জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
দক্ষিণ আমেরিকাসহ আফ্রিকায় জিকা ভাইরাসের দ্রুত বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে সারা পৃথিবীতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সোমবার সংস্থাটির এক জরুরি বৈঠক শেষে এ সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন সংস্থাটির মহাপরিচালক মার্গারেট চ্যান।
স্বাস্থ্যবিষয়ক এই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সংস্থাটি বলেছে, মশাবাহিত এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে পুরো বিশ্বকে এক হয়ে চেষ্টা চালাতে হবে। জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে মার্গারেট চ্যান বলেন, ‘আর অপেক্ষা করার সুযোগ নেই। ভয়ংকর এই ভাইরাসকে না ঠেকালে তা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়বে।’
বিশ্বব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলেও ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রয়োজন এখনো আসেনি বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাতে জানিয়েছে রয়টার্স। তবে জিকা ভাইরাসে গর্ভবতী নারীদের ক্ষতির মাত্রা বেশি থাকায় আক্রান্ত এলাকায় গর্ভবতী নারীদের ভ্রমণ না করার পরামর্শ দিয়েছেন মার্গারেট চ্যান।
চ্যান জানান, বর্তমানে জিকা ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক বাজারে নেই। এ ছাড়া এই ভাইরাস ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষাও কঠিন।
এদিকে, গবেষণা সংস্থা দ্য প্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশন জানিয়েছে, এরই মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার ২৪টি দেশে জিকা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। আর এতে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। গত অক্টোবর থেকে মাত্র তিন মাসে শুধু ব্রাজিলেই এই ভাইরাসের কারণে ৪০ হাজার শিশু বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নিয়েছে।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, কোনো গর্ভবতী মা জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাঁর অনাগত শিশুর মাথা স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট হতে পারে এবং ওই শিশুর মস্তিষ্কের গঠন থাকতে পারে অপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল ব্রাঞ্চ বর্তমানে এই ভাইরাসের টিকা নিয়ে কাজ করছে। এই ব্রাঞ্চের বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে উপদ্রুত এলাকায় সফর করে ভাইরাসে আক্রান্তদের রক্তসহ বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করেছেন। তবে তাঁরা বলছেন, এই ভাইরাসের উপযুক্ত টিকার পরীক্ষা চালাতে তাদের দুই বছরের বেশি সময় লাগতে পারে। আর তা পারা গেলেও মানুষের কাছে প্রতিষেধকটি সহজলভ্য করতে এক দশকের বেশি সময় লেগে যেতে পারে।
এর আগে সর্বশেষ পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। সে বছর ইবোলায় বিশ্বব্যাপী প্রায় ১১ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। সেই ইবোলার মতো সমপর্যায়ের সতর্কতা জারি করে জিকা ভাইরাস মোকাবিলাকেও সমান গুরুত্বে আনল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
এরই মধ্যে জিকা ভাইরাসের ব্যাপারে ব্রাজিলসহ বিশ্বব্যাপী সতর্কতা জারি করা হয়েছে। বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে নেওয়া হয়েছে চরম সতর্কতামূলতা ব্যবস্থা। লাতিন আমেরিকার লাখ লাখ মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। ব্রাজিলের অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, এই ভাইরাসের কারণে দেশটির সরকার নারীদের আগামী দুই বছর গর্ভধারণ থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিয়েছে।
পূর্ব আফ্রিকার দেশ উগান্ডার অতি পরিচিত জিকা (স্থানীয় ভাষায় ‘বাড়ন্ত’) বনাঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে ১৯৪৭ সালে প্রথম এ ভাইরাসের সন্ধান মেলে। এ কারণে এর নাম দেওয়া হয় ওই বনেরই নামে।
সন্ধান পাওয়ার সাত বছর পর নাইজেরিয়ায় প্রথম মানবদেহে এ ভাইরাস সংক্রমণের তথ্য পাওয়া যায়। এর পর তা ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে।
গত বছরের অক্টোবরে ব্রাজিলে নতুন করে জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর খোঁজ মেলার পর মাত্র চার মাসের মধ্যে বহু দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে।
এডিস মশা থেকে সাধারণত জিকা ভাইরাস মানুষের দেহে ছড়িয়ে থাকে। এ ভাইরাস মানুষের শরীরে একবার প্রবেশ করলে প্রাথমিক অবস্থায় জ্বর, হাতে-পায়ের সংযোগস্থলে ব্যথাসহ নানা ছোটখাটো কিছু শারীরিক অসুস্থতা দেখা দেয়। কিন্তু তা কম সময়ের মধ্যে সেরেও যায়।
তবে বিপত্তি তৈরি হয় গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে। গর্ভাবস্থায় জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মাইক্রোফেলাসি তথা বিকৃত ও ছোট মাথা নিয়ে জন্ম নিতে পারে শিশু। এসব শিশুর বুদ্ধিমত্তার ঘাটতি থাকে, শারীরিক বৃদ্ধি কম হয়, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।