গুলশান ট্র্যাজেডি
জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ প্রয়োজন
বিশ্ব মানবতার জন্য এটি খুব দুর্ভাগ্য ও হতাশার বিষয় এই যে ধর্মের নামে চরম অধর্ম করে কোনো কোনো গোষ্ঠী নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য ধর্মীয় জঙ্গিবাদের দীক্ষা ছড়িয়ে দিতে চাইছে। মধ্যযুগে রোমান পোপরা নিজেদের ইহজাগতিক ও পারলৌকিক উভয় ক্ষমতা ধরে রাখতে পবিত্র বাইবেলের বিকৃত ব্যাখ্যা করে খ্রিস্টান বিশ্বকেই বিভ্রান্তিতে ফেলেছিলেন। যার প্রতিক্রিয়ায় ধর্মের পবিত্রতা রক্ষা করতে গিয়ে মানবতাবাদী খ্রিস্টান সাধুসন্তরা চার্চ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। মঠ প্রতিষ্ঠিত করে পবিত্র বাইবেলের আদর্শ সমুন্নত রাখার চেষ্টা করেছেন। খ্রিস্টান ধর্মের মানবিক দর্শন নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন বিশ্বময়। এগার শতকে কর্নাট থেকে আসা ব্রাহ্মণ শাসকদের হাতে চলে গিয়েছিল বাংলার শাসনক্ষমতা।
সাধারণ বাঙালি যাতে এদের অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে না পারে, তাই বর্ণ বিভাজন করে সাধারণ হিন্দু বাঙালিকে শূদ্র বলে কোণঠাসা করে রাখল। ধর্মের দোহাই দিয়েই তাদের অধিকার বঞ্চিত করল। নানাভাবে নির্যাতন করতে লাগল ধর্মের কথা বলেই। ধর্মগ্রন্থ পড়ে শাসকদের এসব মনগড়া ব্যাখ্যার কথা যাতে ফাঁস হয়ে না যায় তাই শূদ্রের জন্য ধর্মগ্রন্থ পাঠ নিষিদ্ধ করা হলো। অনেক কাল পরে ইসলামী জঙ্গিবাদীরা একইভাবে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা এনে কিছু সংখ্যক মানুষ বিশেষ করে তরুণদের বিভ্রান্ত করছে। কোরআন হাদিসের প্রকৃত ব্যাখ্যা থেকে দূরে রেখে নিজেদের বিভ্রান্ত নেতাদের আদর্শ প্রচার করা জিহাদি বইয়ের মধ্যে আটকে রাখছে তরুণদের। ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা শোনাচ্ছে। মানুষ খুন করে বেহেস্তের পথ দেখাচ্ছে। এভাবে মগজ ধোলাই করে হাতে অস্ত্র দিয়ে এদের পাঠাচ্ছে মানুষ খুন করতে। এরা বুঝতেও পারল না সুবিধাবাদী বড়ভাই বা ওস্তাদরা ওদের জান্নাতের লোভ দেখিয়ে জাহান্নামের দরজায় পৌঁছে দিল। একবারও ভাবল না তাদের দীক্ষাদাতারা একবারও জান্নাতে যাওয়ার জন্য মাঠে নামছে না। মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে এসব বিভ্রান্ত তরুণদের।
এমনি কয়েকজন মগজ ধোলাই হওয়া জঙ্গিবাদে দীক্ষা পাওয়া তরুণ ইসলামী অনুশাসন না মেনে পবিত্র রমজান মাসে তারাবিহ নামাজ না পড়ে মানুষ খুন করতে জড় হলো গুলশানের কূটনীতিকপাড়ার এক স্পেনিশ রেস্টুরেন্টে। যে মানুষদের হত্যা করার জন্য এলো তাদের সম্পর্কে আগে থেকে কোনো ধারণা ছিল না জঙ্গিদের। অর্থাৎ এমন কোনো অভিযোগ নেই যে এরা ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে কোনো অন্যায় কথা বলেছে। লাঞ্ছিত করেছে ধর্মকে। এই তরুণরা দেশি-বিদেশি নিরীহ মানুষদের জিম্মি করে কোনো দাবি আদায় করতে চেয়েছে তেমনও নয়। এমন নয় যে, এই জিম্মিরা একসময় জঙ্গিদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে পড়েছিল যে বাধ্য হয়ে তাদের খুন করতে হয়েছে। কোরআন-হাদিসের আলোকে সবচেয়ে বড় পাপের কাজ তারা করেছে। ঠান্ডা মাথায় খুন করেছে পঁচিশ-ছাব্বিশজন মানুষকে। এদের বড় অংশই বিদেশি। যারা চাকরি বা ব্যবসায়ের কারণে এদেশে বসবাস করছিল। রাতের খাবার খেতে এসেছিল রেস্টুরেন্টে।
মহানবীর শিক্ষা থেকে আমরা জানি নিজের জীবন বিপন্ন করে হলেও অতিথিকে রক্ষা করার নির্দেশনা আছে। সে অতিথি বিধর্মীও হতে পারে। এ বিদেশিরা তো এ দেশের অতিথিই ছিল। অথচ ঠান্ডা মাথায় খুন করল অতিথিদের। এ ছাড়া এই দেশেরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যারা কর্তব্য পালন করতে এসেছিল তেমন ধর্মপ্রাণ মুসলমান দুজন পুলিশ অফিসারকে খুন করেছে। তাদের সন্তানদের অনাথ করেছে। স্ত্রীদের বিধবা করেছে। আত্মীয়-পরিজনদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে। বুলেটে আর বোমা ছুড়ে অনেককে আহত করেছে। সবশেষে নিজেদের জীবনকেও ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর পথে। এটি আত্মহত্যা। অথচ আত্মহত্যাকে মহাপাপের কাজ বলে সতর্ক করে দিয়েছে পবিত্র কোরান। ইসলামের যুদ্ধের ময়দানেও নারীদের হত্যা না করার নির্দেশ আছে অথচ এই তরুণরা বিদেশি নারীদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এরা শান্তি ও মানবতার ইসলামকে বিশ্ববাসীর সামনে অমানবিক, হিংস্র ও উগ্রবাদী ধর্ম হিসেবে পরিচিত করেছে। অর্থাৎ এদের প্রতিটি কাজ হয়েছে ইসলামের দৃষ্টিতে চরম অন্যায় ও পাপের কাজ। মানবতার কথা তো বাদই দিলাম।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশ যেদেশে মোট জনসংখ্যার সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসলমান বাস করে। দীর্ঘকাল ধরে শান্তিতে ধর্ম নির্বিশেষে সবাই একসঙ্গে বাস করে আসছিল। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে যে দেশের সুনাম ছিল, সে দেশকে কলঙ্কিত করে আরেকটি পাপের কাজ করল তরুণরা। তারা হয়তো জানতেও শেখেনি যে ইসলাম ধর্মে দেশের প্রতি ভালোবাসাকে ইমানের অঙ্গ বলেছে।
কিন্তু সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কথা হচ্ছে, নানা পরিচয়ে জঙ্গি নামধারী এসব বিভ্রান্ত সন্ত্রাসী তরুণের সংখ্যা বাড়ছে। নিরীহ মানুষ খুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। অথচ পবিত্র কোরআনেই আছে কে পাপী আর কে পুণ্যবান তা নির্ধারণ করবেন মহান আল্লাহ। তিনিই একমাত্র মানুষকে শাস্তি দেওয়া বা ক্ষমা করার অধিকার রাখেন। কিন্তু মগজ ধোলাই করা এই বিভ্রান্ত তরুণরা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাকে ধারণই করতে পারছে না। দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে।
এই বাস্তবতা সামনে রেখে আজ এ দেশের সব মানুষকেই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। গুলশান ট্র্যাজেডির পর এই ঐক্যের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষও এই ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। এ শুধু রাজনৈতিক দলসমূহের ঐক্য নয়। মানবিকতাবিরোধী ধর্মবিরোধী জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সবার মানসিক ঐক্য। বিভিন্ন সংকটের সময়ে ঐক্যের কথা এলে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যের কথা বোঝাতে চাই। এর অবশ্য মূল্য রয়েছে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এ দেশে তেমন ঐক্য গড়ে ওঠা কঠিন। কারণ বড় দাগে দেখলে দুটো জোটে ভাগ হয়ে গেছে রাজনীতি। একটি জোটে মৌলবাদী দল এবং বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত দল রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এসব দলের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদ উসকে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তাই জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানে এসব দলের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখা কোনো পক্ষ আমন্ত্রিত হবে না এটি বলাই বাহুল্য।
আমি মনে করি না, আজকের এই সংকটের সময় কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ঐকমত্যের প্রয়োজন রয়েছে। যেসব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধভাবে জঙ্গিদের প্রতিহত করতে চায় তারা যার যার অবস্থানে থেকে সে লড়াইটি চালিয়ে যেতে পারে। রাজনৈতিক দল সংশ্লিষ্ট নন এমন অসংখ্য মানুষ আছেন যাদের মানসিক ঐক্যও জঙ্গিবাদকে প্রতিহত করতে ভূমিকা রাখতে পারে। জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্য কোনো শক্তি নয় যে একসঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে তাদের প্রতিহত করব। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের পদ্ধতিমতো ভূমিকা রাখছে এবং রাখবে। আমরা যার যার অবস্থানে থেকে তাদের তথ্য দিয়ে সতর্ক থেকে ভূমিকা রাখতে পারি। নিজ নিজ পরিবার ও প্রতিবেশের প্রতি নজর রেখে সতর্ক থাকতে পারি যাতে আপন সন্তান, ভাই বোন, বা নিজেদের অতিপরিচিত পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে জঙ্গি শিক্ষা নিয়ে কোনো করুণ বিভ্রান্ত হতে না পারে। প্রশিক্ষিত জঙ্গিরা তো ঘাপটি মেরে আছে আমাদের চারপাশে। আমাদের সব মহলের তীক্ষ্ণ নজরদারিতে এদের স্বরূপ উন্মোচিত হতে পারে। এভাবে আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে এদের মূলোচ্ছেদ করতে পারি।
এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ধর্মের অপব্যাখ্যা করে ভুল বুঝিয়ে তরুণদের বিভ্রান্ত করে চরম পাপের পথে যারা নামাচ্ছে, তাদের প্রতিরোধ করা। এরা দৃশ্যমান শক্তি নয়। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে হলে পারিবারিক সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মানবিকতাকে সবার সামনে নিয়ে আসতে হবে। কোরআন হাদিসের আলোকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাকে সবার সামনে উন্মোচিত করতে হবে। কোন প্রেক্ষিতে সুফিসাধকরা ইসলামের মানবিকতার বাণী ও আল্লাহ প্রেমের কথা বলে এ দেশের মানুষের মন জয় করে ইসলাম প্রচার করেছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন স্কুল ও মাদ্রাসার পাঠক্রমে তা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কোরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যা করে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী যে ধর্মকে বিকৃত করছে, ইমানি কর্তব্যের কথা বলে তরুণদের যে মহাপাপের পথে নামাচ্ছে এই সত্যটি কোরআন ও হাদিসের মাধ্যমেই স্পষ্ট করতে হবে। আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে রেস্টুরেন্টে নিরীহ মানুষ খুন করার মতো ঘোরতর পাপ যে ইসলাম ক্ষমা করে না তা প্রচার করতে হবে। ‘জিহাদ’ শব্দের প্রকৃত তাৎপর্য কী তা কোরআনের আলোকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে। ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতাকে পুঁজি করেই কিন্তু অপশক্তি তরুণদের মগজ ধোলাই করতে পারছে।
প্রকৃত শিক্ষাই চারপাশ আলোকিত করতে পারে। আমরা ঐক্যবদ্ধ চেতনা নিয়ে যদি যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারি, তাহলে অসাম্প্রদায়িক চেতনার শক্ত ভিত্তিতে গড়া এদেশের মাটিতে জঙ্গিবাদের মূল উৎপাটন করা সম্ভব।
লেখক : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।