সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির জন্মদিনে
"তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ,
তাই তব জীবনের রথ
পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার"
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৩তম জন্মবার্ষিকীতে জানাই গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ অবিভক্ত বাংলার বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করে একটি শিশু যার জন্ম না হলে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রটিরও হয়ত জন্ম হতো না। শুধু নিজ জন্মভূমিতে নয়,সারা বিশ্বে একটি দেশ ও তাঁর নাম একীভূত হয়ে গেছে। স্বনামধন্য কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী যথার্থই বলেছিলেন, ‘১৭ মার্চ একজন ব্যক্তির জন্মদিবস নয়,একটি জাতির জন্মদিবস।’
ঐতিহাসিক মতে বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর সম্মিলনে নৃতাত্ত্বিক অর্থে বাঙালি জাতির উন্মেষ ঘটে আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে। তবে জাতি হিসেবে বাঙালির জন্ম ঘটেছিল মূলত প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তির মাধ্যমে। বলা যায় সেই সময় থেকেই এই উপমহাদেশে বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি নিজ পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ লেখা হয়েছিল হাজার বছর আগে। সেদিক থেকে বাংলা ভাষাভাষী বাঙালির জাতিসত্তার ইতিহাস এক হাজার বছরের। হাজার বছরের এই বাঙালি জাতি কখনো বিচ্ছিন্ন,কখনো জাতিসত্তা অন্বেষণে বিভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত।কিন্তু লড়াকু জাতি হিসেবে বাঙালি তার আপন পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে শুরু থেকেই। সেই বাঙালির নিজ আবাসভূমির স্থপতির নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব ১৯৭১-এর আগে কখনোই প্রকাশ পায়নি। বঙ্গবন্ধু হলেন সেই নেতা যিনি বাঙালির অতীত,বর্তমান এবং ভবিষৎকে তাৎপর্যমণ্ডিত করেছেন। ঐতিহ্যে স্থির থেকে বাঙালির আধুনিক পরিচয়কে বহুমাত্রিক পূর্ণতা দান করেছেন বঙ্গবন্ধু। তাই বাঙালি,বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধুকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক শব্দের নাম।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাঙালির স্বাধিকার, জয়বাংলা, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশ- এই শব্দগুলোর সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর নাম। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী,সাহসী,এবং ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের কারণে বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশ নামের ভৌগোলিক রাষ্ট্রটির উৎপত্তি। ব্রিটিশ সাংবাদিক সিরিল ডান বলেছেন-বাংলাদেশের এক হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা যিনি রক্তে-বর্ণে,ভাষায়,সংস্কৃতিতে ও জন্মসূত্রে পুরোদস্তর বাঙালি। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে বাঙালির রক্তে যে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। আর সে কারণেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীকে পরিণত হন। গোটা বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করেন তিনি। হাজার বছরের ইতিহাসে সার্বভৌম-স্বাধীন বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি ভূষিত হয়েছেন ‘জাতির জনক’ রূপে।
বঙ্গবন্ধু সবই করেছেন বাংলা ভাষা ও বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে। নেতৃত্বের গুণাবলি ও বাঙালিত্বের পরাকাষ্ঠায় সব নেতাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন বলেই জাতি তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জাতির পিতা’র মর্যাদাপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। আমরা জানি বাংলাদেশের সংবিধানের মূল ৪টি স্তম্ভের একটি হলো জাতীয়তাবাদ এবং তা অবশ্যই বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ১৯৭২ সালের ৭ জুন ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সুস্পষ্ট ভাষায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,‘আমার বাংলার সভ্যতা,আমার বাঙালি জাতি,এ নিয়ে হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ।' তাই আমরা বলতে পারি বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাই অন্যতম রাজনৈতিক অর্জন এবং এই অর্জনের রূপকার বঙ্গবন্ধু।
মনেপ্রাণে খাঁটি বাঙালি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর যাপিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিচয় রয়েছে বাঙালিয়ানার। জীবনব্যাপী বাঙালিয়ানারই সাধনা করে গেছেন বঙ্গবন্ধু। আর দশজন বাঙালির মত অতি সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। সব রকমের বাঙালি খাবারেই অভ্যস্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
বাঙালি এবং বাংলাদেশের কল্যাণ কামনাই ছিল বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের আরাধ্য। বাংলাদেশের পটভূমিকায় তিনি একক কোনো ব্যক্তি নন,শুধু একটি নামও নন,সমগ্র বাঙালির সমষ্টি তিনি,সমগ্র বাংলার ইতিহাসও তিনি।বাঙালি এবং বাংলাদেশকে তিনি ধারণ করেছিলেন তাঁর সমস্ত সত্তায়। তাই তো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক : অধ্যক্ষ, ভাসানটেক সরকারী কলেজ, ঢাকা।