ভুল সংশোধনই প্রবারণা পূর্ণিমার মূল বাণী
প্রবারণা পূর্ণিমার মূল বাণী, গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনায় যাওয়ার আগে প্রবারণা পূর্ণিমা আসলে কী সে সম্পর্কে খানিকটা অলোচনা করা যাক। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যেটিকে আশ্বিনী পূর্ণিমা বলা হয়, মূলত সেটিই বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে ‘প্রবারণা পূর্ণিমা’ বলে পরিচিত। বুদ্ধ প্রজ্ঞাপিত সাংঘিক বিনয়নীতি অনুসারে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে তিন মাসের জন্য বর্ষাবাস অধিষ্ঠান করেন। ‘বর্ষাবাস অধিষ্ঠান’ মানে হচ্ছে বৌদ্ধভিক্ষুরা ধর্ম প্রচারের জন্য নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি বাদ দিয়ে একটি মাত্র বিহারে অবস্থান করে আত্মমুক্তির সাধনায় মগ্ন থাকেন। বৌদ্ধভিক্ষুরা তিন মাসের বর্ষাবাস শেষ করেন একে অপরকে প্রবারণা কর্ম করার মধ্য দিয়ে। মূলত এ কারণেই আশ্বিনী পূর্ণিমা বৌদ্ধদের কাছে ‘প্রবারণা পূর্ণিমা’ বলে পরিচিত।
বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘ দ্বারা প্রবারণা কর্ম সুসম্পন্ন হলে তাঁদের উদ্দেশ্যে পুণ্যার্থী দায়ক-দায়িকা কর্তৃক দানোত্তম পবিত্র কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানের আয়োজন করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। প্রবারণা পূর্ণিমার পরের দিন থেকে পরবর্তী এক মাসের মধ্যে শুধু তিন মাস বর্ষাবাস সফল বিহারে কঠিন চীবন দান করা যায়। কোনো বিহারে তিন মাস বর্ষাবাস উদযাপনপূর্বক কোনো ভিক্ষুর প্রবারণার আনুষ্ঠানিকতা সুসম্পন্ন না হলে সে বিহারে কঠিন চীবরদানের আয়োজন অসম্ভব বলে বুদ্ধ বিনয়ে বিধৃত আছে।
এই প্রবারণা পূর্ণিমার দিনটি বৌদ্ধদের কাছে আরো একটি কারণে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সেটি হলো, বুদ্ধ তাঁর মাকে ধর্মদেশনা করার জন্য সপ্তম বর্ষাবাসটি তাবতিংস স্বর্গে অবস্থান করেছিলেন। বর্ষার তিন মাস সেখানে অবস্থানের পর এই প্রবারণা পূর্ণিমার দিনেই এই পৃথিবীতে ফিরে এসেছিলেন। কাজেই বর্তমানে বৌদ্ধরা এই প্রবারণা পূর্ণিমার দিনটিকে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ফানুস উড়িয়ে উদযাপন করে থাকে। যদিও এটা ঠিক যে, বুদ্ধের সময়ে বিশেষ এই দিনটিকে বৌদ্ধ গৃহীরা উৎসবের মতো করে বিশেষ দিন হিসেবে উদযাপন করত বলে এমন কোনো উল্লেখ আমরা ত্রিপিটকের কোথাও দেখতে পাই না। কিন্তু বর্তমানে সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধদের কাছে এটি একটি বিশেষ দিন হিসেবে বিবেচিত, এবং সেভাবেই সারা বিশ্বে এই দিনটি আনন্দঘন পরিবেশে ধর্মীয় আমেজে উদযাপিত হয়ে থাকে।
আসল কথা হলো, এই দিনটিকে কেবল একটি ধর্মীয় উৎসবের দিন হিসেবে উদযাপন না করে, বুদ্ধ যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সামনে রেখে ভিক্ষুসংঘের মধ্যে প্রবারণার প্রবর্তন করেছিলেন সেই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা, গবেষণা ও চর্চার একটি ক্ষেত্র তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি।
যাই হোক, এখন প্রশ্ন হচ্ছে ‘প্রবারণা’ বলতে কী বোঝায়? খুব সোজা কথায় উত্তর দিলে প্রবারণা মানে হচ্ছে ‘আমন্ত্রণ’। কিসের আমন্ত্রণ? ভুল ধরিয়ে দেওয়ার আমন্ত্রণ। বুদ্ধ প্রবারণার মতো এমন একটি নিয়ম সংঘের মধ্যে চালু করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিলেন এই কারণে যে, বৌদ্ধভিক্ষুরা সাধারণত একেকটি বিহারে বা সংঘারামে সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই একজনের কাছে অন্যজনের ভালো-মন্দ, ভুল-ত্রুটি ও দোষ-গুণ ধরা পড়ে। অনেক সময় বিভিন্ন কারণে সেগুলো বলার বা তুলে ধরার সুযোগ হয়ে ওঠে না। অতএব একসঙ্গে তিন মাস ধরে অবস্থান করার পর ধর্মপ্রচারের জন্য ভ্রমণে বের হওয়ার আগে বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘকে পারস্পরিক প্রবারণা তথা আমন্ত্রণকর্ম করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই প্রবারণা তথা আমন্ত্রণকর্মটি করতে বলেছিলেন এভাবে : "অহং ভন্তে/আবুসো, আয়স্মন্তং পবারেমি দিট্ঠেন বা সুতেন বা পরিসঙ্কায় বা বদতু মং আয়স্মা অনুকম্পং উপাদায় পস্সন্তো পটিকরিস্সামি।"
এর বাংলা অনুবাদ এ রকম : ‘ভন্তে/বন্ধু, আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। (আমার কোনো দোষ-ত্রুটি) দেখে থাকলে, শুনে থাকলে অথবা সন্দেহ পোষণ করে থাকলে অনুকম্পাপূর্বক আমাকে খুলে বলুন। আসলেই যদি আমার কোনো দোষ-ত্রুটি হয়ে থাকে তাহলে আমি অবশ্যই এর সংশোধন করব।’
বিজ্ঞ পাঠক, এখানে দুটি বিষয় খুব স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। এক. খুব খোলামেলা মন নিয়ে অন্যকে নিজের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো। দুই. আসলেই ভুল বলে মনে হলে সংশোধনের প্রত্যয় ব্যক্ত করা। এটাই বৌদ্ধ প্রবারণার মূল বাণী। বর্তমান ভোগসর্বস্ব সংঘাতপূর্ণ জটিল জীবনে এই বাণীর সবিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য যে কতখানি তা বিজ্ঞ ব্যক্তি মাত্রই উপলব্ধি করতে পারবেন।
এর মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয় যে, আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগেও বুদ্ধ সমালোচনাকে কতটা উদারভাবে গ্রহণ করতেন এবং পরমতসহিষ্ণু ছিলেন! অথচ এমন উদারতা ও পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা আজকের এই আধুনিক যুগেও যথেষ্ট আকাল। আমরা যদি অন্যের সমালোচনাকে যৌক্তিকতার ছাঁচে ফেলে উদারভাবে গ্রহণ করার মানসিকতা গড়ে তুলতে না পারি, এবং যথেষ্ট বিচার-বিশ্লেষণ করার পর ভুলগুলো শোধরানোর মতো শুভ মানসিকতার উদয় ঘটাতে না পারি, তাহলে আমরা আমাদের ব্যক্তিজীবনে ও সমাজজীবনে কখনোই নিজেদের ভুলগুলো শোধরাতে পারব না, এবং ভালো দিকগুলোর প্রভূত উন্নতি ঘটাতে পারব না। তাই আসুন, আজকের এই প্রবারণা পূর্ণিমার দিনে মহান গৌতম বুদ্ধের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আমাদের চারপাশের সবাইকে আমাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার আকুল আহ্বান জানাই, এবং সেগুলো সংশোধনের সুদৃঢ় মানসিকতা গড়ে তুলি। এতেই আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিজীবন হয়ে উঠবে সুখী, সুন্দর ও মঙ্গলালোকে উদ্ভাসিত।
লেখক : করুণাবংশ ভিক্ষু, রাজবন বিহার, রাঙামাটি