শ্রীলঙ্কায় জাদুঘরে যে কারণে হামলা বিক্ষোভকারীদের
দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা রাজাপাকসে জাদুঘরে হামলা চালিয়েছে। দেশটিতে চলমান বিক্ষোভে মৃত্যু ও আহতের ঘটনার তুলনায় জাদুঘরে হামলাকে অনেকটা কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে। কিন্তু, সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে—জাদুঘরে এ হামলার গুরুত্ব মোটেও কম নয়।
রাজাপাকসে জাদুঘরটি রয়েছে শ্রীলঙ্কার দক্ষিণাঞ্চলীয় হাম্বানটোটা এলাকায়। ওই এলাকাটি ক্ষমতাসীন রাজাপাকসে পরিবারের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত।
হাম্বানটোটা ওই জাদুঘর শ্রীলঙ্কার বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের পিতামাতা এবং তাঁর বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসের নামে উৎসর্গকৃত। মাহিন্দা রাজাপাকসে নিজেও শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট।
জাদুঘরটিতে প্রয়াত ডন আলউইন রাজাপাকসে ও তাঁর স্ত্রী ড্যান্ডিনার ছবিসহ কাপড়-চোপড়, গৃহস্থালির জিনিসপত্র এবং হাতে লেখা চিঠি রাখা ছিল।
কিন্তু, গত সোমবার জাদুঘরটিতে হামলা চালিয়ে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়ার পিতামাতার ভাস্কর্য ভাঙচুর করে সরকারবিরোধীরা।
তবে, জাদুঘরে হামলা চালিয়ে কেবল রাজাপাকসে পরিবারের ওপরই ক্ষোভ উগরে দেননি বিক্ষোভকারীরা। এ ঘটনার শেকড় আরও গভীরে বিস্তৃত বলে বিবিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
মেদা মুলানা গ্রামে অবস্থিত জাদুঘরটি হয়ে উঠেছিল ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির প্রতীক। জাদুঘরটি ২০১৪ সালে উদ্বোধন করা হয়। সে সময় মাহিন্দা রাজাপাকসে ছিলেন প্রেসিডেন্ট, আর গোটাবায়া ছিলেন তাঁর প্রতিরক্ষা সচিব।
রাষ্ট্রীয় তহবিল ব্যবহার করে গোটাবায়া ব্যক্তিগত জমিতে (জায়গায়) জাদুঘরটি নির্মাণ করেছিলেন। গোটাবায়ার অধীনে থাকা প্রতিরক্ষা ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রণালয় জাদুঘরের নির্মাণ এবং এ সংক্রান্ত প্রাথমিক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল। আর শ্রীলঙ্কার নৌবাহিনীকে জাদুঘর নির্মাণের জন্য জনবল সরবরাহের নির্দেশ দেন গোটাবায়া।
কিন্তু, ২০১৫ সালের নির্বাচনে মাহিন্দা রাজাপাকসে হেরে গেলে জাদুঘর নির্মাণে রাষ্ট্রীয় তহবিল ব্যবহার করা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়।
গোটাবায়া সে সময় রাষ্ট্রীয় তহবিল তছরুপের অভিযোগটি অস্বীকার করলেও জানান যে, রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে ছয় কোটি শ্রীলঙ্কার রুপি (চার লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার) জাদুঘর নির্মাণে ব্যবহার করা হলেও, এর কিছু অংশ তিনি পরবর্তীকালে ফেরত দিয়েছিলেন।
২০১৯ সালে গোটাবায়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরপরই প্রেসিডেনশিয়াল ক্ষমতাবলে তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ খারিজ করা হয়। মাহিন্দার বিরুদ্ধে জাদুঘর-সংক্রান্ত কোনো তদন্ত করা হয়নি।
২০০৯ সালে বিছিন্নতাবাদী তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করার পেছনে অনেকে মাহিন্দা ও তাঁর ছোট ভাইকে কৃতিত্ব দিয়ে থাকেন। অনেকেই ভেবেছিলেন তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতা যাবে না। এ কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি শ্রীলঙ্কাবাসীর কাছে রাজাপাকসে ভাইয়েরা নায়ক বনে যান।
সময়ের পরিক্রমায় রাজাপাকসে পরিবারটি নিজেদের দ্বীপরাষ্ট্রের রাজা বলে ভাবতে শুরু করে। কারণ, তারা মনে করে—দেশকে তারাই সন্ত্রাসবাদের কবল থেকে মুক্ত করেছে। কিন্তু, রাজাপাকসে ভাইদের শাসনকালে লাগামহীন খরচের জেরে অনেকের কাছেই তাঁদের জনপ্রিয়তা খর্ব হতে থাকে।
জাদুঘরের কাছাকাছি বসবাসকারী ৬২ বছরের বৃদ্ধা বি এম নন্দাবতী বলেন, ‘এই নেতারা ৩০ বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে সন্ত্রাসবাদ থেকে আমাদের রক্ষা করেছে। এজন্য আমরা তাঁদের সম্মান করি।’
‘কিন্তু, এটি ভুল ছিল। তাঁরা আমাদের লুটে নিয়েছে। পুরো দেশটাকে বিক্রি করে দিয়ে তাঁরা নিজেদের মা-বাবার সারং-ব্লাউজ প্রদর্শনের জন্য জাদুঘর বানিয়েছে। তাঁরা দেশের একেকটি ডলার লোপাট করেছে’, যোগ করেন নন্দাবতী।
হাম্বানটোটার বাসিন্দা ৩৭ বছর বয়সি ডিক্সন বিক্রমারাচ্চি বলেন, ‘তাঁরা জনগণের অর্থ দিয়ে এ জাদুঘর তৈরি করেছে। ওই অর্থ তাঁরা নিজেরা রোজগার করেননি।’
‘যখন দেশের গরিবেরা তিন বেলা ঠিকমতো খেতে পাচ্ছে না, তখন তাঁরা দামি ডিজাইনার জুতা-পোশাক পরে বিলাসী জীবনযাপন করছেন’, যোগ করেন ডিক্সন বিক্রমারাচ্চি।