কর্মজীবনে সাফল্যের জন্য কীভাবে নিজেকে গ্রুমিং করবেন?
জীবন মাত্রই পরিবর্তনশীল। তাই এর সফলতাও দাবি করে পরিবর্তনের। তাই প্রত্যেকেরই চলমান পরিবর্তনগুলোর সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার দিকে ধাবিত হতে হয়। পেশাদারিত্বের এক অবশ্যাম্ভাবী রসায়ন হচ্ছে নতুন বা পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জগুলোকে গ্রহণ করার সক্ষমতা। এই পরিবর্তন যেকোনো পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়ার কথা বলে, কথা বলে নিজেকে আরো গ্রহণযোগ্য করে তোলার। ফলশ্রুতিতে উদীয়মান আত্মবিঃশ্বাস, সৃজনশীলতা ও নেতৃত্ব দানের গুণাবলীর পথ ধরে আসে কর্মজীবনে সাফল্য। এই পরিবর্তনের স্পর্শ প্রয়োজন মানুষের ভেতর-বাহির দুই সত্ত্বাতেই। আর এখানেই আসে সেল্ফ-গ্রুমিং-এর পটভূমি। এই সেল্ফ-গ্রুমিং-এর তাৎপর্য নিয়েই আজকের ফিচার।
পেশাগত জীবনের জন্য সেল্ফ-গ্রুমিং
সেল্ফ-গ্রুমিং কোন একটি নিদির্ষ্ট উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বিভিন্ন কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে নিজেকে তৈরি করে নেয়া। এই ক্রিয়াকলাপের পরিধি ব্যাক্তিত্বের গ্রুমিং থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত গ্রুমিং পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি বাহ্যিক দিক থেকে সাজসজ্জা, অঙ্গভঙ্গিমা, চেহারা এবং স্বাস্থ্যের সাথে জড়িত থাকলেও আভ্যন্তরীণ দিক থেকে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার মাধ্যমে আচরণ এবং আবেগকে প্রভাবিত করে।
আক্ষরিক অর্থেই একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব নির্ভর করে এর উপর। সমাজ ও কর্মজীবনে তার উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ে। বিভিন্ন সুযোগের উদয় হওয়ার সাথে সাথে প্রতিটি ক্ষেত্রে তার সম্ভাবনাগুলো ক্রমাগত সফলতার দিকে নিয়ে যায়।
কর্মক্ষেত্রে পেশাদার হয়ে ওঠার জন্য সেল্ফ-গ্রুমিং-এর ১০টি টিপস
পেশাদার অঙ্গভঙ্গিমা ও শিষ্টাচার
একজন ব্যক্তির আচরণ হলো তার সবচেয়ে উপযুক্ত পোশাক, যা অন্য সবার কাছে তাকে পরিচিত করে। তিনি কিভাবে হাত ও মাথা নাড়াচ্ছেন, কথা বলছেন, কিভাবে দাড়িয়ে আছেন এবং হাটছেন, এ সবকিছু তার ব্যক্তিত্বকে গড়ে দেয়। এর সাথে শিষ্টাচারের মিথস্ক্রিয়ায় সার্বজনীন এক ভালো লাগা ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হয়।
বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তার প্রাসঙ্গিক অঙ্গভঙ্গির সাথে তার বিনয়ী ভাব সহজেই মানুষের মন জয় করে নিতে পারে। আর এই গ্রহণযোগ্যতা তার পেশাগত সাফল্যের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
কর্মক্ষেত্রের সাথে মানানসই পোশাক
মানুষের ভেতরটা সুন্দর হলেও আগে দর্শনধারির ব্যাপারটা রয়েই যায়। তাই দক্ষতা যাচাইয়ের পূর্বে দেখার প্রয়োজন হয় তিনি কত সুন্দর ভাবে তার পরিচ্ছেদগুলো বহন করতে পারছেন। তাই কর্মক্ষেত্রে ব্যবহৃত শার্ট-প্যান্ট ভাবে ধুয়ে আয়রন করা হতে হবে। প্রতিষ্ঠানের যদি নিজস্ব কোন পোষাক থাকে তার ক্ষেত্রে এটি সমানভাবে প্রযোজ্য।
খেয়াল রাখা উচিত শরীরের থেকে পোষাক বড় হয়ে যাচ্ছে কিনা। পরিধেয় নির্বাচনে ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে বলেই সেই স্বাধীনতার অপব্যবহার করা উচিত নয়। মৌসুমের কথা খেয়াল রেখে সাধারণ দৃষ্টে গ্রহণযোগ্য কাপড়ের দিকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এমনকি শীতের সময়েও হাল্কা রঙকে প্রাধান্য দেয়া উত্তম।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি সাজসজ্জার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। অপরিচ্ছন্নতায় দেহের গন্ধ স্বাভাবিক ভাবেই আশেপাশের মানুষের বিরক্তির কারণ হয়। যেহেতু মানুষ নিয়েই কর্মক্ষেত্রের যত কারবার, তাই তাদের স্বস্তির ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি। নিয়মিত গোসলের মাধ্যমে নিজেকে পরিষ্কার করার পাশাপাশি নিজের ব্যবহৃত যাবতীয় পরিধেয় ধুয়ে ময়লা ও গন্ধমুক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে সিন্থেটিক এবং টাইট ফিটিং কাপড় এড়িয়ে চলা যেতে পারে।
হাল্কা সুগন্ধি ব্যবহার
সুগন্ধি নির্বাচন ব্যক্তিত্বের একটি উপাদান। ভিন্ন রকমের মানুষের উপর নির্ভর করে সেটা ভালো-খারাপ হতে পারে। তাই একদম ব্যতিক্রম সুগন্ধি পছন্দের ক্ষেত্রে সাবধান থাকা উচিত। হাল্কা সুগন্ধি ব্যবহার করা নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে পরিবেশন করার একটা ভালো উপায়।
এটি সুগন্ধিতে অ্যালার্জি থাকা লোকদের বিরক্তি সৃষ্টি করে না। বর্তমান অতিরিক্ত গরমের জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করা আবশ্যক হয়ে দাড়িয়েছে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যে, অবিরত ঘামতে থাকা শরীরে ঘাম আর সুগন্ধি মিলে আরো বাজে গন্ধ ছড়াতে পারে।
পালিশ করা জুতা পড়া
কর্মক্ষেত্রে অবশ্যই স্পঞ্জ, স্যান্ডেল ও স্নিকার্স পড়া ঠিক নয়। সবচেয়ে ভালো সু, তবে লোফারও পড়া যেতে পারে। কেডস-এর ক্ষেত্রে খুব বেশি জাকজমক বা ভ্রমণের কেডসগুলো এড়াতে হবে। সু বা লোফার যাই পড়া হোক না কেন, তা অবশ্যই পরিষ্কার চকচকে হওয়া চাই। আর এর উপায় হলো পরিষ্কার করে তা নিয়মিত পালিশ করা।
পোশাকের সাথে মানানসই জুতা পড়াটা বেশ অর্থবহ। টেইলর করা শার্ট-প্যান্টের সাথে সু সবচেয়ে মানানসই হয়। তাছাড়া এটি আপনার একটি নিদিষ্ট সম্মানজনক পদে কাজ করার কথা জানান দেয়।
নিঃশ্বাসের গন্ধের ব্যাপারে সতর্কতা
মানুষের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্য নিঃশ্বাসের সাথে নিঃসৃত গন্ধের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এরজন্য নিয়মিত ভোরে ঘুম থেকে উঠে ও রাতে ঘুমাতে যাবার আগে দাঁত ব্রাশ করা বাঞ্ছনীয়। ধূমপান করা যাবে না এবং যে কোন খাবার গ্রহণের পর ভালভাবে মুখ ধুরে তারপর কথা বলা আরম্ভ করতে হবে। মুখে মিন্ট ক্যান্ডি রাখা যেতে পারে, তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে কথা বলতে সমস্যার সৃষ্টি না হয়।
চোখে-মুখে প্রাণবন্ত এবং স্বাস্থ্যকর ভাব বজায়
যখন চোখ-মুখ উজ্জ্বল থাকে তখন আত্মবিশ্বাসটা স্বাভাবিকভাবে আরো বেড়ে যায়। ঘুমে ঢুলু ঢুল চোখ নিয়ে কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয়া একেবারেই উচিত নয়। রাতে ভালো ঘুম হওয়া এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে। এ ছাড়া প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে এবং ভিটামিন যুক্ত ফল ও শাকসবজি খেতে হবে। মুখ ঘন ঘন পানি দিয়ে ধুয়ে নেয়া ভালো। অধিক রোদে বের হওয়ার আগে সর্বদা সানস্ক্রিন ব্যবহার করা ভালো।
মুখমন্ডলের সৌন্দর্য্য
প্রতিটি মানুষের দেহাবয়বের সৌন্দর্য্য সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় মুখের মাধ্যমে। দর্শনধারী শব্দটিকে যুক্তিযুক্ত করতে পোষাক-আষাকের সাথে মুখটাকে ভালোভাবে পরিবেশনযোগ্য করে তুলতে হবে। তবে তা অবশ্যই হতে হবে কর্মক্ষেত্রের সাথে মানানসই। পুরুষের ক্ষেত্রে ক্লিন শেভ্ড করাটা উত্তম তবে দাড়ি রাখতে হবে একটি নির্দিষ্ট স্টাইল বজায় রাখতে হবে। জবুথবু করে অথবা কয়েক দিন পর পর হাল ফ্যাশন অনুযায়ী দাড়ি রাখা যাবে না।
নারীর ক্ষেত্রে অত্যধিক মেকআপ ব্যবহার কর্মক্ষেত্রের পরিবেশটিকে উন্নত করার পরিবর্তে নষ্ট করে দেবে। ন্যাচারাল মেকআপে মুখের কালো দাগ ঢাকার সাথে চোখকে উজ্জ্বল করতে মাসকারা এবং ঠোটে আল্ট্রা-ফাইন লিপস্টিক বা লিপ গ্লস লাগানো যেতে পারে। নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে মুখের অবাঞ্ছিত লোম দূর করা উচিত।
পরিপাটি চুলের সুনির্দিষ্ট স্টাইল বজায়
পুরো মুখমন্ডলের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করতে সবচেয়ে কার্যকরি ভূমিকা রাখে মাথার চুল। একটি চুলের স্টাইল একজন ব্যক্তির প্রকৃতি বিচার করতে পারে। তাই মুখের আকৃতির সাথে মানানসই করে চুলের স্টাইল নেয়া উচিত। হাল-ফ্যাশনের হৈচৈ-এর থেকে নিজেকে কোন ধরনের চুলে ভালো লাগছে সেদিকে দৃষ্টি দেয়া দরকার। যে স্টাইলটি বাছাই করা হলো সেটি বজায় রেখে যেতে হবে।
বৈচিত্র্য আনতে অতিরিক্ত বড় আবার একবারে ছোট কিংবা রঙ লাগানো একদমি অপেশাদারিত্বের লক্ষণ। নারীদের ক্ষেত্রে এমনভাবে চুলের যত্ন নিতে হবে যেন কাজের সময় তা ঝামেলার কারণ হয়ে না দাড়ায়। সপ্তাহে অন্তত তিনবার শ্যাম্পু করা যেতে পারে, তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে চুল ধোয়ার পর যেন পুরোপুরি তা শুকিয়ে নেয়া হয়।
অলঙ্কার ও ঘড়ি
ঘড়ি ও অলঙ্কার কোন প্রয়োজনীয় ব্যাপার নয়, তবে যদি ব্যাবহার করা হয় সেক্ষেত্রে সতর্ক হয়ে নির্বাচন করতে হবে। অফিস ড্রেসের সাথে হাত ঘড়ি আরো আভিজাত্য বাড়িয়ে দিতে পারে। এটি কর্মক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের অনুকূল। তবে তা যেন খুব বেশি জাকজমক, কব্জির তুলনায় অনেক বড় আকারের না হয়।
নারীদের ক্ষেত্রে হাতের ব্রেসলেট, কানের দুলেও সিমপ্লিসিটি নিয়ে আসতে হবে। গলার চেইন বা লকেট, কানের দুল, হাতের ঘড়ি ও ব্রেসলেটের সাথে পুরো গেট-আপের সন্নিবেশটা এমন হতে হবে যেন মনে হয় অলঙ্কারগুলো পেশাদার পোষাকটিরই একটা বর্ধিত অংশ।
এখানেও রঙ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ঘন রঙ অপেক্ষা হাল্কা রঙকে প্রাধান্য দিতে হবে। পাশাপাশি তিনি সেগুলো সঙ্গে নিয়ে কত স্বত্বঃস্ফূর্তভাবে চলাফেরা করতে পারছেন সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এই এর পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে পেশাদাররা কর্মজীবনে নিজেদেরকে আরো গ্রহণযোগ্য করে পরিবেশন করতে পারেন। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসায়িক জগতে কর্মক্ষেত্রের জন্য পেশাদার চেহারা এবং সাজসজ্জা মেনে চলা অত্যন্ত অপরিহার্য। সামাজিক এবং পেশাগত ক্ষেত্রগুলোতে সর্বদা নিজেকে সেরা দেখতে চাইলে প্রত্যেককেই সময় ও পরিবেশের সঙ্গে নিজের যা আছে তা যাচাই করতে হবে। এই তিনটি জিনিসকে একত্রিত করতে পারলে একজন ব্যক্তি উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রের জন্য নিজেকে গড়ে তুলতে পারবেন।