সোজা কথা
জমছে না পশুর হাট, জমছে অভিযোগ
আসছে পবিত্র ঈদুল আজহা। প্রতিবছরের মতো এবারো লাখ লাখ মুসলমান কোরবানি দেবে, চলছে তার প্রস্তুতি। বৃহস্পতিবার থেকে রাজধানীর হাটে হাটে কোরবানির পশু নিয়ে হাজির থাকছে খামারি ব্যবসায়ীরা।কিন্তু প্রতিবছরের মতো এবারো অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং দুর্ভোগের কোনো ব্যতিক্রমের খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।একটি ধর্মীয় কাজে কত রকমের যে অধর্মীয় কার্যকলাপ হয় তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বলা যায় ঈদুল আজহাকে।
এরই মধ্যে রাজধানীর পশুর হাট ঘিরে নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে। হাটের ইজারা থেকে শুরু করে হাটে পশু আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম ও নানা দুর্ভোগের কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসছে। গতবারের চেয়ে এবারে হাটের ইজারার দাম উঠেছে অনেক বেশি। ফলে সে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাড়তে পারে মাসুল ও হাসিলের মূল্য। সেই প্রভাব পড়বে পশুর দামের ক্ষেত্রে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে পথে পথে পশুর ট্রাকে নানা স্তরের চাঁদাবাজি। এ ছাড়া আছে কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা পশু হাটে ওঠার শঙ্কা। তেমনি পশু কিনতে বা পশু বিক্রির টাকা নির্বিঘ্নে গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারবে কি না- তা নিয়েও উদ্বেগে আছে ক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা।
এ বছর রাজধানীতে তিন লাখ ৬১ হাজারের বেশি পশু কোরবানির সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় দুই লাখ ৬০ হাজার ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় চাহিদা রয়েছে এক লাখ এক হাজার ৪১০টি পশুর। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, পশুর হাটে কোনো ধরনের অনিয়ম করতে দেওয়া হবে না। এ জন্য দুই সিটি করপোরেশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মনিটরিং টিম থাকবে। তারা সব ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও বলেছেন, কোরবানির পশুবাহী ট্রাকগুলো যেন চাঁদাবাজির শিকার না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েকদিন ধরে মন্ত্রী মেয়র আর আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারি বাহিনীর সদস্যদের নানা হম্বিতম্বিতে মনে হচ্ছিল- না জানি এবারে কী লঙ্কাকাণ্ড ঘটে।
এবারে নিশ্চয়ই খামারিরা পথে কোনো চাঁদাবাজির শিকার না হয়েই হাটে যেতে পারবে, হাটেও তারা কোনো চাঁদাবাজির শিকার হবে না। আসলে যত গর্জে তত বর্ষে না। মন্ত্রী মেয়রদের দোষ দিয়েই বা লাভ কি? এসব চাঁদাবাজি কারা করে, কারা তাদের মদদ দেয় সেটা সবাই জানে। তাই প্রতিবারের মতোই ক্রেতা-বিক্রেতা তাদের ক্ষতির হিসাব মিলাতে হিমশিম খাবে আর লাভের গুড় খেয়ে নেবে চাঁদাবাজ আর ইজারাদাররা। তারপরও হয়তো শোনা যাবে- ‘কোরবানির হাটে কোনো চাঁদাবাজি হয়নি, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কেনাবেচা হয়েছে কোনো সমস্যা ছাড়াই।’ সত্যি সেলুকাস!
কত কয়েকদিনের গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলো যদি আমরা বিশ্লেষণ করে দেখি, তাহলেই পরিষ্কার বোঝা যায় কী পরিমাণ ‘বাণিজ্য’ শুরু হয়েছে এই কোরবানির হাটকে ঘিরে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হাটের ইজারার তালিকা থেকে জানা গেছে, ২৪টি হাটের মধ্যে ১৯টি পেয়েছেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বর্তমান ও সাবেক নেতাকর্মী বা তাদের সমর্থিতরা। আর বাকি তিনটি যে ক্লাবগুলোকে দেওয়া হয়েছে, সেই ক্লাবের কর্মকর্তারাও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মী। এমনকি ইজারা পাওয়ার পর কিছু হাট স্থানীয় সংসদ সদস্য ও দলের নেতাকর্মীরা প্রকৃত ইজারাদারের কাছ থেকে সাবকন্ট্রাক্ট নিয়েছেন বলেও জানা গেছে। জানা গেছে, আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে প্রতিটি হাটের ইজারা নিয়েছেন। ফলে প্রকৃত ঠিকাদাররা ইজারা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
এত গেল ইজারা বাণিজ্যের খবর। এবারে আসি চাঁদাবাজির সুলুকসন্ধানে।ইতিমধ্যেই রাজধানীতে ট্রাক বোঝাই করে কোরবানির পশু আসতে শুরু করেছে। বেপারিরা গরু বোঝাই ট্রাকে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার প্রবেশ মুখে ঢুকতে বিভিন্ন মহাসড়কে চলছে এসব চাঁদাবাজির ঘটনা। ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ের ৫০টি স্পটে গরু বোঝাই ট্রাকে চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে বলে জানা গেছে।
রাজধানীর মেরাদিয়া, আফতাবনগর, গাবতলী, রায়েরবাজার এবং খিলক্ষেত ৩০০ ফুটের পাশের পশুর হাটে পশু নিয়ে আসা বেপারি ও ট্রাকচালকরা অভিযোগ করেছেন, উত্তরবঙ্গের রংপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত গরুর ট্রাক নিয়ে আসতে চাঁদা দিতে হচ্ছে ছয় স্পটে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে রাজধানী পর্যন্ত চার থেকে পাঁচটি ঘাটে চাঁদা গুনতে হচ্ছে ট্রাকচালকদের। ট্রাকচালকরা তাদের বহনকৃত পণ্য গন্তব্যে পৌঁছে দিতে নীরবে বাধ্য হয়ে চাহিদাকৃত চাঁদা দিচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার হাজারীবাগ জিগাতলা মাঠের পশুর হাট সর্বোচ্চ ৬৬ লাখ ১০ হাজার টাকায় ইজারা নেওয়া হয়েছে। গত বছর ওই হাটের ইজারামূল্য ছিল ৪৬ লাখ টাকা। খিলগাঁও মেরাদিয়া হাটের ইজারা ৫১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। গত বছর এ হাটের ইজারামূল্য ছিল ৪০ লাখ ২০ হাজার টাকা। উত্তর শাহজাহানপুর মৈত্রীসংঘ মাঠের হাটের জন্য সর্বোচ্চ সাত লাখ ২০ হাজার টাকা দর দিয়েছেন ইজারাদার। গত বছর ছিল পাঁচ লাখ ৯০ হাজার টাকা। ধূপখোলা খেলার মাঠের হাটের ইজারামূল্য ৯৩ লাখ টাকা। গত বছর ছিল ৪৫ লাখ টাকা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজধানীর পশুর হাটে বিক্রির লক্ষে আনা গরু-ছাগল পরিবহনের জন্য বিভিন্ন সেক্টরে পর্যায়ক্রমে টাকা দিয়ে আসতে হয়। তার ওপর ইজারামূল্য বেড়ে গেলে ইজারাদাররাও মাসুল বাড়িয়ে দেন। এসব অতিরিক্ত টাকা তো ব্যবসায়ীরা নিজের পকেট থেকে দেন না। তারা পশুর দাম বাড়িয়ে বাড়তি টাকা আদায় করেন।
শুধু কি রাজধানীতে এই অবস্থা? নিশ্চয়ই নয়। সারা দেশের চিত্র একই। সিলেট চট্টগ্রামসহ সব জায়গাতেই চাঁদাবাজির প্রক্রিয়া একই। চট্টগ্রামের বেপারিরা অভিযোগ করেছেন, গরুর প্রতিটি ট্রাক থেকে ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। উত্তরবঙ্গ থেকে চট্টগ্রামে আসতে একেকটি ট্রাককে ১০ থেকে ১২ জায়গায় চাঁদা দিতে হচ্ছে। এ কারণেই তারা বাজার জমে উঠার আগেই গরুর দাম চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু চাঁদাবাজির কারণে গরুর সরবরাহ থাকলেও দাম বেশি পড়বে বলে জানিয়েছে বেশির ভাগ বেপারি। এসব কারণে খামারি থেকে সাধারণ ক্রেতা সবাইকে পোহাতে হচ্ছে নানা দুর্ভোগ। জবাবদিহিতার সংস্কৃতি আমাদের কারো মধ্যেই নেই বলে আমজনতা নিষ্পেষিত হয়েই যাচ্ছে, কিন্তু এভাবে আর কতদিন!
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ।