স্মৃতিরেখা
একাত্তরের আগুন
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নষ্ট রাজনীতি অনেক অনাচার করেছে। মুক্তিযুদ্ধের মূল সূর বিকৃত করে প্রজন্মকে চেতনা বিচ্ছিন্ন করতে সক্রিয় রয়েছে কোনো কোনো পক্ষ। একটি জাতির এগিয়ে চলার পথে এরচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা আর কিছু হতে পারে না। এ কারণেই এখন সময় আমাদের বার বার একাত্তরে ফিরে যাওয়া। প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করা মুক্তিযুদ্ধ এবং এর সময়কালের সাথে। মুক্তিযুদ্ধ আর এর সময়কালকে যে যেভাবে দেখেছেন, অংশ নিয়েছেন, শত্রু আক্রান্ত দেশে অসহায় কালাতিপাত করেছেন, প্রত্যক্ষ করেছেন পাক হানাদার বাহিনীর পৈশাচিকতা, দেশের জন্য অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই কাছে থেকে দেখে রোমাঞ্চিত হয়েছেন সবারই দায়িত্ব স্মৃতিচারণা করা। প্রজন্মের সামনে জীবন্ত করে তোলা।
এই মার্চে আমি বার বার ফিরে যাচ্ছি একাত্তরে। বারো বছরের সেই আমি কি সত্যি অতটা অবুঝ ছিলাম? কারণ এসব অমানবিকতা দেখে তখন কষ্ট পেতাম। এখন কি অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে? না সময়ের বিবর্তনে আমরা আমাদের মানবিক গুণগুলো ক্রমে হারিয়ে ফেলছি।
এপ্রিলের শুরুর দিকে পাক বাহিনী নারায়ণগঞ্জ শহরে ঢুকেছিল। শীতলক্ষ্যার পূর্বপার বন্দরে আমাদের বাড়ি। নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রবেশ মুখ চাষাড়ায় রাস্তার ওপর শক্ত বেরিকেড দিয়েছিল মুক্তিকামী মানুষ। পাকবাহিনী বেরিকেড সরাতে শক্তি প্রয়োগ করছে। প্রকম্পিত হচ্ছিল কামান, মর্টার শেল আর মেশিনগানের শব্দে। শহরের অনেকেই জীবন বাঁচাতে নদী পার হয়ে আসছে বন্দরে। যার যার পরিচিত বা আত্মীদের বাড়ি পালিয়ে আসা ভীত মানুষদের ভিড়। সবাই নিয়ে এসেছে ভয়ঙ্কর সব অভিজ্ঞতা। চাষাড়ার দিকে দাউদাউ আগুন জ্বলছে। মানুষের আর্ত চিৎকারে ভারি হয়ে উঠছে চারদিক।
আমরাও নদীর এপার থেকে শেল আর মেশিনগানের ভয়ঙ্কর শব্দ শুনে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছি। সবাই বলাবলি করছে যেকোনো সময় নদী পাড়ি দিয়ে বন্দরে ঢুকে পড়বে পাকবাহিনী। তাই জীবন বাঁচাতে হলে পালাতে হবে। শুরু হলো বাঁধা ছাদা। যতটুকু বহন করা যায় তেমন একান্ত দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে ঘরগুলো তালা বদ্ধ করে সদর দরোজায় খিল এঁটে খিরকি দরজা দিয়ে হাজার হাজার পালানে মানুষদের মিছিলে আমরাও শরিক হলাম। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে চলে এলাম মদনগঞ্জে। সামনে শীতলক্ষ্যা গিয়ে পরেছে ধলেশ্বরীতে। নৌকায় ধলেশ্বরী পাড়ি দিয়ে মুন্সীগঞ্জে।
মুন্সীগঞ্জের আশ্রয়ে থাকার সময় প্রতিবিকেলে একাকী এসে বসে থাকতার লঞ্চঘাটের পন্টুনে। লাশ গণনার নেশা পেয়ে বসেছিল। ঢাকার দিক থেকে ¯রাতের টানে ধলেশ্বরী হয়ে মেঘনার দিকে চলে যেতো হতভাগ্য বাঙালির মৃতদেহ। ফুলে যাওয়া মৃতদেহ কাক শকুনে ঠুকরে খাচ্ছে। একটি, দুটি, পাঁচটি...। প্রতিদিনের সংখ্যা যোগ করে লাশের মিছিল হতো। মুন্সীগঞ্জ ছাড়ার আগেই খবর এলো ২৪ এপ্রিল বন্দরে ঢুকেছে পাকিস্তানি হায়নারা। স্থানীয় জামায়াত, মুসলিম লীগের দালাল আর বিহারিরা দেখিয়ে দিয়েছে কোন কোন বাড়িতে আঘাত হানতে হবে। মূল সড়কের পাশেই আমাদের দেয়ালঘেরা জনশূন্য বাড়ি। ভেতরে ঢুকে গানপাউডার ছিটিয়ে ভস্মীভূত করেছে পুরো বাড়ি। আর আশপাশ থেকে ধরে এনেছে চুয়ান্ন জন বাঙালি। তরুণ প্রৌঢ় বৃদ্ধ কেউ বাদ যায়নি। আমাদের বাড়ির সমনেই ফুটবল খেলার মাঠ। এই মাঠের এক প্রান্তে গুলি করে হত্যা করা হয় প্রত্যেককে। তারপর মৃতদেহগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
মুন্সীগঞ্জের আশ্রয়ে বেশিদিন থাকতে পারিনি। খবর আসে পাকবাহিনী আসছে মুন্সীগঞ্জের দিকে। আবার জীবন নিয়ে পালানো। হাজার হাজার মানুষ জীবন নিয়ে ছুটছে ধানক্ষেত আর খাল-নদী পার হয়ে। দূরে আগুনের লেলিহান শিখা আর মেশিনগানের গর্জন।
নভেম্বরে বোনদের গ্রামে রেখে আব্বা মায়ের সাথে বন্দরের বাড়িতে ফিরে আসি। একটি বড় ধ্বংসস্তূপে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে আমাদের সাজানো বাড়ি। কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে পোড়া থামগুলো। সেই ১২ বছরের কিশোর আমি ভাবছিলাম কী ভয়ঙ্কর হতে পারে মানুষ। মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে চলে যেত দৃষ্টি। সবাইকে গুলি করে পুড়িয়ে মেরেছে ওরা। আমাদের খুব পরিচিত বাবুল ভাইও ছিল এই লাশের মিছিলে। তখন আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কল্পনা করতাম মেশিনগান তাক করা পাকসেনাদের মুখ। রূপকথার রাক্ষসের চেহারা শুধু ভাসতো মনের ফটোপ্লেটে। পাকবাহিনীর বন্ধু রাজাকার আল-বদরদের কিম্ভুতকিমাকার মামদো ভূতের মতো মনে হতো।
এখন ষাটের দিকে এগিয়ে চলা মানুষ আমি। ২০১৩-এর নভেম্বর ডিসেম্বরে আবার মানবতার বক্ষ বিদীর্ণ করা আগুনে খেলায় মত্ত দানবদের দেখতে পেয়েছিলাম আমরা। তারা অবলীলায় যাত্রীসহ বাস পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। তাদের দেওয়া আগুনে ট্রাক ড্রাইভার, অটোচালক পুড়ে মরছে। পণ্যবাহী ট্রাক জ্বলেছে আগুনে। ট্রেন লাইন উপড়ে ফেলে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। ৪৪ বছর আগে এ দেশের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য দানবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাক বাহিনী। সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পদ ধ্বংস করে সৃষ্টি করতে চেয়েছিল ভীতিকর পরিবেশ। এই দানবরা ছিল ভিন ভাষী, ভিন দেশি আর ভিন সংস্কৃতির মানুষ।
এত বছর পর দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়েছিল এ দেশেরই কয়েকটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী। আর সে পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য একাত্তরের ঘাতক দালালদের বর্তমান প্রজন্মের দানবদের মাঠে নামানো হয়েছিল। এদের দানবীয় আচরণে বিপর্যস্ত হয়েছে মানুষ। আর এদের নির্দেশদাতা রূপকথার রাক্ষস রাক্ষসীরা কর্মসূচির নামে সাধারণ মানুষের জীবন আর দেশের সম্পদ ধ্বংসের জন্য দানবদের লেলিয়ে দিয়েছিল। বিপন্ন মানুষদের জন্য সামান্যতম সহানুভূতির শব্দ ছিল না এদের কণ্ঠে। রাজনীতির এসব খলনায়ক-নায়িকারাই কি আমাদের ভাগ্য বিধাতা হতে থাকবেন বার বার!
আমার দৃষ্টি এই সব ঘোড়েল ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের দিকে থাকে না। দৃষ্টি যায় এসব দলের সাথে যুক্ত এ যুগের তরুণদের দিকে। আর আফসোস হয় এই ভেবে যে, ওরা মুক্তযুদ্ধ দেখেনি, দেখেনি বাঙালির মুক্তির লড়াই। মৃত্যুকে সামনে দাঁড় করিয়ে আমাদের অগ্রজেরা লড়াই করেছে দেশের জন্য। চেয়েছে একটি স্বাধীন দেশ। মানুষের প্রকৃত মুক্তি। মুক্তিযুদ্ধের এই চেতনাই প্রণোদিত করবে প্রজন্মকে। রাজনীতির নামে ক্ষমতা লোভী আগাছা সরিয়ে তারাই দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নতুন আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ করবে। অথচ এই তরুণদের একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বিচ্ছিন্ন হয়ে সুবিধাবাদী নেতানেত্রীর কারখানায় নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ আত্মস্থ করে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। আজ খুব প্রয়োজন এই ভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসা। তরুণ প্রজন্মই পারে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চেতনায় অবগাহন করে দেশকে এগিয়ে নিতে দিকভ্রান্ত নাবিকদের সঠিক পথের দিশা দিতে।
লেখক : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।