বৈশাখে দেশি ও বিদেশি পোশাক
চৈত্রের প্রচণ্ড দাবদাহ উপেক্ষা করে মানুষ বৈশাখ উদযাপনে বিভিন্ন শপিংমলে ঘুরছেন। কিনছেন নিজের জন্য। প্রিয়জনদের জন্যও। সবার পছন্দকে ছুঁতে ফ্যাশন হাউসগুলোর আয়োজনও এবার উল্লেখ করার মতো। প্রতিটি হাউস বৈশাখ আয়োজনে গতবারের চেয়ে নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। ডিজাইন বৈচিত্র্য, আঙ্গিক ভাবনা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই সবার কালেকশন অবশ্যই গেলবারের চেয়ে আকর্ষক। প্রচারণার মাধ্যমে সবাই ভোক্তাদের নজর কাড়ার চেষ্টা করেছে।
এ ছাড়া ফ্যাশন অন্টরপ্রনরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এফইএবি) প্রথমবারের মতো ফ্যাশন শো করেছে বৈশাখ সংগ্রহ নিয়ে। সব মিলিয়ে জমজমাট আসর। কিন্তু সবকিছুর মূলেই তো অর্থনীতি। কেমন সে অবস্থা? এ প্রশ্নটা অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের টার্নওভার গেলবারের চেয়ে বেশি। তাদের আন্দাজ শতকরা হিসাবে এই বৃদ্ধির পরিমাণ ২০-২৩ ভাগ। বাণিজ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে এই পরিস্থিতিকে অবশ্যই আশা-জাগানো বলতে হবে। এই বৃদ্ধি অবশ্যই ২০১৫ সালের ধারাবাহিকতা। গত বছরও অন্য যেকোনো ভালো সময়ের চেয়েও শ্রেয়তর ছিল। গতবার প্রবৃদ্ধি ছিল সাধারণ সময়ের চেয়ে ১০-১৫%; ক্ষেত্রবিশেষে তা ২০-২৫%ও। এর আগে বছর, অর্থাৎ ২০১৪ সালের বৈশাখ আদৌ ভালো যায়নি। রাজনৈতিক অস্থিরতায় বৈশাখের আয়োজন যেমন থাক, বাজার ছিল মন্দা। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়েই ফ্যাশন উদ্যোক্তারা রাজপথেও নেমেছিলেন। গত কয়েক বছর কেন জানি না বৈশাখের আগে কোনো না কোনো জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে, যা উদ্যোক্তাদের কপালে ভাঁজ পড়ানোর জন্য যথেষ্ট। তবে মানুষ নানা হতাশার মধ্যেই মন ভালো করার জন্য উদযাপনের উপলক্ষ খুঁজে নেয়। এবারও তা ব্যত্যয় ঘটেনি। ফলে অবস্থাদৃষ্টে ভালোয় ভালোয় কাটছে সবকিছু।
তবে বৈশাখে এখনো আমাদের ফ্যাশন হাউসগুলোর জন্য বিদেশি পোশাক ততটা শঙ্কার কারণ হয়নি। কিন্তু পরিস্থিতি বদলাতে কতক্ষণ। এ জন্যই বিষয়টি সচেতনভাবেই খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কারণ, গত দুই বছরের পরিসংখ্যান বলছে, ভারত থেকে পোশাক আসছে বৈশাখ উপলক্ষে; এবারও পরিস্থিতির ব্যত্যয় হয়নি, তা বলা বাহুল্য। উদ্যোক্তাদের উৎসব-পরবর্তী প্রথম দায়িত্ব হবে বিষয়টি নিয়ে গভীরে খতিয়ে দেখা। বের করতে হবে : ১. এবার বৈশাখে কী পরিমাণ পোশাক এসেছে; ২. এসব পোশাক ফ্যাশন হাউসগুলোর বাজার দখল করেছে কি না; ৩. করলে তা কী পরিমাণ। পাশাপাশি নিজেদের আয়োজন ও তার আউটকাম নিয়েও পর্যালোচনা একান্ত জরুরি। তাহলেই ইন্ডাস্ট্রির প্রকৃত চেহারা উদঘাটিত হবে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্রে আলোচনায় সহায়ক হবে। এই পর্যালোচনা আসন্ন ঈদেও তাদের কার্যকরণ নির্ধারণে সাহায্য করবে।
তবে এফইএবিকে অবশ্যই দায়িত্ব নিতে হতে তার সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করার ক্ষেত্রে, যাতে কোনো হাউস তার পণ্যে ব্যবহৃত উপকরণের মান সব সময়েই নিশ্চিত করে। বিশেষত রং যে ভোক্তার অস্বস্তির বা অসুস্থতার কারণ না হয়। উৎসবের আনন্দ যেন ম্লান না হয়।
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আলাপ করা যাক। বৈশাখ এলেই আমরা বছরের আবর্জনা দূর করে নতুনের আবাহনে মেতে উঠতে চাই। কবির মতো আমরাও কেন জানি বলতে ভালোবাসি : হেথা হতে যাও পুরাতন,/ হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে। কিন্তু এও কি সম্ভব, পুরোনোকে ভুলে নতুনের পূজা। নতুন তো দাঁড়ায় পুরোনোর ভিতে। পুরোনো বছরের শেষ মাসের কয়েকটা ঘণ্টার সঙ্গে কী-ই বা পার্থক্য নতুনের। একটা উৎসব। সামান্য উদযাপনেই কি শেষ হয়ে যায় সবকিছু। নতুন বছরে আমাদের তো বাঙালি হিসেবে দায়িত্ব থাকে। কারণ, উদযাপনই তো শেষ কথা নয়। আর সেখানে তো সব শেষ হয়ে যায় না; বরং বাঙালিয়ানাকে সঠিকভাবে ধারণের মধ্যেই তো সার্থকতা। ইংরেজি নববর্ষে সবাই ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে বিভিন্ন অঙ্গীকার করে। আমরাও কি সেটা করতে পারি না। ফলাও করে প্রচার না করেও নিজের মধ্যে রেখেই সেটাকে আমাদের জীবনাচরণের অংশ করে নিতে পারি। পালন করতে পারি সারা বছর। কিংবা এমন কিছু বিষয় আছে যা বন্ধুদের, সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে পালন করা যেতে পারে।
আমরা ফ্যাশন নিয়ে কথা বলছি। তাই আমাদের যাপিত জীবনে কিছু বিষয় সম্পৃক্ত করতেই পারি। যেমন সপ্তাহের একটা দিন অফিসে মেয়েরা বাংলাদেশের তাঁতের শাড়ি পরেন। ছেলেরা ক্যাজুয়াল ডেতে দেশীয় ফ্যাশন হাউসের শার্ট পরতে পারেন। পার্টিতে মেয়েরা জামদানি পরলে আমাদের ঐতিহ্য সমুন্নত থাকে। একইভাবে সবাই যদি দেশি কাপড়কে পৃষ্ঠপোষকতা করি, তাহলে বাঁচে এসব শিল্প; বাঁচে ঐতিহ্য। আর বিদেশ নির্ভরতাও কমে। এমনকি এই পৃষ্ঠপোষণা নতুন নিরীক্ষা, গুণগত মান বৃদ্ধিকেও উৎসাহিত করে। এভাবে টিকে থাকে দেশ। প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে উদ্যোগ নিলে অবশ্যই বাংলাদেশ ব্র্যান্ডেড হবে। বিদেশিরাও বিষয়টি দেখে প্রাণিত হতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক, এটিএন নিউজ ও লাইফস্টাইল প্রফেশনাল