজ ক্ষুদিরাম বসু নেই। রয়ে গেছে তাঁর কীর্তি, যা তাঁকে কখনোই কালের গর্বে হারিয়ে যেতে দেবে না। বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল। অন্তত পৃথিবী যত দিন থাকবে।