ফিনদেশের দিনলিপি
তুষারকন্যার দেশে জীবন্ত স্নোম্যান
অউলু শহরের অবস্থানটা বেশ মজার। ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকি থেকে অনেক উত্তরে। আর্কটিক সার্কেলের কাছাকাছি। অর্থাৎ অউলুর আরেকটু ওপর থেকে উত্তর মেরুর সীমানা শুরু। রাশিয়া ছাড়া পৃথিবীর এত উত্তরে এত বড় শহর আর নেই।
এতটুকু শুনে অনেকের চোখ কপালে উঠে যায়। অবাক হয়ে বলে, ঠান্ডা লাগে না? আমি বিরক্ত হয়ে বলি, লাগবে না কেন? পাঁচ মাস থাকি বরফের মধ্যে।
অউলুর পূর্বদিকে বাল্টিক সাগর। সাগরের ওই পারে সুইডেন। ম্যাপ দেখে মনে হয়েছিল এক লাফ দিয়ে ওই পারে যাওয়া যাবে। বাস্তবে আসার পর অবশ্য দেখলাম ঘণ্টা দুয়েক লাগে। প্রতিদিন অউলুর বন্দর থেকে সুইডেনের জন্য বোট ছেড়ে যায়। স্থলপথেও যাওয়া যায়। তবে আরো উত্তরে যেতে হয় সে ক্ষেত্রে। বর্ডার কন্ট্রোল বলে কিছু নেই। অনেকেই সুইডেনে লাঞ্চ করে ফিনল্যান্ডে এসে ডিনার করে।
অউলুর অবস্থান উত্তর মেরুর কাছাকাছি
সাগরতীরের শহর হওয়ার কারণে অউলুতে যতটা ঠান্ডা হওয়ার কথা ততটা না। ‘ততটা না’ মানে অ্যাভারেজ টেম্পারেচার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতকালে যেটা নেমে যায় মাইনাস ৩৫ ডিগ্রি পর্যন্ত। পাশে সাগর না থাকলে হয়তো এটা ৫০-এর নিচে নেমে যেত। ল্যাপল্যান্ডের মতো বছরের বেশির ভাগ সময় বরফে ঢাকা থাকত। এত উত্তরে আধুনিক একটা শহর গড়ে উঠতে পেরেছেই সাগরের কারণে।
আমি যেদিন ট্রেন থেকে অউলু স্টেশনে নামি, সেদিন তাপমাত্রা ছিল ১২ ডিগ্রি। ঢাকার শীতকাল বলা যায়। মিডিয়াম লাইট জ্যাকেট পরে ট্রেন থেকে নেমেছিলাম। তারপরও কেমন একটা ঠান্ডার ঝাঁকুনি লেগেছিল। অথচ আগস্টের মাঝামাঝি তখন। সামারও শেষ হয়নি। আকাশে গনগনে সূর্য।
বুঝলাম, এখানে সূর্য যত গর্জে তত বর্ষে না। গনগনে সূর্য আর কনকনে শীত একই সঙ্গে থাকতে পারে। প্রথম কিছুদিন বড়ই বিচিত্র লেগেছিল। আকাশে সূর্য দেখা যাচ্ছে। এক ফোঁটা তাপ পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো মানে হয়?
এ তো গেল সূর্য। ওয়েদারের সঙ্গে সঙ্গে গাছপালা, দোকানপাট থেকে শুরু করে মানুষ ব্যবহার পর্যন্ত চেঞ্জ হতে দেখলাম। বাংলাদেশে পাতার রং কেবল সবুজ দেখেছি। এখানে তিন মাসে কয়েক রকম রং দেখা গেল। গাছের পাতা এত দ্রুত পাল্টাতে পারে জানতাম না। আগস্টে সবুজ ছিল। সেপ্টেম্বরে দেখতে না দেখতে সবুজ থেকে হলুদ হলো। হলুদ থেকে লাল। এরপর তুষার পড়তে সব সাদা হয়ে গেল। তুষার কমতে দেখা গেল বেশির ভাগ গাছের পাতা ঝরে গেছে।
তুষার ঢাকা অউলুর সিটি সেন্টার
বাংলাদেশে আমরা ওয়েদার নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই না। গরম বেশি পড়লে ঘামাতে ঘামাতে বলি, এই বছর গরম বেশি পড়ছে। বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা থাকলে ছাতা নিয়ে বের হই। শীত শীত লাগলে সোয়েটার চাপাই। গরম বেশি পড়ছে বলে কারো বিয়ের অনুষ্ঠান বাতিল হয় না। শীতের কারণে অফিস-আদালত বন্ধ হয়ে গেছে এমন হয় না।
ফিনল্যান্ডের ব্যাপারটা অন্যরকম। এখানে আবহাওয়া শুধু প্রকৃতি না, মানুষকেও ডোমিনেট করে।
অউলুতে শীতের আয়োজন তোড়জোড় করে শুরু হলো। সুপারমার্কেট থেকে ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেল টি-শার্ট, শর্টস, চপ্পল। তার জায়গা নিল বিশাল বিশাল জ্যাকেট, পুলওভার। চপ্পলের জায়গায় এলো উলের চটি। অনেক শপের বাইরে শীতকালের টাইমটেবিল টাঙিয়ে দেওয়া হলো। আমার ফিনিশ বন্ধু আন্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘শীত তাহলে চলেই এলো।’
আমি বললাম, ‘তুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলছো কেন? এটা তো ভালো ব্যাপার।’
‘ভালো ব্যাপার কেন?'
‘আমি শীতের জন্য অপেক্ষা করছি। আমি কখনো স্নো দেখিনি!’
সে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল যেন পাগল হয়ে গেছি। বলল, ‘এখনই শীতের রুটিন করে নাও। প্রয়োজনে স্টুডেন্ট কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলো।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘শীতের সঙ্গে রুটিনের সম্পর্ক কি? কাউন্সিলরের সম্পর্ক কি?’
সে হতাশ গলায় বলল, ‘গভীর সম্পর্ক। ডিসেম্বর-জানুয়ারি আমাদের জীবনের দীর্ঘতম দুই মাস। একটা ফোঁটা সূর্য দেখব না। সারাক্ষণ সন্ধ্যার মতো অন্ধকার থাকবে। সকালে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা করবে না। বাইরে যেতে ইচ্ছা করবে না। ডিপ্রেশন ভয়াবহ বেড়ে যাবে। অনেকে স্কুল-কলেজে যাওয়া কমিয়ে দেবে। সিপ্রামিল কেনার জন্য মানুষ ফার্মেসিতে লাইন দেবে।’
আমি বিড়বিড় করলাম, ‘খাইছে!’
‘তুমি কিছু বললে?’
‘না। আমার কিন্তু শুনে খুব একটা খারাপ লাগছে না। অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার মনে হচ্ছে।’
তাকে আরো বিমর্ষ দেখাল, ‘আই সি। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারের আগে ভিটামিন ডি ক্যাপসুল খেয়ে নিও।'
মনে মনে বললাম, ব্যাটা আমি ভিটামির ডি-র দেশের মানুষ। সারা জীবন সূর্য থেকে যে ভিটামিন নিয়েছি, এমন দু-চারটা শীত এমনিতেই পার করতে পারব।
প্রথম তুষার দেখি আসার ঠিক দুই মাসের মাথায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে রীতিমতো আর্তনাদ করে উঠলাম। চেনা জায়গা অচেনা মনে হচ্ছে। এক রাতের মধ্যে সব সাদা হয়ে গেছে। ছুটে বাইরে গেলাম দেখতে। বাসার নিচে পা দিতেই ধপাস করে প্রথম আছাড় খেলাম। ব্যাপার না। বরফের দেশে তো এমন একটুআধটু হবেই।
আমার বাসার জানালা থেকে
প্রথম তুষার দেখার অনুভূতি বাঙালি মাত্রই বুঝতে পারে। ফেসবুকের ওয়াল ছেয়ে যায় ছবিতে। ক্যাপশন থাকে, এনজয়িং স্নো ফর দ্য ফার্স্ট টাইম। দেশে ফোন দিয়ে আনন্দিত গলায় বলে, ‘আজকে স্নো পড়ছে আমাদের। হাঁটাচলা করা মুশকিল। দুবার আছাড় খেয়েছি। ডান পা হালকা মচকেছে।’
আমার উৎসাহ আরো প্রবল। বাসার আশপাশে ছবি তুলে পোষাল না। তুষার উদযাপনের জন্য সাইকেল চালিয়ে সিটি সেন্টার চলে গেলাম। দেশের বন্ধুবান্ধবকে হিংসায় ফেলতে হবে। বোঝাতে হবে দেড় ফুট তুষার নিয়ে আমি আনন্দে আত্মহারা।
বনের মধ্য দিয়ে পথ। এর মধ্যে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি। মাঝে মাঝেই চাকা পিছলে যাচ্ছে। চেনা রাস্তা চিনতে সমস্যা হচ্ছে। গাছপালা, পথঘাট সব সাদা হয়ে আছে। কোথাও কোথাও সাদা এত বেশি যে রীতিমতো ঝিলিক মারছে।
প্রথম তুষারের ঝিলিকে আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। সাইকেল রেখে হেঁটে বনের ভেতর ঢুকলাম। মনে হচ্ছে ফ্রোজেন মুভিতে চলে এসেছি। যেকোনো সময় স্নো ক্যাসেল দেখতে পাব। কপাল ভালো থাকলে তুষারকন্যার দেখাও পাওয়া যেতে পারে। সেই আশাতেই কিনা কে জানে, কয়েকবার স্নোর মধ্যে গড়াগড়ি দিলাম। গাছের ডাল ধরে ঝাঁকালাম, ঝুপঝুপ করে পাতায় জমে থাকা স্নো মাথার ওপর পড়ল। মোটামুটি জীবন্ত স্নোম্যান হয়ে আবার আবার সাইকেলে চড়লাম।
স্নো ক্যাসলের দেখা পাওয়া গেল না। তবে পথের মধ্যে আরো দুবার আছাড় খেলাম। একবার সাইকেল নিয়ে, একবার সাইকেল ছাড়া। তৃতীয় আছাড়ে গাছের সঙ্গে বাড়ি লেগে কপালের বামপাশ ফুলে গেল। একদিনে তিনটা আছাড় খেয়ে তুষারের প্রতি মোহও কিছুটা কমে গেল।
তুষারপাত যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল তেমন হঠাৎ থেমে গেল। এবং দুদিনে সব তুষার গলে পানি হয়ে গেল। এটা আমি জানতাম না। আমার ধারণা ছিল তুষারপাত একবার শুরু হলে ননস্টপ চলতেই থাকে।
তুষার গলা পানি যে কী ভয়াবহ জিনিস বুঝলাম। রাস্তাঘাট থকথকে কাদার মতো হয়ে গেল। এত বেশি পিচ্ছিল যে তিন পা হাঁটলে একবার আছাড় খেতে হয়। শুধু আমি না, রাস্তাঘাটে ফিনিশদেরও দেখলাম আছাড় খেতে।
এর চেয়ে ভয়াবহ রূপ নিল আবহাওয়া। তুষার বন্ধ হতে দ্রুত আঁধার হয়ে এলো। রাত বড় হতে লাগল। আবিষ্কার করলাম, আমার ফিনিশ বন্ধু আন্তি খুব ভুল বলেনি। নিজের মন-মেজাজে কেমন একটা পরিবর্তন আসছে। সকালে ঘুম থেকে উঠতে সমস্যা হচ্ছে। ঘন ঘন ক্লাস মিস হচ্ছে। সকাল ৯টার সময় ঘুম থেকে উঠে বাইরে এই অবস্থা দেখলে কীভাবে ক্লাসে যাওয়া সম্ভব?
শুধু তাই না। সারা দিন কেমন আড়ষ্ট লাগে। নড়াচড়া করতে ইচ্ছা করে না। দিনের মধ্যখানে প্রবল ঘুম পায়। একটুতেই ত্যক্তবিরক্ত লাগে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করে। মনে হয় পৃথিবীর বিষণ্ণতম জায়গায় আছি।
বাসা থেকে বের হওয়া বিরাট উৎপাতের মতো। পাঁচ মিনিটের জন্য বের হতে হবে। ড্রেস পরতে লাগে তিরিশ মিনিট। থার্মাল আন্ডারওয়্যার, থার্মাল ইনার, উলের স্কার্ফ, পুলওভার, সোয়েটার, উইন্টার জ্যাকেটসহ আধা ডজন জিনিস চাপাতে হয়। চাপানোরও নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। এর নাম লেয়ারিং। লেয়ারিং ঠিক রাখলে মাইনাস তিরিশেও ঠান্ডা ঢুকবে না শরীরে। ফিনিশ ভাষায় একটা বিখ্যাত প্রবাদ আছে, ‘খারাপ আবহাওয়া বলতে কিছু নেই। খারাপ কেবল তোমার পোশাক’।
মাইনাস ১৬-তে একদিন ভুল করে ইনার ছাড়া বের হয়েছিলাম। ছুরির মতো ঠান্ডা হাড়ের ক্যালসিয়াম পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিল। বাসায় এসে দুই ঘণ্টা নড়াচড়া করতে পারিনি। হিটারে পিঠ ঠেকিয়ে বসে ছিলাম। আরেকবার খালি হাতে বেশ কিছুক্ষণ স্নো ছোড়াছুড়ি করেছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে। ফিনিশদের কিছু হলো না। আমার হাত অবশ হয়ে গেল। শুধু হিটারে হলো না। তেল হালকা গরম করে হাতে মেখে বসে থাকলাম। আরেকটু হলেই ফ্রস্টবাইট হয়ে যেত।
নভেম্বরের শেষদিকে আবার শুরু হলো প্রবল তুষারপাত। এবার থামাথামি নেই। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। আশপাশ কিছুটা আলোকিত হলো। কিন্তু ততদিনে তুষার নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। স্নো বুট পরে ধপাস ধপাস করে বরফ মাড়িয়ে ভার্সিটি যাই। চারপাশের অন্ধকারে ঝলমল করে তুষার ঠিকরে আসা রুপালি আলো। শুভ্র সৌন্দর্য দেখতে ভালোই লাগে। কিন্তু শহরের বিষণ্ণ চেহারাকে ঢাকতে পারে না। মনের বিষণ্ণতাকেও না।
ডিসেম্বর-জানুয়ারি দুই মাস রীতিমতো অন্ধকারে ঢাকা থাকে অউলু। সূর্যবিহীন ধূসর জগতে গোমড়া মুখে ঘুরে বেড়ায় গুটিকয়েক মানুষ। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ বের হতে চায় না ঘর থেকে। ডিপ্রেশন কাটিয়ে ওঠার জন্য নানা কর্মকাণ্ড আয়োজন করা হয়। এসব কর্মকাণ্ডে শীতকাল নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা হয়। খুব একটা লাভ হয় বলে মনে হয় না। সব ইভেন্টের শেষে পরামর্শ একটাই। অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট খাও। ভিটামিন ডি খাও।
ডিসেম্বরের গাঢ় অন্ধকারে আর থাকতে পারলাম না। আমিও সাড়ে পাঁচ ইউরো দিয়ে এক কৌটা ভিটামিন ডি ক্যাপসুল নিয়ে এলাম। সকালে একটা, রাতে একটা খাই।
ডিপ্রেশন কাটল না, বেড়ে গেল। বড্ড মনে পড়তে লাগল ঢাকার কুয়াশা ঢাকা মাঘ মাসে ভাপা পিঠার গন্ধ। টঙ দোকানে ধোঁয়া ওঠা গরম চা। আর দুপুরবেলা কুয়াশার ফাঁকে উঁকি দেওয়া অলস সূর্য।