বলিউড ফ্যাশন মেকার মনীশের রজতজয়ন্তী
মুম্বাই টিনসেল টাউনে নয় নয় করেই কাটিয়ে দিলেন ২৫টি সৃজনশীল উজ্জ্বল বছর। সেই শ্রীদেবী, জুহি, মাধুরী থেকে আজকের আলিয়া ভাট—কে নেই তাঁর তালিকায়। পরেছেন সবাই এই স্রষ্টার পোশাক। তিনি মনীশ মলহোত্রা। বলিউডের ডাকসাইটে কস্টিউম ডিজাইনার।
শুরু করেছিলেন সেই কবে, বয়স তখন মাত্র ২৫। জুহি চাওলার পোশাক করে দিয়েছিলেন ‘স্বর্গ’ ছবির জন্য। ১৯৮৯ সাল। ছবিটি মুক্তি পায় পরের বছর। তখন হিন্দি ছায়াছবিতে কস্টিউম ডিজাইনের ধারণাটাই ছিল না। তিনি সংযোজন করলেন। মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ক্রমে অভিযোজিত হলো এই আধুনিক ধারণায়। আর এখন যেকোনো ছবির গুরুত্বপূর্ণ অংশই হলো কস্টিউম ডিজাইন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যেতে পারে, বলিউড সিনেমাকে তিনি নিউ লুক দিয়েছেন। স্মার্ট, স্টাইলিশ আর আধুনিক করে তোলার সোপান রচনা করে দিয়েছেন।
শুরুর মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় মনীশ হয়ে গেলেন বলিউডের সেরা কস্টিউম ডিজাইনার। স্বীকৃত হলেন ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডে। ছবিটার নাম বললেই আপনারা নড়েচড়ে বসবেন—‘রঙিলা’। পরিচালক রামগোপাল ভার্মা। অভিনয় করেছিলেন উর্মিলা মাতন্ডকার। আজকের আইটেম গার্লের কনসেপ্ট তখনো আসেনি। বলা হতো আবেদনময়ী। মনীশের তৈরি উর্মিলার পোশাক তাঁকে কোনো সন্দেহ নেই, করে তুলেছিল আবেদনময়ী।
মুম্বাই চলচ্চিত্রের সঙ্গে সাফল্যে মোড়া বিরামহীন আড়াই দশক পার করে আসা মনীশকে নিয়ে তাই উচ্চসিত হওয়ার কারণ ঘটতেই পারে। ঘটেছেও। ডিসেম্বরের ভোগ ম্যাগাজিনের ভারত সংস্করণে প্রচ্ছদ করা হয়েছে মনীশের ডিজাইন করা পোশাকে তাঁরই পাঁচ নায়িকাকে নিয়ে—শ্রীদেবী, কাজল, কারিশমা, কারিনা ও আলিয়া।
ছায়াছবিতে তাঁর বিচরণ সূর্যের মতো। তাঁকে ঘিরে থাকে গ্রহরা। সবাই নারী অভিনয়শিল্পী। শ্রীদেবী, মাধুরী, কাজল, কারিনা, ঐশ্বরিয়া, প্রীতি জিনতারা। পুরুষ সেখানে নৈব নৈব চ। কিন্তু তাঁরাও তো নাছোড়বান্দা। তাই মাঝেমধ্যেই অনুরোধের ঢেঁকি গেলেন তিনি। পোশাক করে দেন শাহরুখ খান ও আমির খানের জন্য।
যে বছর তিনি বলিউডে পা রাখলেন, পরের বছর পোশাক করলেন ফ্যাশন শোর জন্য। মুম্বাইয়ের ফ্যাশনিস্তারা মুগ্ধ হয়ে দেখলেন। মাত্র তিন সপ্তাহে বিক্রি হয়ে সংগ্রহের ৭০ শতাংশ পোশাক। সেই সংগ্রহের একটা আকর্ষণ ছিল এমব্রয়ডারি করা ডেনিম ওয়্যার।
বেশ কয়েক বছর পর, ২০০৪ সালে মুম্বাইতে তিনি লঞ্চ করেন নিজের লেবেল—মনীশ মালহোত্রা। এই লেবেল এখন ভারতের বিভিন্ন শহরে বিক্রি হচ্ছে। যাচ্ছে দেশের বাইরেও। তাঁর পোশাক মানেই অনন্যতা, মুগ্ধকর স্টাইল, উজ্জ্বল রং, কাপড়ের জমিন ততটাই আকর্ষক। প্রতিটি পোশাকে অনবদ্য নান্দনিকতা। ২০০৬ সালে তিনি ল্যাকমে ফ্যাশন উইকে প্রথম অংশ নেন।
নিউইয়র্কে বলিউড অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের জন্য তিনি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন মাইকেল জ্যাকসনের পোশাক নকশার জন্য। সেই পোশাক রীতিমতো হিট হয়। ফলে জ্যাকসন তাঁর মিউনিক শোর জন্য আবারো ডাকেন পোশাক ডিজাইন করে দিতে। এ ছাড়া তাঁর বাচ্চাদের জন্যও পোশাক করিয়ে নেন মনীশকে দিয়ে।
সহজাত প্রতিভা রয়েছে তাঁর। না হলে কোনো দিন ফ্যাশন ডিজাইন না পড়ে কেউ এই উচ্চতায় নিজেকে তুলে আনতে পারে? জন্ম তাঁর লন্ডনে। পড়েছেন মুম্বাইয়ের এলফিনস্টোন কলেজে। কলেজে থাকতে মডেলিং করতেন। ১৯ বছর বয়সে একটি বুটিকে সেলসবয় হিসেবে কর্মজীবন শুরু। আর দুই বছর না যেতেই শুরু করে দেন ডিজাইন। তবে স্কুলজীবনে আঁকা শেখা এ ক্ষেত্রে তাঁর সহায়ক হয়। তিনি প্রথাগত ডিজাইনিংয়ে না গিয়ে কস্টিউম ডিজাইনে চলে আসেন। আসলে তিনি থাকতে চেয়েছিলেন ফোকাসড। এ জন্য মডেলিংও ছেড়ে দেন। ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে তিনি সব সময়েই চেষ্টা করেছেন ভারতীয় ঐতিহ্যকে পুরুজ্জীবিত করে দেশের ও বিদেশের ফ্যাশন অনুরাগীদের কাছে তুলে ধরতে। এ জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন চিক্কনকারি, কাশ্মীরি সূচিকর্ম, মিরর ওয়ার্ক ইত্যাদি।
বলিউডে কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে পূর্ণ হলো রজতজয়ন্তী। অন্যদিকে, ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে পূর্ণ করলেন এক দশক। ডিজাইনাররা মূলত ফ্যাশন ডিজাইনিং থেকেই কস্টিউম ডিজাইনিংয়ে আসেন। মনীশ ঠিক উল্টোটাই করেছেন।
জুহির পর ‘বাঘি’ ছবিতে নাগমার জন্য ডিজাইন করলেন। সিনে ফটোগ্রাফার রাকেশ শ্রেষ্ঠা তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিলেন শ্রীদেবীর সঙ্গে। তাঁর জন্য ডিজাইন করলে ‘গুমরাহ’ ছবিতে। কারিশমার জন্য করলেন ‘রাজা হিন্দুস্তানি’তে। ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’, ‘জুদাই’, ‘মহাব্বাতে’, ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’, ‘কাভি খুশি কাভি গম’ অনেক ছবিতেই তিনি কস্টিউম করেছে গত আড়াই দশকে।
এ বছরে অ্যামাজন ইন্ডিয়া কতুর উইকে তাঁর শোস্টপার ছিলেন ঐশ্বরিয়া রায়। পাঁচ বছর পর ঐশ্বরিয়া আবার ফিরলেন র্যাম্পে। এ বছর মনীশ ডিজাইন করেছেন হিন্দি ছবি ‘দিলওয়ালে’ ও ‘বজরঙ্গি ভাইজান’-এর জন্য।
কারিনার বিয়ের পোশাক মনীশের করা। শহিদ কাপুরও বিয়ের সময় স্ত্রীর পোশাকের জন্য ভরসা রেখেছেন তাঁর ওপর। কদর ফিল্মি মহলেই কেবল নয়, অন্যত্রও রয়েছে। সানিয়া মির্জা তাঁর বোনের বিয়ের পোশাক ডিজাইনের জন্যও পছন্দ করেছেন মনীশকে । বিয়ের পোশাক ডিজাইনেও কিন্তু তিনি যথেষ্ট প্রশংসিত এবং জনপ্রিয়ও। ভারতে শীর্ষ ধনীরা তাঁর পেছনেই লাইন দেন।
মনীশ বলেছেন, দুজন নারী তাঁর প্রেরণার উৎস। প্রথম তাঁর মা। দারুণ স্টাইলিশ। আর হিন্দি ছবির নায়িকা মুমতাজ। এ ছাড়া রাহুল তেদব বর্মণের গানের তিনি ফ্যান। হিন্দি ছবির পুরোনো দিন—ষাট আর সত্তর দশক তাঁকে অবিরাম আকর্ষণ করে; নিয়ত প্রণোদিত করে। ফলে সেই দিনকে তিনি ফিরিয়ে আনেন বর্তমানে, সমসময়ের আঙ্গিকে উপস্থাপন করেন তাঁর সৃষ্টির বর্ণিল বিন্যাস।
মনীশ মালহোত্রার এখন আর কোনো জীবনবৃত্তান্তের প্রয়োজন পড়ে না। ফেসবুকে লাইকের সংখ্যা কত হতে পারে আন্দাজ করতে পারেন? ১১ লাখ। আর কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেছেন কমপক্ষে এক হাজার ছবিতে।
লেখক : সাংবাদিক ও লাইফস্টাইল প্রফেশনাল