ঈদুল আজহা
ফিরে দেখা কোরবানি
বাঙালি মুসলমানের জীবনে ঈদের দুটি তাৎপর্য রয়েছে। একটি ধর্মীয় কর্তব্য আর অন্যটি নিখাদ উৎসব। এর মধ্যে আবার ধর্মবোধ এবং উৎসবের স্বরূপ বিচারে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার মধ্যের কিছুটা তফাত রয়েছে। ধর্মীয় গুরুত্ব ঈদুল ফিতরে একটু বেশি। কারণ এই ঈদের সঙ্গে যুক্ত আছে এক মাসের সিয়াম সাধনা অর্থাৎ রমজান। তাই এই ঈদ যেমন একটি আধ্যাত্মিক প্রশান্তি নিয়ে আসে তেমনি নতুন পোশাক, নানা খাবার-দাবার আর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ সবকিছু পার্থিব ও অপার্থিব আনন্দ নিয়ে আসে। এদিক থেকে ঈদুল আজহার আবেদনটি একটু ভিন্ন।
রমজানের মতো এক মাসের ধর্মীয় কর্তব্য ও মানসিক প্রস্তুতি নেই এই ঈদে। পশু কোরবানিটি এই ঈদের বিশেষত্ব। সামর্থ্যবানরা সামর্থ্য অনুযায়ী কোরবানি দেন। যাঁরা কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন না, তাঁরা ধর্মীয় বিধানমতোই মাংসের ভাগ পাওয়ার অধিকারী। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশেষ নির্দেশনাও আছে। ফলে কোরবানির আনন্দ কমবেশি সবার মধ্যেই ছড়িয়ে যায়। আবার আধ্যাত্মিক গুরুত্বও রয়েছে। যাঁরা আধ্যাত্মিক দর্শনের কথা হৃদয়ে ধারণ করে কোরবানি দেন, তাঁরা সে আনন্দটুকুও খুঁজে নিতে পারেন। মনের ভেতরের যে অন্যায় বোধ, যাকে মনের ভেতরে বসত করা পশুত্ব বলা হয় পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে সেই পশুত্বকে হত্যা করার অনুভূতির কথাও মনে করা হয়।
সাম্প্রতিক পর্বে বাংলাদেশে মানুষের অর্থনৈতিক ভিত অনেকটা সবল। তাই কোরবানির পশু কেনার মধ্যে একটি বিলাসিতা ও কখনো কখনো প্রতিযোগিতার মনোভাবও প্রকাশিত হতে দেখা যায়। মধ্যবিত্তের এক অংশ সামর্থ্যের দিক বিবেচনায় ভাগে কোরবানি দেন। এখন এককভাবে কোরবানি দেওয়ার নাগরিকের সংখ্যাও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। উচ্চবিত্তদের মধ্যে লাখ বা কয়েক লাখ টাকা মূল্যের পশু, একাধিক গরু-খাসি কোরবানির পাশাপাশি উট-দুম্বার মতো আমদানি করা প্রাণী কোরবানির সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমরা একটু দৃষ্টি ফেরাতে পারি উনিশ-কুড়ি শতকের দিকে। তখন চিত্রটি ঠিক এখনকার মতো ছিল না। গ্রাম-বাংলায় তখন কোরবানির ঈদ, ঈদুল ফিতরের মতো ততটা আনন্দঘন ছিল না। ঈদের নামাজের পর পশু কোরবানিকে ঘিরেই একটি আনন্দ ছিল। এই ঈদের নতুন পোশাক কেনা বা পরার রেওয়াজ খুব বেশি ছিল না। উনিশ শতকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা খুব সীমাবদ্ধ থাকায় কোরবানিও সীমাবদ্ধ ছিল। অনেক দূরে দূরে দু-একটি পশুর হাট বসত। উচ্চবিত্ত হাতে গোনা অল্পসংখ্যক মানুষ একা একটি গরু কোরবানি দিতেন। সাধারণত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সাতজন মিলে সাতভাগে গরু কোরবানি দিত। কোনো কোনো কৃষক নিজের হালের বলদটিকে বয়স হয়ে কর্মক্ষমতা হারালে কোরবানি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করতেন। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের পশু কোরবানির তালিকায় সাধারণত ছাগল বা ভেড়া থাকত। ২০ থেকে ৫০ টাকায় ছাগল অথবা ভেড়া পাওয়া যেত। বিশ শতকে ৫০ থেকে ১০০ টাকায় ভালো মানের ছাগল পাওয়া যেত বলে তথ্য রয়েছে।
সেকালে অনেকে ঈদের দিন অর্ধবেলা রোজা রাখতেন এবং কোরবানির গোস্ত খেয়ে রোজা ভঙ্গ করতেন। তবে নাগরিক জীবন হওয়ায় ঢাকা শহরে ঈদের আয়োজনটা হতো একটু আলাদা। বেশির ভাগ গ্রামে মসজিদ, মাদ্রাসা বা ক্লাবঘরকে কেন্দ্র করে সবার পশু এক জায়গায় কোরবানি দেওয়া হতো। একে সাধারণত ‘সমাজ’ বলা হতো। সব পশুর মাংস একত্র করা হতো। দরিদ্রদের জন্য তিন ভাগের এক ভাগ ও আত্মীয় এবং পাড়া-পড়শির জন্য এক ভাগ রাখা হতো। এই ভাগের মাংস সমাজ থেকেই বণ্টন করে বিতরণ করা হতো। এখনো কোনো কোনো গ্রামে এই প্রথা চালু রয়েছে।
ঢাকা শহরে অনেক বাড়িতেই আঙিনা বা উঠোন নেই। তাই কোরবানির পশু কিনে এনে বাড়ির কাছে রাস্তার এক পাশে বেঁধে রাখা হতো। রাজপথে বা গলিতেই পশু কোরবানি দেওয়া হতো। ঢাকা শহরে বিশেষ করে পুরান ঢাকায় বিশ শতকে বেশ কিছু সংখ্যক সামর্থ্যবান মানুষের বসত ছিল। তাদের মধ্যে কোরবানির পশু কেনায় একধরনের প্রতিযোগিতা ছিল। বৈবাহিক সম্পর্কীয়দের বাসায় কোরবানির মাংস পাঠানোর রেওয়াজ পুরান ঢাকায় অনেককাল ধরেই ছিল। এখনো এ রেওয়াজ হারিয়ে যায়নি। বিশেষ করে গরুর আস্ত ‘রান’ পাঠানোর মধ্যে একটি আভিজাত্য কাজ করত।
এখন বড় শহরের পশুহাটে বিক্রির জন্য উটের সরবরাহ রয়েছে। বিশ শতকে তা অপ্রচলিত ছিল বলেই জানা যায়। বিশ শতকে ঢাকার চুড়িহাট্টার পীরসাহেব উত্তর ভারত থেকে একটি উট আনিয়ে ছিলেন। সে উট দেখার জন্য ভিড় জমে উঠেছিল।
প্রায় বাড়িতেই কোরবানির ঈদে মাংসের সরবরাহ বেশি থাকায় গৃহিণীরা চেষ্টা করতেন মাংসের নতুন নতুন পদ তৈরি করতে। রসনাবিলাসী পুরান ঢাকায় এ ক্ষেত্রে দারুণ মুনশিয়ানা ছিল। হাকিম হাবিবুর রহমান বিশ শতকে উর্দু ভাষায় একটি বই লিখেছিলেন। নাম ‘ঢাকা পচাশ বরস পহেলে’। সেখানে তিনি লিখেছেন, কোরবানির ঈদে ঢাকাবাসী কোপ্তা, কালিয়া, কাবাব রান্না করত। দরিদ্র ঘরেও এ সময় নানা ধরনের মাংস রান্নার কথা শোনা যায়। এ প্রসঙ্গে হাকিম হাবিবুর রহমান লিখেছেন, কোরবানির মাংস দিয়ে গরিব ঘরেও শিককাবাব তৈরি করা হতো।
তবে গ্রামে কি নগর জীবনে ঈদুল আজহা যে আত্মত্যাগের মহিমা নিয়ে আসে তা কোরবানি ও গরিবের মধ্যে মাংস বিতরণ এসবের মধ্যদিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর দার্শনিক দিক থেকে তা তো আত্মশুদ্ধির কথায়ই বলে। কবি নজরুলের ভাষায়, “হত্যা নয় এ সত্যাগ্রহ শনির উদ্বোধন”।
লেখক : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।