২০১৭
নতুন বছরের আবাহন
নতুন বছরকে আবাহন করা বিশ্বজুড়ে নানা জাতিগোষ্ঠীর সনাতন ধারা। গেল বছরের যত অপূর্ণতা ও অস্বস্তি এর সব কিছু কাটিয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সতেজ-সবুজ একটি বছরের আগমনী সুর বাজাতে চায়- সাজাতে চায় নতুন সাজে। কৃষিজীবী আদিম সমাজ এবং একধরনের ধর্মবোধের মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করার সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রথা রয়েছে সব দেশেই। বাংলা নববর্ষের সঙ্গে কৃষিজীবনের সম্পর্ক আছে। কৃষকের গোলায় ফসল উঠলে সে স্বাচ্ছন্দ্যে জমিদারকে খাজনা দিতে পারবে। জমিদার খাজনা পেলে মোগল সম্রাটের কোষাগারও সবল হবে। তাই সম্রাট আকবরের রাজস্বমন্ত্রী টোডরমল পয়লা বৈশাখ দিয়ে বাংলা পঞ্জিকা ঠিক করে দিলেন। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরারাও বছর শুরু করতে ফসলি সনকে চিহ্নিত করে বিজু, বিসু, সাংগ্রাই আর বৈসু উৎসবের মধ্য দিয়ে, যা একসঙ্গে পরিচিতি পায় বৈসাবি নামে।
বিশ্বজুড়েই বর্ষ শুরু উদযাপন করার রেওয়াজ রয়েছে। আফ্রিকার অনেক দেশ বর্ষা ঋতুতে নববর্ষ পালন করে যেমন ইথিওপিয়ায় পালিত হয় ১১ সেপ্টেম্বরে। চীনে চান্দ্র পঞ্জিকা অনুযায়ী নববর্ষের হিসাব করে। প্রতি তিন বছর পরপর সৌর পঞ্জিকার হিসেবে সংশোধন করে নেয়। এ কারণে বছরভেদে চীনে নববর্ষ পালিত হয় ২০ জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে। চীনা নববর্ষ পালনে বেশ জাঁকজমক হয়। আয়োজন হয় বিশেষ খাদ্যের। পরিবারের সবাই একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করে। সৌভাগ্যের প্রতীক লাল রঙের ছড়াছড়ি হয় দেশটিতে। লাল ইনভেলাপে ভরে টাকা উপহার দেয় পরিচিতজনদের। ড্রাগন নৃত্যসহ নানা গান-বাজনায় মুখরিত থাকে চীনের শহর গ্রাম। জাপানিরা এখন গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে নববর্ষ পালন করে ১ জানুয়ারি। এভাবে সারা পৃথিবীতেই নববর্ষ পালিত হয় আনন্দ উৎসব আবার ধর্মীয় প্রণোদনা নিয়ে।
১ জানুয়ারিতে সর্বপ্রথম নববর্ষ পালিত হয়েছিল ১৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত জানুয়ারি মাসের অস্তিত্ব ছিল না। তবে মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ মাসে বছর গণনা করা হতো। এ কারণে আদি রোমের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১ মার্চ ছিল নববর্ষ। রোমের দ্বিতীয় রাজা নুমা পনটিলিয়াস জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস যোগ করে ১২ মাস পূর্ণ করেন। বিখ্যাত রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার ক্যালেন্ডার সংস্কারের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি নিহত হলে ৪৬ খিস্টপূর্বাব্দে সম্রাটের সম্মানে ক্যালেন্ডার সংস্কার করে ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’ প্রস্তুত করা হয়। রোমান সিনেট ভোটের মাধ্যমে ঠিক করে ১ জানুয়ারি থেকেই বছর গণনা শুরু হবে।
মধ্যযুগে এসে নববর্ষে একটি পরিবর্তন আনা হয়। ইউরোপ ২৫ ডিসেম্বর নববর্ষ পালন শুরু করে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত দীর্ঘকাল কার্যকর থাকেনি। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার সংস্কার করে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় ১ জানুয়ারি নববর্ষ পালন শুরু হয়।
যেভাবেই নববর্ষের ইতিহাসে পালাবদল হোক না কেন বাঙালির জীবনে পয়লা বৈশাখ পালন আর ১ জানুয়ারির নববর্ষের তাৎপর্যে কোনো তফাত নেই। নববর্ষের আবাহনে একটি সমৃদ্ধ সুন্দর নতুন বছরকেই পেতে চায় এ দেশের মানুষ। এবারের নববর্ষের আগে আমাদের প্রত্যাশার জায়গাটি স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশি। অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ দেশ বিগত বছরগুলো থেকে অনেকটা এগিয়ে গেছে। এসব কারণে নতুন আশাবাদও তৈরি হয়েছে। সভ্যতার ইতিহাসের স্বাভাবিক আবর্তন রয়েছে। উত্থান, বিকাশ, পতন ও নব-উত্থানের বৃত্ত ঘূর্ণায়মাণ। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় সমৃদ্ধ অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক জীবন আকৃষ্ট করেছিল বিশ্বকে। তখন নানা দেশের বণিক ও পর্যটকদের আগমন ঘটত এ দেশে। আট শতক থেকে বৌদ্ধ বিহারগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের বাংলাদেশের সীমানায় বগুড়ার বাসুবিহার, নওগাঁর পাহাড়পুর বিহার, ময়নামতির শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, ভোজ বিহারের খ্যাতির কথা জানা যায় বিদেশি পর্যটকদের বিবরণীতে। চীনসহ প্রতিবেশী অনেক দেশের শিক্ষার্থী আসত বাংলার এসব বিহারগুলোতে পড়াশোনা করতে। স্থাপত্য ও ভাস্কর্যশিল্পের অনুপম বিকাশ ঘটে প্রাচীন বাংলায়।
মধ্যযুগে এসে আরো এগিয়ে যায় বাংলা। স্বাধীন সুলতানি বাংলা সমৃদ্ধির শিখরে ওঠে। শিল্প, অর্থনীতি, সাহিত্য, অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ এ দেশকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে যায়। মোগল শাসনপর্বেও এ ধারা অব্যাহত থাকে। বাংলার অবক্ষয় শুরু হয় ঔপনিবেশিককাল পর্ব থেকে। বাংলার উজ্জ্বল অবস্থান ধূসর অতীত হয়ে যায় পাকিস্তানি শাসনপর্বে। অর্থাৎ সভ্যতার ঘূর্ণায়মাণ চাকা একসময় সমৃদ্ধির উচ্চাঙ্গে থাকলেও এপর্বে অবক্ষয়ের চূড়ান্তে চলে আসে।
স্বাধীনতা নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এলেও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাংলার পুনরুত্থানের আবর্তনটি থামিয়ে রাখে। কিন্তু বিগত কয়েকটি বছরে এ সংকট কাটিয়ে ওঠার একটি আলোকশিখা স্পষ্ট হয়েছে। দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে চোখে পরার মতো। তবে সমাজজীবনে জঙ্গিবাদ নামে একটি ভয়ঙ্কর উপসর্গ নতুন সংকট তৈরি করেছে। রাজনৈতিক অঙ্গন তেমন মার্জিত হয়নি। গণতন্ত্রের চর্চা আশানুরূপ নয়। সম্ভাবনা ও সংকট পাশাপাশি হাঁটছে।
এমন একটি অবস্থার বাস্তবতায় ইংরেজি নববর্ষ সমাগত। নববর্ষকে সামনে রেখে আমাদের রাজনীতি যদি ক্ষমতার দ্বন্দ্বে না থেকে দেশপ্রেমকে সবার ওপরে জায়গা দেয়, তাহলে নতুন বছরে সভ্যতার চাকাকে নতুনভাবে আবর্তন করানো সম্ভব। উত্থান-বিকাশ আর পতনের পর নব-উত্থানই তো প্রত্যাশিত। বিগত কয়েকটি বছরে সে সম্ভাবনার পথ তৈরি হয়েছে। নববর্ষে আমাদের সেই প্রত্যয়, প্রত্যাশা এবং শপথ দৃঢ় হোক— এটিই আমাদের কামনা।
লেখক : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।