আবারও পড়ো
রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ট্রেজার আইল্যান্ড
আগে জলদস্যুরা যে কী ভয়ংকর ছিল! নিষ্ঠুরতা আর বেপরোয়া জীবনযাপনের জন্য তাদের হাঁকডাকই ছিল অন্য কিসিমের। জাহাজের মাঝিমাল্লারা দূর থেকে তাদের জাহাজের পতাকা দেখলেই ভয়ে আধমরা হয়ে যেত। ওরা শুধু জাহাজ লুটই করত না, জাহাজের সবাইকে খুনও করত। এমনই এক জলদস্যু একবার এসে উঠল জিমদের হোটেলে।
জিমদের সেই হোটেলের নাম ছিল অ্যাডমিরাল বেনবোও। আর সে হোটেলে যে জলদস্যু এসে উঠল, তার নাম বিলি বোনস। হোটেলে ঢুকেই সে গাইতে লাগল জলদস্যুদের সেই মার্কামারা গান-
ফিফটিন ম্যান অন দ্য ডেড ম্যান’স চেস্ট-
ইয়ো হো-হো-হো, অ্যান্ড আ বটল অব রাম!
সঙ্গে এক বিশাল সিন্দুক। এসেই হাঁকডাক শুরু করে দিল, ‘তাড়াতাড়ি এক গ্লাস রাম দাও।’ পরে হোটেলটা বেশ পছন্দও হয়ে গেল বোনসের। সে সেখানেই থাকতে শুরু করে দিল।
বোনস্ জিমকে একটা দায়িত্ব দিয়েছিল। বোনসের খোঁজে আরেকজন জলদস্যু আসতে পারে। তার এক পা খোঁড়া। দেখলেই জিম চিনে ফেলতে পারবে। সে শহরে এলেই যেন জিম তাকে খবর দেয়। কিন্তু তার আগেই একদিন হোটেলে এক অদ্ভুত লোক এলো। সে লোকের আবার বাম হাতের দুটো আঙুল নেই। এসেই সে বিলি বোনসের খোঁজ করতে লাগল।
বোনস্ তখন আবার হাঁটতে বের হয়েছিল। ফিরে এসে বোনস্ লোকটিকে দেখে তো ভয়েই শেষ। আট আঙুলে এই লোকটার নাম ব্ল্যাক ডগ। সেও এক জলদস্যু। রীতিমতো নিষ্ঠুর আর বদখত। যাওয়ার আগে কিসের জন্য যেন বোনস্কে পিটিয়েও গেল।
জিম গিয়ে দেখে বোনস্ অচেতন হয়ে পড়ে রয়েছে। জিমের অসুস্থ বাবাকে দেখতে ঠিক তখনই ডাক্তার লেভসি ঢুকল ওদের হোটেলে। বোনস্কে দেখে জানাল, সে স্ট্রোক করেছে। পাক্কা এক সপ্তাহ বিশ্রাম নিতে হবে।
সেদিন রাতেই জিমের বাবা মারা গেল। তাই জিমেরও বোনস্কে দেখতে যাওয়া হলো না। পরদিন তাদের হোটেলে এলো আরেক অদ্ভুত লোক। এই লোকটা অন্ধ। কিন্তু গায়ে যে কী জোর! রীতিমতো জোর-জবরদস্তি করে বোনসের ঘরে গেল। আর তারপর বোনসের হাতে ধরিয়ে দিল ব্ল্যাক স্পট।
ব্ল্যাক স্পট জলদস্যুদের মৃত্যু পরোয়ানা। তাতে লিখে দেওয়া হয় কখন তাকে মারা হবে। ক্যাপ্টেন বোনস্ দেখল, তাতে লেখা ‘১০টা’। মানে আর মাত্র ছয় ঘণ্টা। আর তারপরই আরেকবার স্ট্রোক করল বোন্স। এবার আর ধকল সামলাতে পারল না সে, মারাই গেল।
জিম আর ওর মা ওদের পাওনা নেওয়ার জন্য বোনসের বিশাল সিন্দুকটা খুলল। ওপরে রাখা কিছু কাপড়-চোপড়, পিস্তল আর তামাক সরাতেই বের হয়ে এলো এক ব্যাগভর্তি সোনার মোহর আর অয়েল ক্লথে মোড়ানো একটা বান্ডিল।
এর মধ্যেই ওরা শুনতে পেল, কারা যেন হোটেলের নিচে জটলা পাকাচ্ছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে জিম দেখল, অন্ধ লোকটি এবার লোকজন নিয়ে এসেছে। ওরা কী করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। শেষমেশ জিম সোনার মোহর না নিয়ে, অয়েল ক্লথে মোড়ানো বান্ডিলটা নিয়েই সরে পড়ল। ওদিকে দস্যুরা তো সিন্দুকে ওই বান্ডিল আর খুঁজে পায় না। না পেয়ে পুরো হোটেলই তছনছ করতে লাগল। তখনই জিমের বাবাকে কবর দেওয়ার জন্য লোকজন আসায় ওরা বেঁচে গেল। দস্যুরা ভাবল, অন্য কোনো জলদস্যু আসছে। তাই তড়িঘড়ি করে পালাল।
জিম কিন্তু ওদের কথাবার্তা শুনেই বুঝে ফেলেছে, ওর কাছে যে বান্ডিলটা আছে, সেটা খুবই দরকারি। তাই দেরি না করে তক্ষুণি ছুটল ডাক্তার লেভসির কাছে। ডাক্তার লেভসির ঘরে তখন স্কয়ার ট্রেলায়নিও আছেন। তাঁরা সব শুনে তাড়াতাড়ি করে বান্ডিলটা খুললেন। ভেতরে কেবল একটা সিলগালা করা খাম আর একটা নোটবুক।
নোটবুকের অর্ধেক জুড়ে রাজ্যের নাম লেখা। বাকি অর্ধেকে লেখা রাজ্যের সব হিসাব। তবে খাতা দেখে বোঝা গেল, খাতাটি ব্ল্যাকহার্টেড ডগ নামের এক জলদস্যুর। এবার খোলা হলো সিলগালা করা খামটি। তাতে আর কিছু নয়, আছে একটা গুপ্তধনের ম্যাপ!
তখন তখনই স্কয়ার পরিকল্পনা করে ফেললেন— গুপ্তধন উদ্ধারে যাবেন। সঙ্গে যাবে ডাক্তার আর জিম। কিন্তু সে তো আর ঢাক-ঢোল পিটিয়ে যাওয়া যাবে না। বিশেষ করে ম্যাপের কথা জানাজানি হলে ভীষণ বিপদ। সঙ্গে সঙ্গে অনেক শত্রু জুটে যাবে। সুতরাং, ছক কষা হলো। স্কয়ারের জাহাজে ডাক্তার লিভসে যাবেন জাহাজের ডাক্তার হিসেবে, আর জিম কেবিন ক্রু হিসেবে। এক সপ্তাহের মধ্যে তারা আঁটঘাঁট বেঁধে রওনা হয়ে গেলে ট্রেজার আইল্যান্ডের সন্ধানে। শুরু হয়ে গেলো জিমের দুঃসাহসিক অভিযান।
জাহাজে নাবিক হিসেবে নেওয়া হলো লং জন সিলভারকে। তার কাঁধে সব সময় থাকে একটা টিয়াপাখি। একদিন এই লং জন সিলভারের আসল রূপ দেখে ফেলল জিম। সে আসলে সাধারণ নাবিক নয় মোটেও। রীতিমতো দুর্ধর্ষ জলদস্যু। দলবল নিয়ে ওদের জাহাজে নাবিক সেজে উঠেছে। উদ্দেশ্য, গুপ্তধন উদ্ধারের পর ওদের মেরেকেটে ওদেরই জাহাজে করে ওদেরই খুঁজে পেতে নিয়ে আসা গুপ্তধন নিয়ে মহানন্দে ফুর্তি করতে করতে ফিরে আসবে। জিম তড়িঘড়ি করে স্কয়ার, ডাক্তার আর জাহাজের ক্যাপ্টেন স্মলেটকে সব বলে দিল।
ওরাও ততদিনে চলে এসেছে ট্রেজার আইল্যান্ডে। কাছেই এক জায়গায় নোঙর করল ওরা। নাবিকরা যখন নামছিল, তখন কীভাবে জিমও পড়ে গেল জাহাজ থেকে।
কোনোরকমে সাঁতরে ও উঠল তীরে। আর তারপর এক ছুটে একেবারে বনের ভেতর। যদি সিলভার আবার ওকে কিছু করে বসে।
কিন্তু কথায় আছে না, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত হয়! ও যেখানে গিয়ে থামল, তার কাছেই কোথাও থেকে লং জন সিলভারের গলা ভেসে এলো। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখল, সিলভারের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ও ক্যাপ্টেন স্মলেটের এক নাবিককে মেরেই ফেলল। তাই দেখে তো ও ভয়ে একেবারে দে ছুট আরেক দিকে। হঠাৎ ওর পথরোধ করল এক অদ্ভুত জন্তু। কী আশ্চর্য! একটু পর জন্তুটা হাঁটু গেড়ে বসে ওর নাম জিজ্ঞেস করে বসল!
আসলে ও বিলি জেন, সেও এক জলদস্যু। ক্যাপ্টেন ফ্লিন্টকে ও ট্রেজার আইল্যান্ডে গুপ্তধন রেখে চলে যেতে দেখেছিল। আর তাই দেখে ওর ক্যাপ্টেনকে জানানোর পর ওরা সবাই মিলে ১২ দিন ধরে খুঁজেও যখন কিছু পায়নি, তখন অন্যরা সবাই মিলে ওকে মেরুনে রেখে চলে গেছে। কোনো জলদস্যুকে শাস্তি দিতে হলে অন্য জলদস্যুরা মিলে তাকে একটা নির্জন দ্বীপে একা একটা পিস্তল আর একটা বুলেট দিয়ে ফেলে চলে যায়। থেকে যাওয়া জলদস্যুকে হয় তিলে তিলে মরতে হয়, নয়তো পিস্তলের একমাত্র বুলেটটা দিয়ে আত্মহত্যা করতে হয়। এটাকেই বলে মেরুন।
সব শুনে বিলি জেন জিমের দলে যোগ দিল। কারণ, লং জন সিলভার তো ওরও শত্রু! এবার শুরু হলো আসল লড়াই। একদিকে লং জন সিলভারের জলদস্যুর দল।
অন্যদিকে, স্কয়ার ট্রেলায়নির নেতৃত্বে জিম, ডাক্তার লেভসি আর কয়েকজন নেহাত জাহাজের নাবিক। সঙ্গে সাবেক-জলদস্যু বিলি জেন। জিমদের পক্ষে জেতাটা সত্যিই ভীষণ কঠিন। কে জিতবে শেষ পর্যন্ত? জিমরা কি পারবে গুপ্তধন উদ্ধার করে ওই দুর্ধর্ষ জলদস্যুর দল থেকে নিজেদের বাঁচাতে?
পুরোটা জানতে হলে পড়তে হবে রবার্ট লুই স্টিভেনসনের অমর রোমাঞ্চ উপন্যাস ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’। ১৮৮১ থেকে ১৮৮২ সালে ‘ইয়াং ফোকস’ নামের একটি পত্রিকায় এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এরপর ১৮৮৩ সালে প্রথম এটি বই আকারে প্রকাশিত হয় লন্ডনের ‘ক্যাসেল অ্যান্ড কোম্পানি’ থেকে। পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই এই বইটির অনুবাদ হয়েছে এবং বিপুলভাবে তা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যারা এখনো বইটি পড়োনি, তারা দেরি কোরো না। এই বই না পড়লে বুঝতেই পারবে না যে কী দারুণ একটা অ্যাডভেঞ্চারের সন্ধান এখনো পাওনি!
বই : ট্রেজার আইল্যান্ড
লেখক : রবার্ট লুই স্টিভেনসন
ধরন : অ্যাডভেঞ্চার/রহস্য-রোমাঞ্চ
ভাষা : ইংরেজি
প্রথম প্রকাশ : ১৮৮১-৮২/১৮৮৩
প্রকাশক : ক্যাসেল অ্যান্ড কোম্পানি