সার্বিয়ার রাজপরিবার : বনেদি সাম্রাজ্যে সাদামাটা জীবন
বিশাল অট্টালিকার সামনে এসে গাড়ি থামে। গাড়ি থেকে নেমে তাকাই এদিক-সেদিক। বুঝতে পারি না, কোথায় এটা, কী এই ভবন? স্বাগত জানানোর জন্য কয়েক জন সামনে। তাদের মধ্যে কালো পোশাকের আবরণে এক কিশোরীর আগ্রহই যেন বেশি, এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে সে। হাতে গোলাপের তোড়া, যেন প্রিয়জনের জন্য কত দিনের অপেক্ষা তার। চোখাচোখি হয়, মৃদু হেসে হ্যালো বলি। কিশোরীর মুখেও পাল্টা হাসি, ‘আমি জুভেন মিলিসা। ‘রয়েল প্যালেসের গাইড হিসেবে কাজ করছি।’
মিলিসার সঙ্গে পরিচিত হই। একে একে সবাইকে চিনিয়ে দেয় সে। রয়েল পরিবারের রাজা আলেকজান্ডার আর রানি ক্যাথেরিন অভ্যর্থনা দলের সামনে। তারা ফুল দিয়ে অতিথিদের বরণ করে নেন। এরা বেশ শোআপ সচেতন। কসরত করে কয়েক ভঙ্গিতে অভ্যর্থনার ছবি তুলে নিলেন রাজপ্রাসাদের নিজস্ব ফটোগ্রাফার দেদিরভ। ভদ্রলোক ২৫ বছর ধরে রয়েল ফ্যামিলিতে ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করছেন। কাজের বাস্তব অভিজ্ঞতা অনেক দিনের। কিন্তু ছবি তোলার ভঙ্গিমা দেখলে হাসি আসে। আগা-মাথা ঠিক না করেই ক্লিক, ফ্রেমে মাথা থাক আর না থাক। আমরা রয়েল প্যালেসের ভেতরে প্রবেশ করি।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ সম্মেলন। তাতে অংশগ্রহণের ফাঁকে ঘুরে দেখার আয়োজন। ট্যুর গাইড, গাড়ি, নিরাপত্তা; স্বাগতিক সার্বিয়ার ব্যবস্থাপনাতেই সব। আমাদের টিমের সমন্বয়ক সার্বিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি মিলিচা ক্রিভোকাপিচ। ট্যুরের এই পর্বে বেলগ্রেডের রয়েল পরিবারের সঙ্গে চা-চক্র।
রয়েল প্যালেসের চারিদিকের সড়কগুলো অদ্ভূত। শহরের প্রধান সড়কের সঙ্গে সরু সংযোগ সড়ক। পুরো এলাকাটি জঙ্গলের মতো, তার মধ্য দিয়ে আরও সরু। যেন কোনো রাজবাড়িতে গিয়ে ঠেকেছে কালো কার্পেটিংয়ে মোড়া এই সড়ক। সড়কের উপর পাতার এলোমেলো ছড়াছড়ি, বিভিন্ন রঙের পাতাবাহার। বাতাস হলে উড়ে যেত, বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে আছে। সড়কের পাশে হলুদাভ পাতার গাছ ও হলুদ ফুলের বাগান। গাছপালার মাঝের একটা সড়ক দিয়ে আমরা আসি রয়েল প্যালেসে।
অভ্যর্থনা কক্ষে রাজসিক কায়দার চেয়ার আর সোফা। রাজা ও রানি দুজনেই বেশ স্মার্ট, মুখে আন্তরিকতার হাসি। তাঁরা জানালেন, ‘গাইড সবকিছু ঘুরে দেখাবে। ছবি ওঠানোর ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ নেই। আপনার ঘুরে দেখেন, চায়ের টেবিলে আবার দেখা হচ্ছে।’
রানি মিলাচকে সার্বিয়ান ভাষাতে কিছু একটা বললেন।
‘অতিথিদের ভালো করে দেখিও সব।’ এটাই হবে হয়তো।
কিং আলেকজান্ডারকে ক্লান্ত মনে হলো। বুঝতে পারছি, বয়সের ভারটা বেশি হলেও শরীরটাকে টেনে নিয়ে চলতে হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীকেও দেখি মাঝে মাঝে, দিনভর ব্যস্ততায় ক্লান্ত হয়ে গেছেন। কিন্তু শিডিউলে ওঠানো প্রোগ্রামে যেতে হবে। ক্লান্ত-অবসন্ন শরীর নিয়ে ঠিকই অনুষ্ঠানে হাজির হতে হয়।
রাজা দেখতে সুদর্শন। বেশ উঁচু, লম্বায় সাত বা সাড়ে সাত ফুট হবেন নিশ্চয়ই। ভদ্রলোকের জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সংঘাতময় সময়ে। ১৯৪৫ সালের ১৭ জুলাই, লন্ডনের ক্লারিজের হোটেলে। তাঁর বাবা রাজা দ্বিতীয় এইচ এম কিং পিটার ১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন সেই সময়ের ডেনমার্কের রাজকুমারী আলেকজান্দ্রাকে। মজার ব্যাপার হলো, কিং পিটার আর আলেকজান্দ্রা ছিলেন হোটেল ক্লারিজের ২২২ নম্বর স্যুটে। সেই সময়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল সম্মান জানিয়ে এই রুমটাকে যুগোস্লাভিয়ার সাম্রাজ্য বলে ঘোষণা দেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ক্রাউন প্রিন্স আলেকজান্ডার যুগোস্লাভিয়া রাজপরিবারের সন্তান হিসেবে সিংহাসনের উত্তরাধিকার হন।
দুই শতকের আগে আঁকা সার্বিয়ান পেইন্টিং দিয়ে সাজানো অভ্যর্থনা কক্ষ। পুরো দেয়ালজুড়ে রাজা ও রানির ছবি। মিলিচা সবাইকে নিয়ে দেখানো শুরু করল। একেকটা ছবি ফেলে আসা একেক ইতিহাস।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে পাল্টে যায় পৃথিবীর ঘটনাপঞ্জি। বেলগ্রেডের ক্ষমতা তত দিনে কমিউনিস্ট শাসকদের দখলে; যাঁরা কিং পিটারদের দেশে ফিরতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। বাধ্য হয়েই লন্ডনে আপাত আবাস গড়তে হয় তাঁকে। তবে সেখানেও রাজার মতোই ভাবসাব নিয়ে দিন কাটান কিং পিটার। তিনি কখনোই আত্মসমর্পণ করেননি, হাঁটেননি সমঝোতার পথেও। অবশ্য নিরাপদ দিনযাপনের খোঁজে আমেরিকা, ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ড, অনেকগুলো দেশে ছুটোছুটি করতে হয়েছে তাঁকে। পিটারের ছেলে ক্রাউন প্রিন্সের পড়ালেখাও ছিল তাই, বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়াত। পরবর্তীতে প্রিন্স ব্রিটিশ রয়েল মিলিটারি একাডেমিতে ভর্তি হন। ১৯৬৬ সালে তিনি অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেন। পরে কুইন্স রয়েল ল্যান্সার্সে ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি লাভ করেন। তাঁর দায়িত্বের মধ্যে ছিল পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড। ১৯৭২ সালে তিনি সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মাঝে মাঝে দেশে আসেন। পরে ২০০১ সাল থেকে তারা বেলগ্রেডের রয়েল প্রাসাদে বসবাস শুরু করেন।
দীর্ঘকাল দেশের বাইরে থাকলেও চিন্তাচেতনায় সব সময় গণতান্ত্রিক ছিলেন প্রিন্স আলেকজান্ডার। মানবাধিকার রক্ষায় তাঁর সক্রিয় সমর্থন ছিল। সার্বিয়ায় কয়েক দশকের স্বৈরাচারী শাসনের অবসানে দেশের বাইরে থেকেই তিনি আন্দোলনে সমর্থন দেন। দেশে এসে গণতান্ত্রিক নানা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন, বক্তব্য দেন, আন্দোলন করেন। তাঁর উদ্যোগে বুদাপেস্ট, বসনিয়া, এথেন্সসহ কয়েকটি দেশে আন্দোলনকারীদের নিয়ে সভা-সেমিনার, সমাবেশের আয়োজন করা হয়। মিষ্টভাষী এই ভদ্রলোক সময় পেলে গান শোনেন। থিয়েটার, নাটক, তথ্যপ্রযুক্তি, সমসাময়িক বিষয় নিয়ে তাঁর আগ্রহ। বরফে স্কিটিং, রাস্তায় স্কিটিং, সাঁতার কাটা তাঁর নেশা।
রাজপ্রাসাদের ভেতরেও ঠাণ্ডার প্রকোপ টের পাই। ঘুরে দেখি আর মিলিসার কথা শুনি। সার্বিয়ার রাজকীয় এই রাজপ্রাসাদটি বেশ পুরোনো। এর নির্মাণে সময় লাগে পাঁচ বছর, ১৯২৪ থেকে ১৯২৯ সাল। বিশাল এই প্রাসাদ নির্মাণের ব্যয় এসেছিল কিং প্রথম আলেকজান্ডারের কাছ থেকে। তিনি আবার সম্পর্কে এখনকার রাজা আলেকজান্ডারের দাদা। পছন্দমতো প্রাসাদ বানানোর পর সেখানেই বসবাস শুরু করেন প্রথম আলেকজান্ডার। তাঁর ছেলে রাজা দ্বিতীয় পিটারও এখানেই থাকতে শুরু করেন। উত্তরাধিকারের এই ধারা বজায় রেখে বর্তমান রাজা আলেকজান্ডারও এখানেই বসবাস করছেন।
আমাদের গাইড মিলিসা ক্লাস টিচারের মতো লেকচার শুরু করে দিলেন। ‘বাড়ির ডিজাইনটি আর কটা বাড়ির মতোই মনে হতে পারে। তবে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে মুন্সিয়ানা দেখাতে হয়েছে কারিগরদের। স্থপতি জিভোজিন নিকোলিচ আর নিকোলে ক্রাসনফের কসরত বাড়ির ডিজাইন করেছে ব্যতিক্রম। এটি নির্মিত হয়েছে সার্বিয়ান বাইজান্টাইন শৈলীতে। প্রাসাদটির সাথে সংযুক্ত রয়েছে একটি রয়েল চ্যাপেল। যা রয়েল পরিবারের পৃষ্ঠপোষক বন্ধু সেন্ট অ্যাপোস্টেল অ্যান্ড্রুর নামে উৎসর্গ করা হয়েছে।’
বাইরে বৃষ্টি, সাথে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা। আমি বারান্দায় যাই, জানালার ফাঁক দিয়ে গলা বাড়াই। এত বড় ভবন, রাজপ্রাসাদ- কোনো নদীর তীরে হলেই ভালো হতো। উঁকিঝুঁকি দিয়ে নদী খুঁজি, নদী নাই। গাছের ফাঁক গলিয়ে দৃষ্টি যায় যত দূর, সাদা কুয়াশার মতো। এর পর আবছা। তবে একটা সুইমিংপুলের দেখা মেলে। অন্যপাশে পারগোলাস, পার্ক টেরেস, প্যাভিলিয়ন আর প্ল্যাটফর্ম দিয়ে ঘেরা। সব মনে হয় বৃক্ষের সমাহার। শুধু গাছ আর গাছ। চারিদিকে গাছের মাঝে বড় একটি আলো ঝলমলে প্রাসাদ। ছাদে উঠতে পারিনি। কাকে বলব, লোক খুঁজে পাই না। শুধু দেখার জন্য হলে ক্যামেরা নিয়ে ঝটপট ছবি তোলা, দৌড় দিয়ে এদিক সেদিক যাওয়া, সবই করা যায়। ছাদে গেলে ডেভিঞ্জে পর্বত, কোশুতঞ্জাক ফরেস্ট, টপচিডার আর আভালা পর্বতের চূড়া অন্তত দেখা যেত।
মিলিসা ওই দিকে অতিথিদের নিয়ে ব্যস্ত। আমি তাদের কয়েকটি ছবি ওঠাই। চলে আসি, নিজের মতো করে ঘুরতে থাকি। নিচতলায় অভ্যর্থনা কক্ষগুলো বেশ পরিপাটি, সুন্দর করে সাজানো। প্রধান ফটকের দরজাগুলো পাথর দিয়ে তৈরি। আস্ত সাদা পাথর। ভেতরে রয়েছে বিশাল হলরুম। সেটি নির্মিত হয়েছে মধ্যযুগের সোপোচানির মঠের ফ্রেস্কো দিয়ে। যে ড্রয়িং রুমটি আছে, তার রং নীল। নীলাভ পাথরের আবরণ মনে হয়। নীল যে কষ্টের রং। স্থপতিদের মনে বেদনার রং ছিল না কি! রুমটি বারোক শৈলীতে সাজানো, পছন্দ হয়ে যায়। সোনালি রঙের রয়েছে আরেকটি ড্রয়িং রুম। এটি আর ডাইনিং রুমটি কাঠের উপর মধ্যযুগের রেনেসাঁ শৈলীতে আচ্ছাদিত। ওপরে ব্রোঞ্জের ঝাড়বাতি। এই রুমগুলো পুরোনো মাস্টারদের পেইন্টিং আর রাজকীয় সংগ্রহ থেকে রেনেসাঁ শিল্পীদের আঁকা ফ্লোরেন্টাইন ক্যাসোনির ছবির সমারোহ। রয়েছে ছোট বড় অনেকগুলো লাইব্রেরি। লাইব্রেরিতেও অনেক পেইন্টিং।
আমি এদিক-সেদিক ঘুরি। ছবি উঠাই, নোট নিয়ে রাখি, পরে লিখতে হবে। শ্রীলঙ্কা পররাষ্ট্রমন্ত্রী থারকা বালাসুরিয়ার স্পাউস মালিন্থা বালাসুরিয়া বেশ ফ্যাশন সচেতন। সব জায়গায়, প্রতিটি দর্শনীয় বস্তুর সঙ্গে তার ছবি থাকতে হবে। আমাকে দেখা মাত্রই চোখের ইশারা, ফোন এগিয়ে দেবেন, ছবি তুলে দাও।
আমার ক্যামেরায় ছবি উঠাতে থাকি। হোয়াটসআপে ছবি পাওয়ার আশ্বাসে তিনি স্বস্তি পান। এর পর থেকে, আমাকে দেখলেই পোজ দিয়ে দাঁড়ান। তাঁর পছন্দমতো ছবি ওঠানোর চেষ্টা করি। মালিন্থার হাতে স্যামসাংয়ের পুরাতন মডেলের ফোন, স্ক্রিনটাও ফেটে চৌচির। শ্রীলঙ্কার ঋণ জর্জরিত অবস্থা ফুটে উঠেছে যেনো মালিন্থার ফোনের স্ক্রিনে। তবে ভদ্রমহিলা বেশ স্মার্ট। বিউটিফুল শব্দটি তাঁর সঙ্গে একদমই মানানসই; যার আভিধানিক অর্থ সৌন্দর্যের সঙ্গে চটপটে আর করিতকর্মা।
রয়েল প্যালেস দেখা শেষ হয়। এবার দ্য হোয়াইট প্যালেসের পালা। বেলি ডভোর নামের এই ভবনটি একই রয়েল কম্পাউন্ডের মধ্যেই অবস্থিত। রাজা আলেকজান্ডারের নির্দেশেই ভবনটি তৈরি করা হয়েছিল। তাঁর ব্যক্তিগত ফান্ডের অর্থ দিয়েই এটি নির্মাণ করা হয়। তাঁর মনে হয়েছিল, তিন ছেলে বড় হলে তাদের বসবাসের আবাসন দরকার হবে, যার চাহিদা মেটাবে এই ভবন। যদিও ১৯৩৪ সালে আলেকজান্ডারের হত্যাকাণ্ডের এসব পরিকল্পনা ভেস্তে দেয়।
তরুণ রাজা দ্বিতীয় পিটার এই কম্পাউন্ডের নতুন অধিকর্তা হন। মা এইচ এম কুইন মারিয়া ও ছোট দুই ভাইকে নিয়ে এখানে বসবাস করতে থাকেন তিনি। প্যালেসের বাকি নির্মাণ কাজ তাঁর চাচা প্রিন্স রিজেন্ট পল শেষ করেন। হোয়াইট প্যালেসের নির্মাণ কাজ ১৯৩৪ সালে শুরু হয়, শেষ করতে লাগে চার বছর। ৩৫ হাজারেরও বেশি বইয়ের সম্ভার নিয়ে বিশাল লাইব্রেরিটা রয়েছে এই ভবনেই।
কত সময় হবে, দুই ঘণ্টারও বেশি। আমরাও ক্লান্ত। কিন্তু অতিথিদের সহজে ছাড়লে না কি পাপ (!) হয় হোস্টদের (নিমন্ত্রণকর্তা)। মিলিসাকে দেখি অতিথিদের নিয়ে এগিয়ে আসছেন। তার ব্রিফিং চলছে তখনো। ভবনের ডাইনিং রুমে আবার স্বাগত জানালেন প্রিন্সেস। প্রিন্সেসের দিকে তাকাই। বয়স নিয়ে আমি বরাবরই ধোঁয়াশার মধ্যে থাকি। কারও বয়স যে ৭০ এর বেশি হতে পারে, সেটা মনেই হয় না। মধ্য বয়সে বয়স হবে ৪০ থেকে ৫০ এর ঘরে। সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরই কেবল বয়স হতে পারে ৬০ এর বেশি, এই ধারণার বাইরে যেতে পারি না কখনোই। প্রন্সেস ক্যাথারিনকে দেখেও তাই মনে হলো। দেখতে কম হলেও বয়স আসলে ৭৯ বছর। এই বয়সেও উনি দিব্যি সুস্থভাবে হাঁটছেন, হাসছেন, কথা বলছেন, ছবির জন্য পোজ দিচ্ছেন। চেহারায় বার্ধ্যকের ছাপ নেই, নেই ক্লান্তি-অবসন্নতাও। তিনিও উচ্চশিক্ষিত। সুইজারল্যান্ড আর আমেরিকায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি ব্যবসায় শিক্ষাগ্রহণ করেন। পরে ২০০৭ সালে তিনি লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ড থেকে অনারারি ডিগ্রি লাভ করেন। এটি তাঁর দ্বিতীয় সংসার। আগের ঘরে ডেভিড আর এলিসন নামে দুটি বাচ্চা রয়েছে। শখের তালিকায় ক্রাউন প্রিন্সেরও শীর্ষে রয়েছে ভ্রমণ। তিনিও অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, আমেরিকার অনেকগুলো দেশ ঘুরেছেন। তাঁর দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনাও বেশ মজার। ওয়াশিংটন ডিসিতে ১৯৮৪ সালে তাঁদের দেখা হয়। একবছর চুটিয়ে প্রেমের পর ১৯৮৫ সালে তিনি প্রিন্সকে বিয়ে করেন। সামাজিক কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে সময় কাটাতে পছন্দ করেন রানি।
রানি ম্যাডামদের নিয়ে ডাইনিং রুমে বসেন। তাঁদের বিকালের নাশতা দেওয়া হয়। চা শিঙারার মতো কোনো কিছু। বাইরে বৃষ্টি, সময়টা ভর সন্ধ্যার। একেবারে সঠিক সময়ে উপযুক্ত খাবার। রাজপ্রাসাদ হলেও সেই সময়ের ঢাল তলোয়ার নেই, নেই উজির-নাজিরের ভিড়। তবে কয়েক জন গৃহস্থালি কাজের সহযোগী আছেন। বাড়ির আয়তন তুলনায় গৃহস্থালি সহযোগী কম। দুজন নারী প্লেটে করে খাবার নিয়ে যাচ্ছেন ডাইনিং রুমে। সেই টেবিলে জায়গা হয়নি আমার, মিলিসা আর সিকিউরিটি অফিসারদের। আমরা পাশের রুমে বসি।
রিসটিচকে দেখি বরাবরের মতোই মিলিসার পেছনে ঘুরঘুর করতে। পাত্তা পাচ্ছেন না। আমার পাশের চেয়ারে বসে মিলিসা মোবাইল হাতাতে থাকে। তাঁর সঙ্গে কথা বলি। শুরুর দিকে উচ্ছ্বল, পরে কয়েক মিনিটের মধ্যেই মনমরা হয়ে যান। বৃষ্টিতে ভেজা নির্জীব গাছের মতো। যেন নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন। বয়ফ্রেন্ডের অপ্রিয় মেসেজে চোখ আটকে গেল বুঝি। অঙ্গভঙ্গি মোড় ঘুরিয়ে ফরমাল কথাবার্তায় মোড়। পর্যটন বিষয়ে স্নাতকের পর মিলিসা কাজ করছেন রয়েল হাউসের গাইড হিসেবে। রাজপ্রাসাদের ইতিহাস, রাজা-রানির ব্যক্তিগত জীবন, সার্বিয়ায় রাজপরিবারের প্রভাবসহ কতগুলো বিষয়ে তাঁর কাছে জানতে চাই। খটখট করে সংক্ষিপ্ত উত্তর দেন। যেন টেলিভিশন চ্যানেলের সামনে সাক্ষাৎকার। দশ মিনিট বললেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাংবাদিক দেখাবে ৩০ সেকেন্ডের বাইট। পাল্টা প্রশ্ন তাঁর, কেন এত কিছু জিজ্ঞাসা করছি। দেশে গিয়ে যদি ভ্রমণ কাহিনি লিখি; উত্তর পছন্দ হয় তাঁর। ইমেইল আইডি দেন, প্রয়োজন হলে তাঁকে যেন মেইল করি। বুঝতে পারি পেটে টান পড়েছে। এক কাপ চা হলেও তেষ্টা মিটত। যাঁরা খাবার সার্ভ করছেন, ডাকি। গিয়ে দাঁড়াই। আমাকে দেখে বিরক্ত হলেন। বলি,
‘টি প্লিজ।’
‘সিউর।’
চা নিয়ে আসার নিশ্চয়তা দিলেন বটে, তবে সেই যে ডাইনিং রুমে গেলেন, ফেরার নাম নাই। আরেক জনকে মিনিট দশেক পর বলি,
‘ওয়াটার প্লিজ।’
‘ওয়েট।’
তিনিও যে হারালেন, ঢুকে গেলেন কিচেনে, আর ফিরতে ভুলে গেলেন। ঠাণ্ডাময় পরিবেশে ধোঁয়া উঠা চা; ইচ্ছেটাকে অপূর্ণই রাখতে হলো।
এবার ফেরার পালা। অভ্যর্থনা কক্ষে আবার। রাজপরিবারের পক্ষ থেকে অতিথিদের সুভ্যেনির গিফট তুলে দেওয়া হয়। রাজা-রানির পাশে গিয়ে দাঁড়াই আমিও, একটি স্মৃতি হয়ে থাক। রোমন্থন করার সুযোগ হাতছাড়া কে করতে চায়।
কীভাবে যাবেন
রয়েল হাউসটি সাধারণ দর্শকের জন্যও উন্মুক্ত। কেউ চাইলে ঘুরে আসতে পারেন নান্দনিক সৌন্দর্যের এই প্রাসাদে। রাজা-রানিও চান সবাই দেখুক সার্বিয়ান বাইজান্টাইন শৈলীর রকমফের। এর জন্য বেলগ্রেড ট্যুরিস্ট অর্গানাইজেশনের সহযোগিতা নিতে হবে। সরকারি এই সংস্থাটির ব্যবস্থাপনায় আগ্রহী দর্শনার্থী এখানে প্রবেশের অনুমতি পান। বছরের এপ্রিল থেকে নভেম্বর সময়ে প্রতি বুধবার খোলা থাকে প্রাসাদটি। আর সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনি ও রোববারও ঘুরে আসতে পারেন।
রয়েল হাউস ও হোয়াইট প্যালেস ঘুরে দেখতে দুঘণ্টা সময় লাগে। সাথে থাকবে পেশাদার ট্যুর গাইড। যাঁরা গল্পচ্ছলে হাঁটার তালে তালে ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন।
বেলগ্রেডের ট্যুরিস্ট অর্গানাইজেশন প্রতি বুধবার সকাল ১০টায় দর্শনার্থীদের জন্য রয়েল প্যালেস পরিদর্শনের ব্যবস্থা করে। শনি ও রোববারে থাকে দুটো টিম, সকাল ১০টায় একটি, অপরটি দুপুর ১টায়। এক টিকেটেই থাকে শহর থেকে প্যালেস পর্যন্ত ট্রান্সপোর্ট সুবিধা, নাশতা, সঙ্গে চা-কফি। সর্বোচ্চ ৫০ জন নিয়ে একটি গ্রুপ করে তাঁদের ঘোরানোর ব্যবস্থা করা হয়। একটি টিকেটের জন্য দর্শনার্থীকে গুণতে হয় ৬৫০ সার্বিয়ান ডলার। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী রয়েল প্যালেস ভ্রমণের জন্য বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকেন। এই সুবিধা থাকে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার জন্যও।
রয়েল প্যালেস ভ্রমণের জন্য রেজিস্ট্রেশন করে নিতে হয়। যেতে হবে ফরমাল পোশাক পরে। এই এলাকায় স্মোকিংয়ের নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে।
প্রাথমিক তথ্য, টিকেট বুকিংসহ প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য যোগাযোগ করতে হবে বেলগ্রেডের পর্যটন তথ্য কেন্দ্রে।
Knez Mihailova 56.
ফোন : 011 26 35 622
ইমেইল : [email protected]
ওয়েবসাইট : www.tob.rs