অব্যক্ত আর্তনাদ
আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন, গত ১৫ বছর ধরে কত মানুষ কী অমানুষিক যন্ত্রণা সহ্য করছেন? নিজের কষ্ট কাউকে না বলতে পারার যন্ত্রণা?? আমরা অন্যের কষ্ট বুঝি না, যতক্ষণ না সেটা আমাদের কাঁধে এসে পড়ে। এই কোটা আন্দোলন না হলে অনেক কিছুই অজানাই থেকে যেতো।
কেমন লাগবে যদি এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি কারাগারে যেতে হয় নিরপরাধ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে? আর যদি দেখেন, সেই ভাই নির্যাতনের ব্যথায় দাঁড়াতেই পারছে না, তবু নিজেকে শক্ত দেখাচ্ছে যে সে সুস্থ আছে।
চিন্তা করুন, বিয়ের ছয় মাসের মাথায় আপনার স্বামীকে যদি পুলিশ নাটক সাজিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে মেরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখে। অথবা রাত তিনটায় কল পেয়ে জানতে পারেন, দুই লাখ টাকা না নিয়ে গেলে স্বামীকে গুম করা হবে। তাহলে আইনের প্রতি বিশ্বাস মানুষের কোথায় যায়!!
একটা মেয়ে হয়ে যদি নির্দোষ স্বামীকে রিমান্ড থেকে বাঁচাতে আপনাকে দিনের পর দিন একা একা থানায়, কোর্টে এবং পুলিশ ও উকিলের কাছে ছুটতে হয়, কোনো অপরাধ না থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিন সম্পূর্ণ নতুন এক পৃথিবীর মুখোমুখি হতে হয়, লাখ লাখ টাকা নিয়েও পুলিশ যখন রিমান্ডে মারপিট করে, আবার টাকা চায়...যেখানে আপনাকে টেরা চোখে দেখা হবে, ভয় দেখানো হবে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রাখা হবে বাইরে। আর আপনি বাইরে থেকে শুনতে পাবেন কি নির্মম অত্যাচার করছে, চিৎকার শুনতে পাবেন কিন্তু আপনার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে দিবেনা শেষ পর্যন্ত, তবে আপনার কেমন লাগবে??
মা হিসেবে কেমন লাগবে যদি আপনার ছেলে কোনো অপরাধ না করা সত্ত্বেও গত ১১ বছর ধরে নিজের গ্রামে যেতে না পারে, মায়ের সঙ্গে নিজের বাড়িতে ১-২ রাত কাটাতে না পারেন। এটাকে কি মাতৃভূমি বলে!!
নির্যাতনের জন্য যদি হাঁটুর ব্যথায় আজও বসতে না পারেন, পায়ের নখ তুলে নেয়ায় এখনো কভার জুতা পরতে যদি অসুবিধা হয়?? ডজন খানেক ঔষুধের উপর নির্ভর করতে হয়! এর দায়ভার কার!!
যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক আদর্শের জন্য প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি একদিনের নোটিশে বন্ধ করে এক কাপড়ে দেশ ছাড়তে হলে আপনার কেমন লাগবে? তাহলে নিজের দেশে মেধা আর যোগ্যতার মূল্য কোথায়!!
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার মেধা তালিকায় প্রথম সারিতে থাকা একজনকে ভিন্ন আদর্শের জন্য যদি মারতে মারতে চার তলা থেকে নিচে নিয়ে আসে, কেমন লাগবে? আর যদি সেই মেধাবী ছাত্রকে মেরে ড্রেনের পাশে ফেলে রাখে তারই বন্ধুরা? তাহলে গণতন্ত্র কোথায় আর বন্ধুত্ব কোথায়!!
রাজনৈতিক কারণে বা বেহুদা ফেঁসে গিয়ে যে সকল মেধাবী ছাত্র ছাত্রত্ব হারিয়েছিল,ক্যাম্পাসে সীমাহীন লাঞ্ছনার শিকার হয়েছিল, যাদের সম্ভাব্য সুন্দর জীবন ওলট-পালট হয়ে গিয়েছিল-এর দায়ভার কে নেবে?
এতকিছুর পরও সেইসব মানুষগুলোকে সব অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছে। এমন হাজারো চাপানো ব্যথা নিয়েও সেইসব মানুষগুলো কেবল হাসিমুখেই থেকেছেন সবার সামনে আর বাংলাদেশের কথাই ভেবেছেন। কিন্তু সেসব কষ্টগুলো কেউ মুছে দিতে পারবে কোন দিন?
এত বছরের জমিয়ে রাখা এই কষ্টগুলো কাকে বলবে এই মানুষগুলো?? সারা দেশে এমন লাখ লাখ মানুষ আছে, যারা নিরবে কষ্টগুলো সহ্য করে গেছে। আর জায়নামাজে চোখের পানিতে শুধু আল্লাহর কাছে হাত তুলেছেন। এই যে এত মানুষের এত কষ্ট, টেনশন, নির্ঘুম রাত, মায়ের চোখের পানি, সেজন্য আরশে আজিম ৫ই আগস্ট ২০২৪-এ কেঁপে উঠেছে!
আল্লাহ আমাদেরকে বুঝার তৌফিক দিন এবং বাংলাদেশকে রহমত বরকত দান করুন।
কুরআনে বলা হয়েছে : আর ঘোষণা করে দাও, সত্য এসে গেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মিথ্যার তো বিলুপ্ত হওয়ারই কথা। (সূরা: বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৮১)
লেখক : সুমাইয়া জাফরিন চৌধুরী, মালয়েশিয়া।