অস্ত্রধারীরা সাঁওতাল পল্লীতে ঢুকতেই দিল না
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাহেবগঞ্জ আখ খামারে আখ চাষ করে রংপুর চিনিকল। মিলটি বছরের পর বছর লোকসানে চলছে। আখ চাষের নামে বিস্তীর্ণ জমি ব্যবহার করা হচ্ছে অন্য নামে। যা চুক্তিভঙ্গের শামিল। ওই ভূমিতেই সাঁওতালদের বসবাস। পাশাপাশি থাকে দরিদ্র বাঙালিরাও।
গতকাল সোমবার গোবিন্দগঞ্জেই হামলা করে দুর্বৃত্তরা। পুড়িয়ে দেওয়া হয় সাঁওতালদের বাড়িঘর। পুড়েছে দরিদ্র বাঙালির ঘরও। দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত হয়েছেন শ্যামল হেমব্রম। ঘটনার একদিন পরও আতঙ্ক কাটেনি সাঁওতালদের মধ্যে। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা প্রবল আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।
গতকাল সোমবার সকালে হামলার ঘটনা শুনেই ছুটে যাই ওই এলাকায়। দুপুর নাগাদ পৌঁছাই বাগদা ফার্ম এলাকায়। মোট দুই হাজার দুইশো পরিবার আছে ওই ফার্ম এলাকায়। এরমধ্যে ৭০ শতাংশই সাঁওতাল। আর বাকিরা বাঙালি। খবর সংগ্রহের জন্য এলাকার ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে দুর্বৃত্তরা বাধা দেয়। এখন পর্যন্ত ওই পরিবারগুলোকে ঘেরাও করে রেখেছে দুর্বৃত্তরা। আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের। পরিবারগুলোর দাবি দুর্বৃত্তদের হামলায় একাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার চারটি ইউনিয়ন নিয়ে ওই আখ ফার্ম। সাপমারা, শাহপুর, মহিমাগঞ্জ ও গোবিন্দগঞ্জ এ চারটি ইউনিয়নে মোট সাড়ে পাঁচ হাজার বিঘা জমি আখ চাষের জন্য বরাদ্দ। অথচ আখ চাষ হচ্ছে মাত্র ৩০০ বিঘা জমিতে। অথচ চুক্তি অনুযায়ী আখ চাষ ছাড়া জমি অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। ব্যবহার করলে তা ফেরত নিয়ে নেওয়া হবে মিলের কাছ থেকে। জমি অবৈধভাবে ব্যবহার করার প্রতিবাদ জানিয়ে চুক্তি অনুযায়ী জমি ফেরত দাবি করে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীসহ অন্যরা। আর এ কারণেই মহিমাগঞ্জ-বাগদা ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি গত তিন-চার বছর ধরে আন্দোলন করছে।
মিলের লোকজন এ কারণে গ্রামের মানুষগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করেছে, হয়রানি করেছে।
বিষয়গুলো নিয়ে কথা বললেই আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে দুর্বৃত্তরা। গত সোমবারের ঘটনা এরই একটি অংশ।
খবর সংগ্রহের জন্য দুপুর ১২টা নাগাদ বাগদা ফার্ম এলাকায় পৌঁছাই। তখনই তিন-চারজন এসে পথ আটকায়। জানতে চায়, কোথায় যাব? আমি বললাম, ‘এলাকায় যাব। কী হয়েছে জানতে চাই।’
যুবকরা আমাকে বলল, ‘এলাকায় যাওয়া যাবে না। আমরা যেতে দিব না।’ আমি বললাম, ‘ভাই ওখানে কী হচ্ছে আমাকে জানতে দিন। না হলে তো গুজব ছড়াবে। এতে বদনাম হবে আপনাদের। আমি যা জানব তাই লিখব।’
যুবকরা আরো ক্ষিপ্ত হয়। বলে, ‘না আপনাকে যেতে দিব না। ওখানে কী হচ্ছে তা জানার দরকার নেই। আপনি চলে যান।’ একপর্যায়ে ধারালো অস্ত্র হাতে তিন চারজন এগিয়ে আসে। এদের মধ্যে একজন বলে, মাথায় কোপ দে, দিয়ে মাথা ফেলে দে। আরেকজন বলল, পা কেটে দে।’
আমি নিজে শান্ত থাকি। পরিবেশটাকে শান্ত করার চেষ্টা করি। একপর্যায়ে আরো কয়েকজন যুবক এসে আমাকে বলে, ভাই যান, চলে যান। এখানে কথা বলার দরকার নেই।
আমি হাল ছেড়ে ফেরত যাওয়ার উদ্যোগ নেই। কাঁচা পথে উঠতেই আমাকে একজন বলল, ‘ওই পথে যেতে পারবেন না। আপনি আখক্ষেতের ভেতর দিয়ে যান।’ আমাকে তাই করতে হলো। আখক্ষেতের ভেতর দিয়ে রওনা দিলাম। তখন দুপুর ১টা পার হয়ে গেছে। আখক্ষেতের ভেতর দিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আবার পেছন থেকে কয়েকজন ডাক দিল। পেছন ফিরে দেখি হাতে ধারালো অস্ত্র নিয়ে তিনচারজন যুবক আবার আমাকে ডাকছে। এবার আর ফেরার পথ নেই। এখন ফিরলে আর ঘরে ফেরা যাবে না। তাই মনে হচ্ছিল। মনে সাহস নিয়ে দৌঁড় শুরু করি। আখক্ষেতের ভেতর দিয়ে, মাঠ পেরিয়ে ছুটতে থাকি। পেছন ফিরে দেখি ধারালো অস্ত্রহাতে তিনচার জন যুবকও আমাকে ধাওয়া করছে। একপর্যায়ে গোবিন্দগঞ্জ-দিনাজপুর সড়ক চোখে পড়ে। মাঠ থেকে দৌড়ে সড়কের দিকে আসছি, পেছনে অস্ত্র হাতে দুর্বৃত্ত। এ দৃশ্য দেখে হঠাৎই একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেমে যায়। হাত বাড়িয়ে আমাকে টেনে নেন অটোরিকশাচালক। অটোরিকশায় তুলেই জোরে টান দিলেন। তখন মনে হলো এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম।
আমি না হয় বেঁচে গেলাম। গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালরা এমনিভাবে তিলে তিলে মারা যাচ্ছে আতঙ্কে। এমনকি ভয়ে নিজের নাম পর্যন্ত জানায় না এরা। আতঙ্কের দ্বীপে বিচ্ছিন্ন দিন কাটাচ্ছে ওই দরিদ্র মানুষরা।
লেখক: উন্নয়নকর্মী