একজন দেশপ্রেমিক মানুষের চলে যাওয়া
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আর নেই। মঙ্গলবার রাতে নিজের প্রতিষ্ঠিত ধানমণ্ডি গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যু দেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।
আমার কাছে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন অসাধারণ দেশপ্রেমিক এবং দেশ অন্তপ্রাণ মানুষ। তাঁকে প্রথম দেখি হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে জংশন স্টেশনে জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে। ১৯৭৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেনারেল ওসমানীর সমর্থনে প্রচার কাজে অংশ নিতে সেখানে গিয়েছিলেন। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে এবং পরবর্তীতে সাংবাদিকতা পেশায় এসে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় এবং জাফর ভাইয়ের স্নেহধন্য হই। সাভারের নবীনগরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিভিন্ন কর্মশালা, সেমিনার ও মাঠ পর্যায়ের কাজের রিপোর্ট করতে গিয়ে তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি। ফলে কাছ থেকে তাকে জানার সুযোগ হয়েছে। যে বিষয়টি লক্ষ্য করেছি বাংলাদেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণ ছাড়া তিনি কিছু ভাবেন না এবং এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন সোচ্চার।
চিকিৎসাক্ষেত্রে জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন একজন ভাস্কুলার সার্জন। তবে দেশের জনস্বাস্থ্য চিন্তাবিদ হিসেবেই তিনি আবির্ভূত হন। বাংলাদেশের ওষুধ এখন সারা বিশ্বে রফতানি হচ্ছে। দেশের ওষুধ শিল্প এখন এক সাকসেস স্টোরি। সেক্ষেত্রেও তাঁর অবদান রয়েছে। ১৯৮২ সালের ওষুধনীতি দেশকে ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করে। ওই নীতি প্রণয়নের অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এ ব্যাপারে তার সুনাম রয়েছে। গরীব দেশের মানুষকে কম পয়সায় কীভাবে চিকিৎসা দেওয়া যায়, ওষুধের দাম কিভাবে কম রাখা যায়, গ্রামে কিভাবে স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে যাওয়া যায় এসব নিয়েই তাকে মেতে থাকতে দেখেছি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলার বিশেষ ভূমিকা ছিল জাফরুল্লাহ চৌধুরীর। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত চিকিৎসকদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংঘটিত করা, হাসপাতালের জন্য ওষুধ সহ চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহের ক্ষেত্রেও তাঁর অনন্য ভূমিকা ছিল। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে গড়ে তুলেন। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা যে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব তা গণস্বাস্থ্য প্রমাণ করেন এবং গ্রামীণ পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা ছড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে নারীদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। নারী ড্রাইভারের চাকরির উদাহরণ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রেই প্রথম দেখা যায়।
১৯৮৮ সালের মহাপ্লাবনের সময় ধানমণ্ডির নগর হাসপাতালের সামনে বিশাল তাবু খাঁটিয়ে তাঁর উদ্যোগে শুকনো খাবার বিশেষ করে রুটি তৈরি হয়েছে লক্ষ লক্ষ পিস। এসব খাবার বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ হয়েছে। বন্যার্তদের মাঝে সহজলভ্য শুকনো খাবার দেওয়ার চিন্তা তার মাথা থেকেই আসে। এভাবে দেশের প্রতিটি দুর্যোগে তাঁকে দেখেছি আর্ত মানবতার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়তে। তাঁর গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের বেশিরভাগ রোগীই গরীব মানুষ। এত কম মূল্যে অন্য কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার নজির নেই। গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালের ওষুধের দামও খুব কম।
দৈনিক বাংলায় আমার অনেক অনুসন্ধান মূলক রিপোর্টের ক্ষেত্রে জাফর ভাই তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন ক্লাবের সদস্যদের চিকিৎসা প্রদানের আমাদের অনুরোধে তিনি এগিয়ে আসেন এবং তাঁর হাসপাতালের একটি টিম নিয়মিত ক্লাবে থেকে সদস্যদের চিকিৎসা করেছেন প্রায় বিনা খরচে। দেশের রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলায়ও তিনি তাঁর আন্তরিকতার ছাঁপ রেখেছেন। এ বিষয়ে সবসময়ই সময়োপযোগী বক্তব্য দিয়েছেন। সর্বশেষ গত ২৬ মার্চ বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে হুইল চেয়ারে করে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে গিয়ে তিনি রাজনৈতিক সংকট সমাধানের আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি বলেন, ‘বিএনপিকে ডাকুন, বিরোধী দলগুলোকে ডাকুন, কথা বলুন, সংকটের সমাধান করুন।’
জাফর ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁকে আর কখনো পাবো না। মহান আল্লাহর কাছে তাঁর মাগফেরাত কামনা করছি।
লেখক : সাংবাদিক