রিও’র ডায়েরি
অলিম্পিকের শহরে প্রথম দিন
ইন্টারনেটে সুযোগ দেখে আবেদন, তারপর বেশ কয়েকটি পরীক্ষা দিয়ে স্বপ্নপূরণ। রিও ডি জেনিরোতে চলমান অলিম্পিকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। মালয়েশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে ইনফরমেশন টেকনোলজি বিষয়ে অধ্যয়নরত এই বাঙালি তরুণ অলিম্পিকে নিজের চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা জানিয়ে লিখছেন এনটিভি অনলাইনের জন্য।
অনেক ঝামেলার পর কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্ট থেকে রিও-তে আসার পর নতুন ঝামেলা হলো বাসার কুকুরটা। মালিক এটিকে পাশে নিয়ে ঘুমান। কিছু বলতেও পারি না, আবার ব্যাপারটা খুব একটা স্বস্তিরও নয়। সকাল সকাল অলিম্পিক পার্কের ট্যুরের পর শপিং শেষে বাসায় আসার পর নতুন ঝামেলা এই কুকুর। ঘরের থেকে মাথা বের করে ডানে বামে তাকাই। কুকুর আছে নাকি? গ্রিন সিগন্যাল পেলে পরে সামনে যাই। ভয়ে ভয়েই থাকি।
যাহোক, এই কুকুরটি এখনো তেমন ভীতিকর কিছু করে বসেনি বটে, তবে আমার ভয় এখনো ঠিক কাটেনি। এরই মধ্যে সময় সুযোগ বুঝে টিম লিডারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইউনিফর্ম জোগাড়ের বিষয়ে জেনে নিলাম। উইন মেইলে বিস্তারিত উত্তরও দিলেন। এবার মিশন ইউনিফর্ম কালেকশন।
আমার মেইলটা ছিল এ রকম—‘তুমি অলিম্পিক পার্কের ঠিক সামনে থেকেই বাস নেবে। বাসের নাম্বার ৬১৩।’ আমি গিয়ে দেখি, অলিম্পিক পার্কের সামনের রাস্তা আমাদের দেশের সংসদ ভবনের সামনের মানিক মিয়া এভিনিউয়ের মতো। যাই হোক, একজনকে জিজ্ঞেস করলাম। ‘অনিবুস’ (ব্রাজিলে বাসকে অনিবুস বলে, এটা আমার শেখা প্রথম পর্তুগিজ শব্দ)? তিনি আমাকে হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিলেন ওদিকে যাওয়ার জন্য। আমি ওদিকে যাওয়ার পর দেখি আমার মতো ভলান্টিয়ার এক লাতিন আপা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। গিয়ে বললাম, ‘এক্সকিউজ মি, ডু ইউ ইস্পিক ইংলিশ (এক্কেবারে বাঙালি সাউন্ডে, আমার ইংলিশ এখন টিপিকাল বাঙালির মতো)? উত্তরে চমকালাম, ‘আয়্যাম ফ্রম স্টেটস!’ আমি তাঁর কাছে জানতে চাইলাম বাস কোথা থেকে ছাড়ে? তিনি আমাকে ইশারায় দেখিয়ে দিলেন। আমি এদিক ওদিক খুঁজি কিন্তু বাসস্টপের কোনো আলামত পাই না। পরে তিনি বললেন, ‘সামনে মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ওটাই বাসের লাইন।’ আমিও গেলাম। বাসের নাম্বার ৬১৩, আমি যেতে যেতেই বাস এলো। উঠে ভাড়া দেয় কীভাবে সে আবার আরেক হাঙ্গামা। যাই হোক, আন্দাজের ওপর ১০ রিয়ালের নোট দিলাম, যেন আমাকে বাকিটা ফেরত দিতে পারে।
দেলকাস্তিলহো/নোভা আমেরিকা স্টেশনে নামলাম। সেখান থেকে সাবওয়ে করে রিও সেন্ট্রাল যেতে হবে। কিন্তু আমি কিছুই চিনি না। কেউ ভাষাও বোঝে না। একেবারে মহা মুসিবত অবস্থা। গুগল করলাম কিন্তু ভুল বানানে। দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় থেকে বানানেও এর প্রভাব। কুয়ালালামপুর সেন্ট্রাল বলে একটা জায়গা আছে, যেটাকে KL Sentral লেখেন, Central না! মালয়তে বানান এমনতরই। আমিও একই বানানে রিও সেন্ট্রাল লিখে সার্চ দিলাম। কিন্তু কিছুই শো করে না গুগল ম্যাপে। পরে গুগলে সার্চ দেওয়ার পর এলো আসল বানান। একা একাই হাসলাম। কার্ড করে সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনের দিকে। সামনে ভেন্ডিং মেশিন দেখলে আমার আবার লোভ যায় না। টাকা ঢুকালাম, কাজ করে না। আসলে পর্তুগিজে লেখা। আগামাথা কিছু বুঝি না। কী না কী লেখা কে জানে। ট্রেন চলে এসেছে, তাই টাকা না নিয়েই দৌড়। সেন্ট্রাল নেমে আর কিছুই বুঝি না। ওপরে ওঠার ওপরই আছি। জিজ্ঞেস করলাম কেউ বোঝে না। এর মধ্যে আমার টিম লিডার আমাকে ‘সিদাদে দো সামবা’র বদলে ‘সিদাদে দো সাম্পা’ লিখে দিয়েছেন। এই জিনিস কেউ চেনে না। তারপরও একজন বলল, সোজা গেলেই পাবে। সেন্ট্রাল ট্রেনস্টেশনটা দেখার মতোই। অবশ্য আমার কমলাপুর আরো বেশি সুন্দর। পানের পিক আর ময়লা না ফেললে কতই না সুন্দর লাগত।
যাই হোক, স্টেশন থেকে বের হয়েই দেখি যেন এক টুকরো সায়দাবাদ গুলিস্তান। ফেরি করে মোবাইলের সিমকার্ড থেকে ধরে সিমের বিচি ভর্তা বিক্রি হচ্ছে। টুরিস্ট দেখলে এগিয়ে আসে। কথা বোঝাতে পারে না, খালি বোঝাতে পারে যে তারা কিছু বিক্রি করতে চায়। আমি এই ভিড় ঠেলে কেবল-কার স্টেশনে গেলাম। অলিম্পিকের জন্য বানানো ফ্রি কেবল-কার। একটা পাহাড়ের ওপর দিয়ে নিয়ে যায় ‘সিদাদে দো সাম্বা’তে। ‘সিদাদে দো সাম্বা’ হচ্ছে আমাদের চারুকলার মতো। চারুকলায় যেমন নববর্ষের সব প্রস্তুতি নেয়, এ রকমই এখানে সাম্বার প্রস্তুতি নেয়। একটু বড় আকারে। এটা একটা সাম্বা স্কুলের মতো। রিও কার্নিভালের সব প্রিপারেশন এখান থেকেই নেওয়া হয়। সারা বছর লাগিয়ে একটা প্রোগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়। যাই হোক, কেবল-কার থেকে নেমে দেখি এটা একটা ক্লিনিক। আবার ঝামেলা। অনেক কষ্টে গুগল মামার সাহায্যে সিদাদে দো সাম্বার যায়গা খুঁজে পেলাম। ড্রেস কালেকশন পয়েন্টে দেখি দুই কিলোমিটার লম্বা লাইন। একেবারে শেষে গিয়ে দাঁড়ালাম। সময় যায় না। আধা ঘণ্টা পর মনে হলো গ্রুপে পোস্ট দেই। গ্রুপে পোস্টে দেওয়ার পর ফ্রান্সের এক বন্ধু বলল যে একেবারে লাইনের সামনে ভলান্টিয়ারদের একটা ডেডিকেটেড লাইন আছে, চলে যাও সামনে। গেলাম, তার কথা কাজে এলো। গার্ডের সঙ্গে কথা বলার সময় এক ছেলে এগিয়ে এলো। ব্রাজিলের খেলোয়াড় সিলভার মতো দেখতে, লম্বা, নাম হচ্ছে লুকাস। সে বলল যে আমি ট্রান্সলেটরের কাজ করে দেই। তুমি পাসপোর্টটা দেখিয়ে ঢুকে যাও। লুকাসের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই আমার লাইনে সামনে দাঁড়ানো কানাডিয়ান মেয়েটাকে দেখলাম। সে এসে কথা শুরু করে দিল। জানলাম, সে ব্রাজিলিয়ান। আসলে ব্রাজিলে কাউকে চেহারা দেখে চেনা যায় না যে সে ব্রাজিলিয়ান নাকি!
ডাক পড়ল, গেলাম পাসপোর্ট নিয়ে। বলল, পরিচয়পত্রের জন্য ছবি তুলবে। আমি বললাম ওকে, কিন্তু আমার পাসপোর্টের মতো যেন বাজে না হয়। সে বলল, টেনশন করো না, এক মাস ধরে ছবি তুলছি। আমি বললাম, ভালোই তো! ছবি তোলা শেষ, প্রিন্টিং পয়েন্ট থেকে আমার বহুর প্রতীক্ষিত অলিম্পিকের পরিচয়পত্র হাতে পেলাম। এই অনুভূতি কোনোভাবেই আসলে বোঝানোর না! আইডি নিয়ে ইউনিফর্ম কালেকশন পয়েন্টে গেলাম। তারা একটা ভালো কাজ করেছে, সেটা হচ্ছে আমরা যে কাপড়ের সাইজ দিয়েছিল ওটা ফলো না করে ট্রায়াল রুমে ট্রায়াল দেওয়ার পর সাইজ নিয়ে ডিস্ট্রিবিউট করার সিস্টেম। ব্যাপারটা ভালো লাগার মতো। সাইজ নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই কারোই। বের হয়ে দেখি লুকাস আর সেই ব্রাজিলিয়ান মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। পরিচিত হলাম, কথা হলো। ওরাও ভলান্টিয়ার। এই এরিয়া কী নিয়ে আর আশপাশে কী আছে ঘোরার মতো—সব জিজ্ঞেস করলাম। জিজ্ঞেস করলাম ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার কোথায়? রিপ্লাই দিল, তোমার পেছনে। মানে এই জায়গা থেকে অনেক কাছে। তবে গেলে সানি ডেতে অনেক সকালে যেতে হয়। না হয় মেঘে কিছু দেখা যায় না।
মেয়েটার নাম কার্লা। ভালোই ইংরেজি বলে। কিন্তু বোঝাতে একটু সময় নেয়। অনেক কথা হলো ওদের সঙ্গে। পরে বললাম যে আমি কীভাবে যাব? কার্লা বলল, আমি এদিকেই যাচ্ছি তুমি যেতে পারো আমার সঙ্গে। লুকাস চলে গেল। আমি আর কার্লা ভিএলটিতে উঠলাম। ভিএলটি জিনিসটা ট্রামের মতো কিছুটা। মনে হয় একটু মডার্ন দিনের ট্রাম আরকি। ভিএলটি যাচ্ছে শহরের করপোরেট এরিয়ার ভেতর দিয়ে। আর কার্লা একেকটা জিনিসের বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছে। সে পড়াশোনা করেছে ট্যুরিজম নিয়ে, এগুলো ভালোই জানে।
সিনাল্যান্দিয়া নামের স্টেশনে নামলাম। একটা সময়ের জন্য মনে হলো এটা ইউরোপের কোনো শহর! সোজা বাংলায়, মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো! সেই আঠারো শতকের আর্কিটেকচারে বানানো একেকটা বিল্ডিং। প্যালেসের মতো। শহরের থিয়েটার। থিয়েটার মেট্রপলিতানো। অনেকক্ষণ ছবিটবি তুলে কার্লা বলল, চলো সান্তা তেরেজাতে নিয়ে যাই। আমি বললাম যাওয়া যায়। সমস্যা কই? আমি ফ্রি আছি। সান্তা তেরেজার দিকে গিয়ে দেখি কেবল-কার বন্ধ। কী আর করার, সামনেই একটা ট্যুরিস্ট স্পট আছে। লা-পা নাম, খুব সুন্দর দেখতে। অনেক পুরোনো একটা কেবলকার স্টেশন থেকে লাইন গিয়েছে লা-পার ওপর দিয়ে। এটা যায় সান্তা তেরেজায়। এই এলাকায় অনেক বেশি ছিনতাই হয়। তাই অলিম্পিকের জন্য পুলিশ দিয়ে ভরে রেখেছে রিও প্রশাসন। সামনে গিয়ে দেখি, একটা মিউজিক স্কুল। খুব সুন্দর দেখতে। আর ব্রাজিলের স্ট্রিট আর্টগুলো দেখার মতো। আবার অনেক পুরোনো ত্রিভুজের মতো একটা গির্জা আছে ওই জায়গায়। অনেক সুন্দর দেখতে। মিউজিক স্কুলের পেছনের সেলারন স্টেপস, এখানেও অনেক ট্যুরিস্ট ভিড় করেন। এটা মূলত কয়েকশো সিঁড়ি দিয়ে ওপরে যাওয়ার রাস্তা। এর বিশেষত্ব হচ্ছে এটা অনেক সুন্দর করে ডিজাইন করা। সিঁড়িগুলোতে অনেক মার্বেল আর টাইলস বসানো। রিও-সহ দুনিয়ার অনেক প্রান্ত থেকে আনা এসব টাইল দিয়ে বানানো এই সিঁড়ি নগরের খুব কমন রোমান্টিক জায়গা। অনেক উঁচু। তাই আর সিঁড়ি বেয়ে ওঠা হয়নি।
যেতে যেতে শুনলাম এই সিঁড়ির কাহিনী—চিলির এক শিল্পী ব্রাজিল এসেছিলেন। তিনি এখানে আঁকা-আঁকি শুরু করলেন। এগুলো বিক্রি আর নিজের সেভিংসের টাকা থেকে এই সিঁড়ি বানানো শুরু করলেন। ১৯৯০-২০০৫ পর্যন্ত নিজের ইচ্ছায় আর নিজে দেউলিয়া হয়ে এই আর্টিস্টিক সিঁড়ি বানালেন। অনেক ফেমাস হলেন। এই ফেমই হয়তো তাঁর কাল হয়ে গেল। ২০১৩ সালে কোনো এক সকালে এই স্টেপসেই তাঁর দগ্ধ মৃতদেহ পাওয়া যায়। কে বা কারা মেরে গিয়েছে, তার কোনো কিনারা হয়নি।
ফেরার পথে এক রেস্টুরেন্টে ঢুকে পর্তুগিজ ডিশ থেকে ‘কোশ্যেনো’ নিলাম। খুব মজা, চিকেনের। স্বাদ মুখে লেগে থাকার মতো। রেস্টুরেন্টের পাশেই সাবওয়ে স্টেশন। কার্লা আমাকে ট্রেন দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু লাইনের মহিলারা দেখি আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে! একটা ট্রেন এলে ভিড়ে উঠতে পারলাম না। এমন সময় এক গার্ড এসে কী যেন বলা শুরু করল, কিছুই বুঝলাম না। পরে কানে কানে বলল, ‘অনলি উইমেন’। আমিও বুঝলাম, আমি মেয়েদের রিজার্ভড কম্পার্টমেন্টের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
এমনই ছিল রিওর প্রথম দিন।