সোজা কথা
তরুণদের নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে
ঠিক যেন রূপকথার গল্প । একটি দেশের মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করত । নেচে গেয়ে খেয়ে না খেয়ে তাঁরা শান্তিতে ঘুমাত । এক সময় দেশের তরুণরা হাসিমুখে স্কুল-কলেজে যেত, গানবাজনা করত, মাঠে কাদামাটি মেখে খেলাধুলা করত,বাড়িতে মা-বাবা ভাইবোনের সাথে খুনসুটিতে সময় কাটাত, আবার কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেই সদাচঞ্চল ডানপিটে ছেলেগুলো বন্ধুরা মিলে দেশের মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াত। এমন নয় যে দেশটিতে কোনো চোরছ্যাচোর নেই,তাও ছিল । ডাকাতি খুন রাহাজানিও হতো। ঝগড়া মারামারিও ছিল । আবার কোনো উৎসব পার্বণ এলেই ধর্মের ভেদাভেদ থাকত না । সবকিছু ছাপিয়ে সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে উদযাপন করত। একদিন হঠাৎ কী হলো। সবকিছু উলটে পাল্টে গেল। দেশে জঙ্গি। সদা হাস্যোজ্জ্বল তরুণদের কী করল জঙ্গিরা কে জানে। তরুণরা আর হাসে না, কঠিন মুখে তারা মানুষ খুন করতে লাগল।
মা-বাবা হতবাক হয়ে কথা হারিয়ে ফেলল, যে ছেলে একটা পোকা মারতে ভয় পায় সে কি না এমন নির্বিচারে মানুষ মারছে! ছোট্ট বোনটি ভাবার শক্তি হারিয়ে ফেলল তার ভীতু ভাইটি গায়ে তেলাপোকা ছেড়ে দেওয়ার কথা বললে দৌড়ে মার আচলে লুকাতো সে কি না মানুষ জবাই করছে! এও কি সম্ভব? সে দেশের মানুষ আর ঘুমাতে পারে না, যাদের ছেলেরা জঙ্গি হয়নি তারাও ছেলেদের দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকায়...গল্পটা আর গল্প নেই, এখন এটাই আমাদের দেশের চিত্র। এ দেশে নৃশংস খুন হয়েছে, এক্সিডেন্ট হয়েছে, ঝড় জলোচ্ছ্বাস হয়েছে, এ দেশের তরুণরা মাদকের নেশায় নিজেদের শেষ করে দিয়েছে কিন্তু এভাবে পরিকল্পনা করে ১৭ জন মানুষকে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছে তরুণরা, এমন দিনও দেখতে হবে তা কেউ ভাবেনি। সারা দেশে বিদেশি হত্যা, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ধর্মগুরু হত্যা, সাধারণ মানুষ হত্যার একের পর এক ঘটনার কূল কিনারা যখন করতেই পারছিলেন না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা, সেই সময় গুলশানে জঙ্গি হামলা সবকিছু আরো বেশি গোলমাল করে দেয়।
সাম্প্রতিক সময়ের জঙ্গিহামলার ঘটনাগুলকে রাজনৈতিক একটি রূপ দেয়ার চেষ্টা ছিল সরকারের পক্ষ থেকে। জঙ্গি দমনের নামে সাঁড়াশি অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তবে বিষয়টি বিতর্কিত হয়ে যায় যখন দেখা যায় জঙ্গি যত না ধরা পড়েছে তারচেয়ে বেশি গ্রেপ্তার করা হয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক মতার্দশের লোক আর সাধারণ মানুষকে। এই সাঁড়াশি অভিযান কতটা অসার তার প্রমাণ মিলে কিছুদিনের মধ্যে গুলশান হামলার ঘটনায়। সর্বোচ্চ নিরাপত্তাবেষ্টিত কূটনৈতিকপাড়ায় বিনাবাধায় ঢুকে কী তাণ্ডব চালাল কয়জন তরুণ। সারা বিশ্বের কাছে যে বাংলাদেশ গর্বভরে বলত, আমাদের তরুণেরাই সেরা। এরাই ৭১ এ দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল, এই তরুণরাই একুশ শতকের ইমার্জিং বাংলাদেশের প্রতিনিধি, তারাই কি না এমন ঘটনা ঘটাল!
আমরা যদি সাম্প্রতিক সময়ের জঙ্গি হামলার ঘটনাগুলো একের পর এক সাজাই, এতে এক ধরনের কাঠামো দেখা যায় । যেমন প্রথমেই যদি বলি ফয়জুল্লাহ ফাহিম নামের কিশোরটির কথা। কিশোর ফয়জুল্লাহ ফাহিম চিনত না রিপন মণ্ডলকে। অথচ মাদারীপুরের সরকারী নাজিমউদ্দিন কলেজের এই শিক্ষককে হামলা করে সে, কোনো রকম ব্যক্তিগত আক্রোশ ছাড়াই। চেনে না জানে না যে মানুষটিকে এবং ফাহিম কোনো ভাড়াটে খুনিও নয়, তাহলে কেন সে নৃশংসভাবে মারল রিপন মণ্ডলকে? পুলিশের কাছে ফাহিম বলেছে, ‘আমি যা করেছি তা আল্লাহ ও ইসলামের জন্যই করেছি।’ কোথায় আল্লাহ বলেছেন তার সৃষ্টিকে ধ্বংস করতে, এতে ইসলাম রক্ষার তরিকাটিই বা কী? এসব কিছুরই উত্তর নেই ফাহিমের কাছে। তার মাথায় শুধু ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ওপরের নির্দেশ যেমন আসবে, কোনো প্রশ্ন ছাড়াই তা পালন করতে হবে। আর এতে জান্নাত হাতের মুঠোয় চলে আসবে । কী অদ্ভুত!
পুলিশের কাছ থেকে জানা গেছে, কোনো কারণে ফাহিম ডিসটার্বড ছিল। এই বিষয়টি শেয়ার করতে গিয়েই জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সক্রিয় সদস্য জুবায়ের আহমেদদের পাল্লায় পড়ে সে। পরে তার হাত ধরেই ফাহিম হিযবুত তাহরীর সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে । এরপর দীর্ঘ সময় ধরে তার মগজ ধোলাই করা হয়। শেষ পর্যন্ত বিদেশ যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে কিছু দিন আগে উধাও হয়ে যায় কিশোর ফাহিম। এর পরই অঘটন।
কেবল ফয়জুল্লাহ ফাহিম নয় এর আগে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যার ঘটনার সময় যে দুজনকে জনতা হাতেনাতে ধরে ফেলে তারাও বয়সে কিশোর। তাদের একজন জিকরুল্লাহ ও আরিফুল। এ ছাড়া ব্লগার রাজীব হত্যার ঘটনায় যাদের ফাঁসি হয়েছে তারাও বয়সে তরুণ। সর্বশেষ হলি আর্টিজান বেকারীতে জঙ্গি হামলাকারী তরুণদের কথা এখন সবাই জানে। এই জঙ্গি তরুণদের পরিচয় বেরিয়ে আসার পর থেকে সবাই নড়েচড়ে বসেছে। কারণ এখানে আবারো বেরিয়ে এসেছে আমাদের রক্ষক অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদাসীনতা আর অবহেলা কিংবা বলা যায় দেশে জঙ্গি নিয়ে সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন থাকলেও তাদের নির্লিপ্ততা। দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ ছেলেদের খবর নিতে যে অভিভাবকরা এত দিন থানায় থানায় ধরনা দিয়েও কোনো পাত্তা পাননি। এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই খুঁজে খুঁজে নিখোঁজদের তালিকা করছে। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যদি সচেতন হওয়া দুরে থাক, অন্তত তাদের কাজে সামান্যতম মনোযোগী হতেন আজ সারাদেশকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ত হতে হত না । নিখোঁজদের খোঁজ নেয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন থেকেছেন তারা । তার বড় প্রমাণ গুলশান হামলার জঙ্গী রোহান । রোহান ইমতিয়াজ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা এস এম ইমতিয়াজ খান বাবুলের ছেলে । রোহান বাড়ি ছেড়েছিল গত ৩১ ডিসেম্বর । ছয় মাস পার হলেও তার কোনো হদিস বের করতে পারেনি পরিবার । ছেলেকে খুঁজে পেতে মোহাম্মদপুর থানায় জিডি করেছিলেন বাবা । পুলিশ-র্যাবের কাছেও ছোটাছুটি করেছেন । কিন্তু খোঁজ মেলেনি । শেষ পর্যন্ত রোহানের খোজঁ পেল তার পরিবার। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারীতে হামলাকারীদের একজন যার লাশ মিলল পরিবারের। একই রকম পরিণতি হয়েছে মীর হায়াত কবিরের ছেলে মীর সামিহ মোবাশ্বেরের ক্ষেত্রেও। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে নিখোঁজ ছিল সে। গুলশান থানায় জিডি করেছিলেন বাবা। ছেলের খোঁজ পেতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও শরণাপন্ন হয়েছেন। কোথাও মোবাশ্বেরকে পাওয়া যায়নি। রোহানের সঙ্গে মোবাশ্বেরও আর্টিজান বেকারিতে হামলায় অংশ নিয়েছে।
প্রথম প্রথম জঙ্গি কর্মকাণ্ডে মাদ্রাসাছাত্রদের জড়িত থাকার কথা শোনা গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা এখন ছড়িয়ে পড়ছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতেও। এটি একটি নতুন ট্রেন্ড। বিশেষজ্ঞরা এখন মাথা ঘামাতে শুরু করেছেন কেন এসব ঘটছে। মোটামুটি একটা ছক যদি দাঁড় করানো যায় তাহলে আমরা দেখি, বিভিন্ন সামাজিক বৈষম্য, সঠিক শিক্ষার অভাব, শিক্ষিত তরুণদের প্রত্যাশিত কর্মসংস্থানের অভাবই তরুণ ও কিশোরদের জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত করছে । তবে সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ছে ইন্টারনেটের। ফেসবুক থেকে শুরু করে নানা মাধ্যমে ধর্মের অপব্যাখ্যা চলছে। কিশোর-তরুণ হচ্ছে এর প্রধান শিকার। তা ছাড়া বাবা-মা তাদের সন্তানদের দিকে সেভাবে নজর দিতে পারছেন না নানা ব্যস্ততার কারণে। তারা কার সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, কী করছে এসব দিকে খেয়াল না করার মাশুল দিতে হচ্ছে সমাজকে ।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও শিক্ষার্থীদের ওপর সেভাবে নজর রাখছে না। এক সময় বাংলাদেশে মাদ্রাসাপড়ুয়া ছাত্ররা জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ত। এখন বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইংলিশ মিড়িয়াম স্কুল-কলেজের ছাত্রদের অনলাইনসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে উৎসাহী করছে। জঙ্গিরা এই তরুণদের ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্ত করছে। গুলশানে হামলাকারীদের একজন নিব্রাস ইসলাম ইন্টারনেটের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের খবরগুলো নিয়মিত পেতেন । তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্ট ঘেঁটে এসব তথ্য জানা গেছে। নিব্রাস টুইটারে ব্রিটিশ নাগরিক আনজেম চৌধুরীকে ফলো করতেন। আনজেম চৌধুরী মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের সমর্থক। সশস্ত্র জিহাদের পক্ষে তিনি বক্তৃতা-বিবৃতি ও লেখালেখি করে থাকেন। আইএসের পক্ষে কথা বলার দায়ে তিনি বর্তমানে ব্রিটেনে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন ।
এখন চিন্তার বিষয় কেন তরুণরা জঙ্গি হতে উৎসাহী হচ্ছে। সরকার মসজিদগুলোতে জঙ্গিবিরোধী খুতবা দিতে পরার্মশ দিচ্ছে, স্কুল-কলেজগুলোতেও জঙ্গিবিরোধী প্রচারণা চালানো শুরু হয়েছে কিন্তু দেশে জঙ্গিবাদের শিকড় অনেক গভীরে। আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের প্রভাব পড়ছে আমাদের দেশে। এর থেকে বাঁচার পথ নিশ্চয়ই বের করবেন বিশেষজ্ঞরা। তবে আমার মতো সাধারণ মানুষরা এখন অনেক কষ্টের মধ্যে আছি। আমি আমার কৈশোর পেরোনো ভাইপোর দিকে এখন অবিশ্বাসের চোখে তাকাই। কার সাথে মিশছে, ওর বন্ধু কারা ইত্যাদি ভাবতে থাকি। ও আজকাল কী নিয়ে ব্যস্ত আছে জানতে চাওয়ায় লাজুক হেসে ভাইপো আমার হাতে একটি স্বনামধন্য ইংরেজি পত্রিকা তুলে দেয় যাতে ওর লেখা গল্প বেরিয়েছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। আমার ভাইপো এখনো স্বপ্ন দেখে, ও গড়তে চায়, ধ্বংস করতে নয়। আমার মনে হয় তরুণদের স্বপ্ন দেখাতে হবে। বাকিটা না হয় আমরা সবাই মিলেই একটু ভাবি ।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, এনটিএন নিউজ