শ্রীলঙ্কায় সংকট বাড়ছে, গোটাবায়ার ভাষণে সন্তুষ্ট নয় দেশবাসী
শ্রীলঙ্কার জনগণ দেশটির প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের বুধবার রাতের ভাষণে সন্তুষ্ট হয়নি। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ওই ভাষণে গোটাবায়া পদত্যাগের আহ্বান উপেক্ষা করে সে দেশে শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার করেন। প্রেসিডেন্টের এমন অবস্থানে নাখোশ লঙ্কাবাসী। খবর বিবিসির।
গত মাসে শ্রীলঙ্কায় বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর বুধবার রাতে প্রথম জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন গোটাবায়া। ভাষণে তিনি প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার কিছু অংশ পার্লামেন্টের কাছে হস্তান্তরের প্রস্তাব করেন। তবে, এর জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো সময়ের কথা তিনি উল্লেখ করেননি।
প্রেসিডেন্ট গোটাবায়াকে দেশের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সংকটের জেরে পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু, গোটাবায়া তাঁর ভাষণে সে বিষয়টি উপেক্ষা করেছেন।
অনেকে বলছেন—গোটাবায়ার ভাষণটি প্রকৃত সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট গোটাবায়াকে উদ্দেশ করে কাবিন্দ্য থেনাকুন নামের কলম্বোর এক বিক্ষোভকারী বিবিসিকে বলেন, ‘গত ৩০ দিন আপনি কোথায় ছিলেন? মানুষের কাছে ওষুধ নেই, খাবার নেই, গোটা দেশ থমকে আছে।’
‘তিনি (গোটাবায়া) যে সংস্কারের পরামর্শ দিচ্ছেন, তা আমাদের প্রয়োজন নেই। আমাদের এ মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা হলো—(প্রেসিডেন্টের) পদত্যাগ করা... খারাপ লাগছে যে, গোটাবায়া রাজাপাকসে তা বুঝতে পারছেন না’, যোগ করেন কাবিন্দ্য থেনাকুন।
গোটাবায়ার ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই চলতি সপ্তাহের শুরুতে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের কথা উল্লেখ করছেন। কারণ, গোটাবায়ার ছোট ভাই মাহিন্দাকেও লঙ্কাবাসী পদত্যাগের দাবি জানিয়েছিল। আজ বৃহস্পতিবার সকালে বিক্ষোভরত একজনের টুইট ছিল এমন—‘একজন গেছে। আরেকজনকেও তাড়াতে হবে।’
অপর এক টুইটে গোটাবায়াকে উদ্দেশ করে লেখা হয়েছে—‘আপনার মন্ত্রীদের এবং আপনার আপন ভাই মাহিন্দাকে তাদের গুন্ডাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু না করার পরামর্শ দেওয়া উচিত ছিল। তারা ওই মূর্খতা না করলে আজ শ্রীলঙ্কায় এমন সহিংসতার ঢেউ দেখতে হতো না।’
লঙ্কা সরকারের বিরুদ্ধে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলমান শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ গত সোমবার সহিংস হয়ে ওঠে। এদিন মাহিন্দা রাজাপাকসের সমর্থকেরা দুটি স্থানে সমাগত হাজার হাজার সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায়। এর জেরে সহিংসতা শুরু হয়।
দেখামাত্র গুলির নির্দেশ
মাহিন্দা রাজাপাকসে এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিলেও বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের ওপর সরকার সমর্থকদের হামলার পর থেকেই রাজাপাকসে পরিবারের সম্পত্তি এবং তাদের সমর্থনকারী অন্যান্য রাজনীতিকদের নিশানা করছে।
গত সোমবার ও মঙ্গলবার রাতে সহিংসতা চলে। মাহিন্দা রাজাপাকসের ছেলের মালিকানাধীন একটি রিসোর্টসহ কলম্বোর কাছে একাধিক দোকানে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
দুই বারের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা বর্তমানে নিরাপত্তার জন্য শ্রীলঙ্কার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটি নৌঘাঁটিতে লুকিয়ে আছেন বলে দেশটির সামরিক বাহিনী জানিয়েছে।
এরই মধ্যে লুটপাটকারীদের দেখামাত্রই গুলি করার নির্দেশ দিয়ে শ্রীলঙ্কাজুড়ে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
গোটাবায়া রাজাপাকসে তাঁর বুধবার রাতের ভাষণে সহিংসতা শুরুর পেছনে সরকার সমর্থকদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেননি। তিনি শুধু বিক্ষোভাকারীদের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানান এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনের পূর্ণ শক্তি প্রয়োগের অঙ্গীকার করেন।
আজ বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কায় কারফিউ জারি রয়েছে। কারফিউর কারণে গতকাল বুধবার তৃতীয় দিনের মতো দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অফিস-আদালত বন্ধ ছিল।
লঙ্কাবাসী ক্ষুব্ধ কেন?
খাদ্য ও জ্বালানির মতো অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী ফুরিয়ে যাওয়া বা ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় লঙ্কাবাসী মরিয়া হয়ে উঠেছে।
ভয়াবহ আর্থিক পরিস্থিতির কারণে শ্রীলঙ্কার মুদ্রা রুপির ব্যাপক দরপতন হয়েছে। এতে করে খাদ্য, জ্বালানি ও চিকিৎসা-সামগ্রী সরবরাহের মতো মৌলিক চাহিদার তীব্র ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
লঙ্কা সরকারের দাবি—দেশটির অর্থনৈতিক সংকটের জন্য কোভিড মহামারি দায়ী। সরকার বলছে—কোভিডের কারণে শ্রীলঙ্কার পর্যটন শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। পর্যটন শিল্প দ্বীপ রাষ্ট্রটির বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের অন্যতম উৎস।
সরকার আরও বলছে—তিন বছর আগে একাধিক গির্জায় ভয়াবহ সিরিজ বোমা হামলার কারণে পর্যটকেরা ভয়ে শ্রীলঙ্কায় আসছেন না।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন—শ্রীলঙ্কার বর্তমান দুরবস্থার পেছনে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাই দায়ী।
রাজাপাকসে পরিবারের বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কার সাধারণ জনগণের ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে। অনেকেই মনে করেন—মাহিন্দা রাজাপাকসে তাঁর আত্মীয়-স্বজনের আর্থিক লাভের জন্য দেশের সম্পদ লুটপাটের পথ করে দিয়েছেন।
অব্যাহত তুমুল বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার আগে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের ভাইয়েরা এবং একাধিক ভাতিজা সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন।
গোটাবায়ার প্রস্তাবিত রাজনৈতিক বিকল্প কী?
দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণে গোটাবায়া রাজাপাকসে বলেন, তিনি একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী
পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থনের পাশাপাশি একটি নতুন মন্ত্রিসভার নেতৃত্ব দেবেন।
গোটাবায়া এর আগে বলেছিলেন—তিনি ঐকমত্যের বা জোট সরকার গঠনের লক্ষ্যে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করছেন। কিন্তু, প্রধান বিরোধী দল জানিয়ে দিয়েছে—প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ না করলে তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা প্রশাসনে যোগ দেবে না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে কোন কোন রাজনৈতিক দল একজোট হয়ে সরকার গঠন করতে পারে, সে বিষয়টি ধোঁয়াশায় রয়েছে।
শ্রীলঙ্কা যখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহায়তা নিয়ে অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের চেষ্টা করছে, তখনই রাজনৈতিক অচলাবস্থায় পড়েছে দেশটি। দ্বীপরাষ্ট্রটির আট হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনীতি বর্তমানে দেউলিয়া হওয়ার পথে।
শ্রীলঙ্কা তার বিদেশি ঋণ পরিশোধ স্থগিত রেখেছে। এর মূল কারণ—দেশটি চীনের কাছ থেকে ঋণ নিতে পারছে না। শ্রীলঙ্কার বিশাল অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য অর্থের জোগান দিয়েছে চীন।
কোভিড মহামারি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন খাতে আঘাত হানার জেরে দেশটির রাজস্ব ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে—এ বিষয়টি সত্য। তবে, বিশেষজ্ঞেরা এও বলছেন—২০১৯ সালে জনতাকে খুশি করতে কর হ্রাস করা এবং ২০২১ সালে রাসায়নিক সারের ওপর নিষেধাজ্ঞার জেরে সমস্যা বরং বেড়েছে। কেননা বিপর্যয়কর ওই নিষেধাজ্ঞার কারণে ফসলের ফলন ব্যাপক কমে গেছে।