ঢাকা থেকে বিমানে ইন্দোনেশিয়া, পরে সাগরপথে অস্ট্রেলেশিয়া
মালয়েশিয়ার সরকার একাধিক অভিযান এবং সমুদ্রপথে টহল জোরদার করার পর সমুদ্রপথে মানবপাচারের রুট পরিবর্তন করেছে পাচারকারী চক্র। পোর্ট এন্ট্রির (বন্দরে প্রবেশের পর) ভিসার সুযোগ নিয়ে এই চক্র প্রথমে মানবপাচার করছে ইন্দোনেশিয়ার জার্কাতা ও বালিতে। পরে জাভা সাগর পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলেশিয়ায় (অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নিউ গিনি ও তৎসংলগ্ন কিছু প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ)।
গত ২৭ অক্টোবর রাতে খুলনা প্রেসক্লাবের ১৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বালির উদ্দেশ্যে মালিন্দো বিমানযোগে ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়। এই বিমানের যাত্রাপথে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে চার ঘণ্টার ট্রানজিট ছিল। কুয়ালামপুরে বিমানবন্দরে অবস্থানকালে খুলনা প্রেসক্লাবের সভাপতি এস এম নজরুল ইসলাম আবিষ্কার করেন বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুরের রাজু আহমেদকে (২৫)।
রাজু আহমেদ এই সাংবাদিক প্রতিনিধিদলের কাছে স্বীকার করেন, তাঁরা মালিন্দোর একই বিমানে ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুরে এসেছেন। তাঁদের দলে মোট নয়জন সদস্য রয়েছেন। তাঁরা জার্কাতায় পৌঁছানোর পর সেখানে থাকা লোক তাঁদের নিয়ে যাবে এবং সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলেশিয়ায় ঢুকবে। বিনিময়ে তারা পাচারকারী দালাল চক্রকে মোট ১২ লাখ টাকা দেবে বলে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন, যার বড় অংশ এরই মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে। রাজু আহমেদ কথা বলার সময় তাঁর সঙ্গে নরসিংদীর নাইম শরীফ নামে আরেকক যুবক ছিল। তার চোখেমুখে ছিল অজানা ভয়।
কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে রাজু বারবার মালয়েশিয়ার পুলিশের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখছিলেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় এক পুলিশ আসছে দেখে দুই যুবক দুই দিকে চলে যায়। পরে আবার তাদের সন্ধান পাওয়া যায় বিমানবন্দরের একটি শুল্ক মুক্ত দোকানে।
রাজু স্বীকার করেন, এই বিমানে তাঁদের সঙ্গে অস্ট্রেলেশিয়া যাওয়ার জন্য মোট নয়জন এসেছেন। তবে সবাই ভিন্ন ভিন্নভাবে চলাচলা করছে। কারণ মালয়েশিয়ার পুলিশ খুব কড়া, তাদের হাতে ধরা পড়লে নিশ্চিতভাবে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবে। তাদের নয়জনের সঙ্গে দালাল চক্রের একজন নেতা রয়েছে যিনি বিজনেস ক্লাসের যাত্রী হিসেবে রয়েছেন, যাতে কারোর সন্দেহ না হয়। তিনি জার্কাতা নিয়ে তাদের পৌঁছে দিয়ে দেশে ফিরে যাবেন।
কুয়ালালামপুরে চার ঘণ্টা ট্রানজিটের পর মালিন্দো বিমানে খুলনা প্রেসক্লাব দলের ১৩ সদস্য ইন্দোনেশিয়ার জার্কাতার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এই সময় বিমানের বিজনেস ক্লাসে পাচারকারী চক্রের নেতা তানভির আহমেদের সন্ধান পাওয়া যায়। বিমানে কথা বলতে রাজি না হলেও জার্কাতা বিমানবন্দরে সাংবাদিকরা তাঁকে ঘিরে ধরে এবং কেন এই বাংলাদেশিদের ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বালি থেকে সাগর পাড়ি দিতে পারলেই অস্ট্রেলেশিয়া। সেখানে কাজ না করলে রাজনৈতিক আশ্রয় এবং ভাতা পাওয়া যায়। আর অদক্ষ শ্রমিকরা বনে-জঙ্গলে কাজ করতে পারবে। ইন্দোনেশিয়া থেকে সমুদ্রপথে একদিনের পথ অস্ট্রেলেশিয়া। আর অস্ট্রেলেশিয়া গিয়ে পুলিশের কাছে ধরা পড়লেও তারা আর ফেরত পাঠায় না। বরং কাজ না থাকলেও বেকার ভাতাসহ নানা সামাজিক সহযোগিতা পাওয়া যায়।
ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে বোমা হামলায় অনেক পর্যটক নিহত ঘটনার পর দেশটিতে পর্যটকের সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমে যায়। ফলে ইন্দোনেশিয়ার সরকার গত ছয় থেকে সাত মাস আগে থেকে হলিডে এবং পর্যটক আকর্ষণের জন্য ফি ছাড়াই বিমানবন্দরে ভিসা দিচ্ছে। বাংলাদেশসহ এই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে বিশ্বের ৬৫টি দেশের নাগরিকদের। তবে শুধুমাত্র ভ্রমণের জন্য।
আর সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সিটি ব্যাংকের আমেরিকান ক্রেডিড কার্ড ব্যবহার করে মালিন্দো বিমানের টিকিট কিনলে ঢাকা –জার্কাতার জন্য আসা –যাওয়া বিমান ভাড়ার সুযোগ দিচ্ছে বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ২২ হাজার ৫০০ টাকা।
মানবপাচারকারী চক্র এ সব সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বেকার যুবকদের সংগ্রহ করে। তানভির আহমেদের কাছে সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে কিছু লোক এইভাবে পাঠাবো এমন অশ্বাস দিলে তিনি র্নিভয়ে বলেন, ‘কোনো সমস্যা নাই। ঢাকার পুরানা পল্টন আর গুলশানে ট্রাভেল এজেন্সিতে গেলে ব্যবস্থা করে দেবে।’ এ সময় তিনি স্বীকার করেন, অক্টোবরের প্রথম দিন থেকে বিমান ভাড়া কমানোর পর তাঁরা পাঁচ দফায় ১৪২ জনকে পাঠিয়েছে। জার্কাতায় লোক আছে তারাই সাগর পাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করে থাকে। সাগর পাড়ি দিতে পাঁচ থেকে সাতদিন সময় লাগে।
এ ব্যাপারে কর্মসংস্থান ও জনশক্তি ব্যুরোর খুলনার সহকারী পরিচালক মো. আলী সিদ্দিকীর সঙ্গে যোগাযোগ করে ইন্দোনেশিয়ার বালি থেকে সমুদ্রপথে অস্ট্রেলেশিয়া মানবপাচারের ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। তিনি বলেন, ‘এই রুটটি পাচারকারী চক্রের নতুন আবিষ্কার।’ তিনি সংবাদমাধ্যমে ঘটনাটি প্রচার করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের পরামর্শ দেন। তিনি জানান, তারা মালেশিয়ার সমুদ্রপথে বিদেশে পাড়ি না দেওয়ার জন্য এলাকাভিত্তিক প্রচারণা চালাচ্ছেন। বিদেশ চাকরির জন্য দালালের খপ্পরে না পড়ারও প্রচারণা চালাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর আজম মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, বিষয়টি তাঁর এখতিয়ারভুক্ত নয়। তিনি ইমিগ্রেশন পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুলাহ আল মামুনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এ ধরনের পাচারের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘ভিসা ছাড়া ইন্দোনেশিয়ায় যারা যায় তাদের পাসপোর্টে লো-প্রোফাইল থাকলে ছাড়পত্র দেওয়া হয় না। পাচারকারী চক্র এত শক্তিশালী যে পাসপার্ট করে কয়েকবার ভারতের ভিসা নিয়ে ঘুরে আসেন। ফলে পুলিশকে বিপাকে পড়তে হয়।’
ওসি আরো বলেন, ‘পাচারকারীরা এমনভাবে তাদের উপস্থাপন করে যে তাদের শনাক্ত করতেই সমস্যা হয়। কোনো দল এভাবে যাচ্ছে তার আগাম খবর পেলে তারা ব্যবস্থা নিতে পারবেন।’