আমাদের জন্যই তো দেশ স্বাধীন অইল, কিন্তু খাইতে পারি না
স্বাধীনতার প্রায় ৪৫ বছর পর ভোলার তজুমদ্দিনের একই পরিবারের দুই বীরাঙ্গনা বোনের খোঁজ মিলেছে। এতদিন কেউ তাঁদের খোঁজ নেয়নি। জানত না প্রশাসনও। জীবনের শেষ বয়সে এসে ন্যুব্জ দুই বোন এখন সরকারের স্বীকৃতি চান, চান সহযোগিতা।
দ্বীপ জেলা ভোলা শহর থেকে প্রায় ৬৬ কিলোমিটার দূরে তজুমদ্দিন উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চল শশীগঞ্জ গ্রাম। সেই গ্রামের আব্দুল মজিদ পাটোয়ারী বাড়িতে বসবাস করছেন বীরাঙ্গনা দুই বোন। এঁদের একজন বিবি ফাতেমা। তিনি সেনাবাহিনীর সাবেক হাবিলদার আবদুল মান্নানের স্ত্রী। মান্নানকে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এ সময় তিনি কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। ফাতেমা এখন অনেকটাই শয্যাশায়ী।
আরেক বোন বিবি মালেকা। তিনি গ্রামের মো. রেজাউল হকের স্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধের সময় বড় বোন বিবি ফাতেমা ছিলেন সন্তানসম্ভবা। তাঁর দেখাশোনার জন্যই বিবি মালেকা কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে যান।
যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বিবি মালেকা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, যুদ্ধ শুরুর পরের দিন সকাল ৭টায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অভিযান চালায় তাঁদের ঘরে। দৌড়ে তারা খাটের নিচে আর বাথরুমে লুকান। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। হাবিলদার আবদুল মান্নানকে ঘরের বাইরে নিয়ে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি আর্মি।
এরপর বাথরুমেই চলে দুই দুই বোনের ওপর অত্যাচার। সেখানেই শেষ নয়। তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় কুমিল্লা ইস্পাহানি কলেজে। সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে তাঁরা নয় মাস আটক ছিলেন। অবিরাম অত্যাচার আর নির্যাতন চলেছে তাঁদের ওপর। পানি পর্যন্ত ঠিকমতো খেতে দেওয়া হতো না।
এই অবস্থার মধ্যেই বড় বোন বিবি ফাতেমা জন্ম দেন এক ছেলে সন্তানের। তার নাম জাহাঙ্গীর। যুদ্ধ শেষ হলে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদেরকে উদ্ধার করেন। পরে তাঁদের পাঁচশ টাকা দিয়ে দেশের বাড়ি ভোলার তজুমদ্দিনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সেই থেকে অবহেলা আর চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিন যাচ্ছে বীরাঙ্গনা দুই বোনের। ছোট বোন বিবি মালেকা অন্যদের সহযোগিতায় হাঁটতে পারলেও বড় বোন ফাতেমা বিছানায় শয্যাশায়ী। অভাবে নিয়মিত খাবার জোটে না, চিকিৎসা তো দূরের কথা।
চরম ক্ষোভ নিয়ে বিবি ফাতেমা বলেন, ‘আমরা দেশের জন্য কিছুই কি করিনি? দেশের জন্য অত্যাচারিত হলাম। দেশ স্বাধীন হইলে, কিন্তু আমগো খোঁজ কেউ নেয়নি। সরকার কোনো খোঁজ নেয় না। আমার সন্তানরা খুব কষ্টে আছে। রক্ত আমরা দেইনোই। যৌবন শেষ করে দিলাম। কী পাইছি? স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারে দ্বারে গিয়েছি টাকা চায়, টাকা দিয়েছি। তারপরেও কোনো সাহায্য পাইনোই। এখন শেষ সময় এসে সাহায্য চাই সরকারের।’
এদিকে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দুই বীরাঙ্গনা বোন তজুমদ্দিনে আছেন, এ জন্য গর্ববোধ করি। তাঁরা দেশের স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে নিজের সম্মান বিসর্জন দিয়েছেন। আমরা দুই বোনের স্বীকৃতির ব্যাপারে কাজ করব।’
ভোলার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘এটা সত্যি যে আমি এখনো এ ব্যাপারে কিছু শুনিনি। ভাসা ভাসা কয়েকজনের কাছ থেকে শুনলেও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে তথ্য এলে বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি ও পুনর্বাসনের জন্য সহযোগিতা করব।’