দুই প্রতিষ্ঠানের ‘লড়াইয়ে’ শিক্ষার্থীরা কাবু
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)। মাস্টার্স অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট নামে একটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেওয়া হয় এখানে। ডিগ্রিটি এমবিএর সমান্তরাল। দেশে ব্যাংকিং খাতে চাকরির জন্য এই প্রতিষ্ঠানের সনদপত্রের বেশ গুরুত্ব রয়েছে। যার কারণে পদোন্নতিসহ বিভিন্ন ভালো চাকরির সুযোগের জন্য ব্যাংক কর্মকর্তাসহ অনেকেই প্রতিষ্ঠানটিতে উচ্চশিক্ষার জন্য আসেন।
উচ্চশিক্ষা আর চাকরিতে পদোন্নতি পাবেন এমন আশা নিয়ে ২০১২ সালের জুলাই মাসে যে শিক্ষার্থীরা বিআইবিএমে ভর্তি হয়েছিলেন, তাঁরা এখন পড়েছেন বিপাকে। পদোন্নতি বা চাকরির আশা তো দূরের কথা টাকা-পয়সা দিয়ে ভর্তি হয়ে দুই বছর ক্লাস করার পরও কোর্স শেষ হচ্ছে না তাঁদের। আদৌ এই প্রতিষ্ঠান থেকে লেখাপড়া শেষ করে সনদপত্র নিতে পারবেন কি না সে নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তাঁরা। ওই ব্যাচের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ বিআইবিএম এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যকার রেষারেষির কারণে আটকে আছে তাঁদের ভবিষ্যৎ।
৭০-এর দশকের শুরুতে অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা পুনর্গঠনের তাগিদ অনুভূত হতে থাকে। এরপর আইএমএফ এবং ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের পরামর্শে বাংলাদেশে একটি ব্যাংকিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়। দেশের ব্যাংকিং খাতের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ এবং এই সেবার মান উন্নয়নের জন্য ১৯৭৬ সালে যাত্রা শুরু করে বিআইবিএম। এরপর ১৯৯৭ সালে এমবিএম নামের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ডিগ্রি দিতে শুরু করে বিআইবিএম। শুরুতে নিয়মিত কোর্স হলেও চাকরিজীবীদের কথা মাথায় রেখে সান্ধ্যকালীন কোর্স। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ধরনের গবেষণা, কর্মশালা ও সেমিনারের আয়োজন করে থাকে।
শুরুতে প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। পরে ২০১৪ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে যায় বিআইবিএম। আর এই পরিবর্তনের ফলেই হুমকির মধ্যে পড়েছে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ জন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন। ২০১২ সালের জুলাই সেশনে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা পড়েছেন বিপাকে। কেননা তারা যখন ভর্তি হন তখন বিআইবিএম ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। আবার তাঁদের কোর্স শেষ হওয়ার আগেই প্রতিষ্ঠানটি চলে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিষয়টিতে অসম্মানজনক হিসেবে দেখছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। আর তাই বিআইবিএমের শিক্ষার্থীদের আর কোনো পরীক্ষা নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে তারা। ফলে আটকে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘২০১২ সালের জুলাই মাসে আমরা বিআইবিএমে ভর্তি হই। পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেয়ে নির্ধারিত ফি দিয়ে ভর্তি হতে হয়েছে। পাঁচ সেমিস্টার যখন প্রায় শেষ, তখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসে কোর্সটি। তবে আমাদের জানামতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো অনুমোদন বা নো অবজেকশন সার্টিফিকেট নেয়নি বিআইবিএম। ২০১৪ সালে যখন ঢাবির অধীনে চলে যায় কোর্সটি, তখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অপমানিত হয়ে জানিয়ে দেয় যে এই প্রতিষ্ঠানের আর কোনো পরীক্ষা তারা নেবে না। ফলে গত বছরের অক্টোবর মাসের পর থেকে আর পরীক্ষা নেয়নি তারা। ফলে আমাদের পুরো ব্যাচের এবং আগের ব্যাচগুলোর যাদের একটি বা দুটি বিষয়ে পরীক্ষা বাকি ছিল, তারা কেউ পরীক্ষা দিতে পারছেন না।’
এই মুহূর্তে ২০১২ সালের জুলাই সেশনে ভর্তি হওয়া প্রায় ৪০ জন শিক্ষার্থী আছেন পরীক্ষার অপেক্ষায়। পঞ্চম সেমিস্টার পর্যন্ত এক লাখ ৫৩ হাজার করে টাকা বিআইবিএমে জমা দিয়েছেন বলে জানান শিক্ষার্থীরা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আর বিআইবিএমের রেষারেষিতে পড়ে তাদের মাশুল গুনতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইবিএমের অধীনস্থ ঢাকা স্কুল অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (ডিএসবিএম) পরিচালক মো. মহিউদ্দীন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, শুরুতে যখন এমবিএম কোর্সটি চালু করা হয় তখন এর আসলে উদ্দেশ্য ছিল ব্যাংকিং খাতে কিছু গ্রাজুয়েট তৈরি করা। এ জন্য ১৯৯৬ সালে কোর্সটিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। সে সময় থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই এই প্রোগ্রামটির সকল পরীক্ষা নেওয়া হতো।
পরবর্তীতে এই প্রোগ্রামটির জন্য বিআইবিএমের অধীনে স্কুল অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (ডিএসবিএম) নামে একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। এই স্কুলটিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তির জন্য আমরা আবেদন করি। তবে এর আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি কাজী শহীদুল্লাহর সঙ্গে মৌখিকভাবে আলাপ করি। তিনি কোনো আপত্তি না করায় সেটিকেই আমরা সম্মতি হিসেবে ধরে নিই। যেহেতু এক সঙ্গে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা সম্ভব না, তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি পাওয়ার পর আমরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধিভুক্তি বাতিলের জন্য আবেদন করি।
কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নানাভাবে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে থাকে। অধিভুক্তি বাতিলের বিষয়ে এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা দেখাতে থাকে তারা। বারবার যোগাযোগ করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা তাদের আইনি উপদেষ্টার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছেন। তিনি সিদ্ধান্ত জানালে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
অর্থাৎ অধিভুক্তি বাতিল করা বা না করা প্রসঙ্গে কিছুই জানায়নি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্তি দেয় শুধু এমবিএম প্রোগ্রামটিকে। ঢাকা স্কুল অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টকে তো তারা অধিভুক্তি দেয়নি। এটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নয়। যেহেতু ডিএসবিএম একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান এবং এখান থেকে একটি পেশাগত বা প্রফেশনাল কোর্স চালানো হয় তাই এটিকে অধিভুক্ত করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু তারা (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়) বলছে ঢাবি এটা করতে পারে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুণ অর রশীদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘যখন একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কেউ এফিলিয়েটেড (অন্তর্ভুক্ত) থাকে, তখন আরেকটা প্রতিষ্ঠানে যেতে হলে আগের প্রতিষ্ঠানটির সম্মতি নিতে হয়। তারা (বিআইবিএম) আমাদের সঙ্গে (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়) এফিলিয়েশেনে থাকলেও আমাদের না জানিয়ে হঠাৎ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এফিলিয়েশন করেছে। যা খুবই আনল’ফুল (বেআইনি), ইলিগ্যাল (অবৈধ)। হাউ কুড দে গো টু ঢাকা ইউনিভার্সিটি?’
বিআইবিএম কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের উপাচার্যের মৌখিক সম্মতি নিয়ে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, ‘এই ধরনের একটি এফিলিয়েশন মৌখিকভাবে সম্মতি নেওয়ার বিষয় না। এটার তো একটা ডকুমেন্ট থাকতে হবে। আমি আজকে ভিসি। কালকে নাও থাকতে পারি। তখন নতুন কেউ আসবেন। ডকুমেন্ট না থাকলে তো কোনো কিছু প্রমাণ করা যাবে না।’
হঠাৎ করে বিআইবিএমের চলে যাওয়াটাকে অন্যায্য বলেও মন্তব্য করেন হারুণ অর রশীদ। এই অন্যায্য ও অবৈধ কাজের জন্যই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আর কোনো পরীক্ষা নিচ্ছে না বলেও জানান তিনি।
ডিএসবিএমের পরিচালক স্বীকার করে বলেন, ‘আমাদের একটাই ভুল হয়েছে সেটা হলো আমরা আগে থেকে লিখিতভাবে অনুমতি নিইনি। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি না পেয়ে কীভাবে জানাব? দেখা গেল আবেদন করার পরও ঢাবি অনুমতি দিল না। তখন আমরা কী করতাম? আমাদের যে ভুল হয়েছে, সেটা আমরা স্বীকারও করেছি। তাদেরকে বারবার বলছি যে, যেসব ছাত্র জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনের ছিল তাদের পাঠ্যক্রমটা শেষ করতে। যেসব রিটেক আছে সেই পরীক্ষাগুলো নিয়ে নিতে। কিন্তু তারা সেটা করছে না। তারা বলছে, এই ছাত্রদের যেন ঢাবির অধীনে পরীক্ষা নিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু তাহলে তো সিলেবাসে মিলবে না। যাদের রিটেক রয়েছে, তাদের পরীক্ষার কী হবে? একটা-দুইটা বিষয়ের পরীক্ষা তো ঢাবি নিতে পারে না।
আমরা এখন শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বলব। তিনি যদি সমাধান করতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে আমাদের আইনি উপদেষ্টার মাধ্যমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে আইনি নোটিশ পাঠাতে হবে।
বিআইবিএম এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই টানাপড়েনের মধ্যে বিপাকে পড়েছেন ২০১২ সালে জুলাই মাসে ভর্তি হওয়া একটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। আদৌ কখনো পরীক্ষা দিয়ে সনদপত্র নিতে পারবেন কি না এখন সে শঙ্কায় দিন কাটছে তাদের। সেই সঙ্গে যাঁদের একটি বা দুটি বিষয়ে পুনঃপরীক্ষা দেওয়ার কথা তাঁরাও অল্পের জন্য আটকে আছেন।