সারা দেশে সতর্ক অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র, পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ ও বহিষ্কৃত ইসকননেতা চিন্ময়কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তারের পর আদালত জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রাম জজ কোর্ট এলাকায় সরকারি কৌঁসুলি সাইফুল ইসলাম আলিফকে কুপিয়ে হত্যা ও মসজিদে ভাঙচুরের ঘটনায় উত্তাল গোটা দেশ। চারিদিকে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় চলছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এমনকি এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দিয়েছে।
এসব ঘটনার পর অনেকেই দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কোথাও হামলা-ভাঙচুর হয় কিনা অনেকে এই আতঙ্কে আছেন। তবে তেমন পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা ও সব পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। তারপরও দেশে যেন কোনো ধরনের অনাকাঙিক্ষত পরিস্থিতি তৈরি না হয়, সেজন্য সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সতর্ক রয়েছে।
ইসকনের পাশাপাশি মসজিদ-মন্দিরের নিরাপত্তাসহ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যাতে সাম্প্রদায়িক বা উসকানিমূলক কোনো ঘটনা না ঘটে সে জন্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও হিন্দু ধর্মালম্বী স্থানীয় ও জাতীয় নেতাদের সঙ্গেও কথা বলেছে পুলিশ-প্রশাসন।
আজ বুধবার একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ সুপার ও দেশের কয়েকটি থানার কয়েকজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) সঙ্গে কথা বলে এনটিভি অনলাইন এসব তথ্য জানতে পেরেছে।
গত সোমবার (২৫ নভেম্বর) রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। পরে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার পর মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) বেলা ১১টার দিকে তাকে চট্টগ্রাম আদালতে মহানগর হাকিম ষষ্ঠ কাজী শরীফুল ইসলামের আদালতে তোলা হয়। শুনানি শেষে দুপুর ১২টা ২০ মিনিটের দিকে চিন্ময় কৃষ্ণকে প্রিজনভ্যানে ওঠানো হয়। তবে তার অনুসারীরা এ সময় বাধা দিলে প্রিজনভ্যানটি প্রায় তিন ঘণ্টা সেখানে আটকে থাকে। পরে পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে চাইলে বিকেল ৩টার দিকে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। তারা এ সময় আদালত এলাকার একটি মসজিদসহ বেশ কয়েকটি স্থাপনা ভাঙচুর করে। এ সময় আদালতের সরকারি কৌঁসুলি সাইফুল ইসলাম আলিফকে প্রথমে পিটিয়ে এবং পরে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে ও লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে চিন্ময় কৃষ্ণকে চট্টগ্রাম কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানা স্থানে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশ সাম্প্রদায়িক সংঘাতে রূপ নিতে পারে। কেউ কেউ বলেন, আইনজীবী হত্যার ঘটনায় নিরীহ হিন্দু ধর্মালম্বীদের বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হলো।
ফেসবুকে প্রদীপ দাস নামের একজন লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে নতুন এক বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছে। এই বিপদ থেকে তাদেরকে সুরক্ষা দেওয়ার ভালো উপায় হলো, যারা এই হত্যার সঙ্গে জড়িত, তাদের শনাক্ত ও বিচার করা। হত্যাকারীরা যে ধর্ম বা দলেরই হোক না কেন, তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এতে শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে না, তা সবার জন্যই মঙ্গলের হবে।’
আদালতপাড়ার কাছের মসজিদে ভাঙচুর ও আইনীজীবীকে হত্যার ঘটনার পর আক্ষেপ করে নাদিম এইচ খান নামের আরেক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘আমরা মন্দির পাহারা দিলাম। আর আপনারা মসজিদ ভেঙে দিলেন। আমাদের ভাইকে হত্যা করলেন!’
এদিকে সাইফুল ইসলাম আলিফকে হত্যার প্রতিবাদ এবং ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বৃহত্তর উত্তরা উলামা পরিষদ। এ সময় ইসকনকে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন আলেমরা। শুধু এখানে নয়, সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে একই দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে।
আন্তর্জাতিক উগ্রপন্থী সংগঠন দাবি করে চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ এনে ইসকনকে নিষিদ্ধের দাবিতে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন কয়েকজন আইনজীবী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বরাবরে ডাকযোগে এই নোটিশ পাঠানো হয়েছে। আজ বুধবার (২৭ নভেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আল মামুন রাসেল ১০ আইনজীবীর পক্ষে এই নোটিশ পাঠান।
এদিকে মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) বিকেলে ইসকন বাংলাদেশ এক বিবৃতিতে জানায়, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের কর্মসূচির সঙ্গে ইসকনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। ইসকন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ইসকনের এ অবস্থান জানানো হয়।
অপরদিকে আজ বুধবার দুপুর ১টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজে এক পোস্টে উল্লেখ করা হয়, আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে ৬ ইসকন সদস্যকে শনাক্ত করা হয়েছে।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সব পক্ষকে শান্ত থাকার ও ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। এদিকে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পুলিশের সব পর্যায়ের ইউনিটকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। পেশাদারিত্বের সঙ্গে আইনানুগ দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে পুলিশ কাজ করছে।’
চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানা এলাকায় আদালতপাড়া অবস্থিত। যে স্থান থেকে মূলত এসব সংঘাতের সূত্রপাত। এখানে সরকারি কৌঁসুলি সাইফুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
সেখানকার সবশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বুধবার রাতে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফজলুল কাদের চৌধুরী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমার থানা এলাকার প্রতিটি মোড়ে মোড়ে পর্যাপ্ত পুলিশসহ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। তারপরও আমরা শঙ্কায় আছি, কখন কি না জানি হয়ে যায়! মসজিদে হামলা ও কৌঁসুলিকে হত্যা করা হয়েছে। ফলে, এসব অভিযোগের সন্দেহে কখন কাকে গণপিটুনি দেওয়া হয় বা ধরে মারধর করা হয়; আমরা সেই ভয়ে আছি। তবে, এখন পর্যন্ত কোনো জটিলতা তৈরি হয়নি। আশা করছি, আস্তেধীরে পরিস্থিতি শান্ত হবে। আমরা এখন পর্যন্ত ২৭ জনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছি।’
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরা জেলা মূলত জামায়াত-বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা। এ জেলার তালা থানায় ১৩০টির বেশি মন্দির রয়েছে। তালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ শাহিনুর রহমান বলেন, ‘আমরা হিন্দু ধর্মালম্বীদের সঙ্গে কথা বলছি। কোথাও কোনো অসুবিধা বা আশঙ্কা করলে যেন আমাদের জানান, সে অনুরোধ জানিয়েছি। আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছি। গোয়েন্দা পুলিশও কাজ করছে।’
সাতক্ষীরা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘সাতক্ষীরায় যেন কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ছড়িয়ে না পড়ে, বা মন্দির-মসজিদে হামলার ঘটনা না ঘটে, সেজন্য আমরা সতর্ক রয়েছি। আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে সাতক্ষীরা জেলায় কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটবে না বলে আমার বিশ্বাস। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। আশা করছি পরিস্থিতি শান্ত থাকবে।’
মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আজ বুধবার ইসকন সাতক্ষীরায় একটি সমাবেশ করতে চেয়েছিল। আমি তাদের আমার কার্যালয়ে ডাকি। তাদের বলি, আপনাদের কোনো দাবি থাকলে লিখিতভাবে জানাতে পারেন। আমরা সংশ্লিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিব। তখন ইসকন নেতারা বললেন, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর মুক্তির দাবিতে তারা একটি স্মারকলিপি দিতে চান। তারা স্মারকলিপি দেবেন। এ ছাড়া আজ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ইসকন ও জামায়াত-বিএনপিসহ কায়েকটি রাজনৈতিক দলকে ডাকা হয়েছিল। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার ও আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যা সংক্রান্ত ব্যাপারে তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে।’
যশোর জেলার পুলিশ সুপার মো. জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘যশোরে যেন কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে, সেজন্য আমরা সতর্ক রয়েছি। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছি। পুলিশি তল্লাশি চৌকি জোরদার করা হয়েছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, যেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো অবনতি না হয়।’
দেশের বিভিন্ন জেলাসহ ঢাকা মহানগর এলাকায়ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি জোরদার করা হয়েছে।
রাজধানীর ডেমরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হক বলেন, ‘যখন এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তখন আমরা একটু সাবধান হয়ে যাই। চট্টগ্রামে একটি ঘটনা ঘটেছে, আমরা বেশি সতর্ক অবস্থান নিয়েছি। যেন কোনো মন্দিরে বা এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানে হামলার মতো ঘটনা না ঘটে। এ ছাড়া মোড়ে মোড়ে নিয়মিত চেকিং কার্যক্রমও চলমান।’
টঙ্গি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রাহাত খান বলেন, ‘আমরা সতর্ক রয়েছি। যেন সাম্প্রদায়িক উসকানির কারণে কোনো ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা না ঘটে। কাউকে সন্দেহ হলে আমাদের নিয়মিত তল্লাশি চৌকিগুলোতে তল্লাশি করা হচ্ছে।’