দৃষ্টিপাত
রাজনীতিতে ভারত ফ্যাক্টর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরের আগেই ‘দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনে ভারতের প্রভাব’ ইস্যুটি বেশ জোরেশোরেই উঠেছে। সম্প্রতি অন্তত দুটি বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছেন, ২০০১ সালের নির্বাচনে ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল। যদিও এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বিএনপির কোনো কোনো নেতা তীর্যক মন্তব্য করেছেন, ‘শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের মান-অভিমান চলছে।’
প্রশ্ন হলো, জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে প্রধান এই দুই দলের মধ্যে কে কত ভারতবিরোধী- তা প্রমাণের একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয় কেন?
১৯৭১ সালে ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তায় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পর থেকেই দেশের রাজনীতিতে জনমত প্রভাবিত করার সহজ বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ভারতবিরোধিতা। বিশেষ করে এই ইস্যুতে ডানপন্থি ও চরম বামপন্থি সংগঠনগুলো একত্রিত হয়। উদ্দেশ্য, ভারতবিরোধী প্রচারণার মাধ্যমে জনমতকে নিজেদের অনুকূলে নেওয়া।
ওই সময়ের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল,ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার গোপন সামরিক চুক্তি করেছে। মওলানা ভাসানী সরকারের কাছে দাবি জানান ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পাদিত সামরিক চুক্তি বাতিল করার। এই দাবিতে তিনি ১৯৭৩ সালের ২৯ আগস্ট দেশব্যাপী হরতালও আহ্বান করেন।
ইতিহাস বলছে, সদ্য স্বাধীন দেশে জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে বঙ্গবন্ধুর ধারেকাছেও কেউ ছিলেন না। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার অনেক ইস্যুতেই বিরোধীদের আপত্তি ছিল। একদিকে তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে বঙ্গবন্ধুর নীতির বিরোধিতা করা বা তাঁর বিরুদ্ধে জনমতকে প্রভাবিত করা সহজ ছিল না, আবার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হওয়ায় তখন সমস্যারও অন্ত ছিল না। আওয়ামী লীগের ভেতরেই নানা কোন্দল ছিল। এসবের সুযোগ নিয়ে বিরোধিরা ভারতবিরোধিতার অস্ত্র ব্যবহার শুরু করে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে। অর্থাৎ তারা দেশের যেকোনো সমস্যার জন্য ভারতকে দায়ী করতে থাকে এবং বঙ্গবন্ধু সরকারকে ‘ভারতের দালাল’ বলে আখ্যা দিতে থাকে।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার কিছুদিন পর জিয়াউর রহমানের সরকার ক্ষমতায় এলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের টানাপড়েন শুরু হয়। জিয়ার সরকার মূলত সৌদি আরবসহ অন্যান্য মুসলিম দেশ এবং চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব জোরদারে গুরুত্ব আরোপ করে।
জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে যে নির্বাচন দেন সেখানেও ভারতবিরোধী প্রচারণা অন্যতম প্রধান ইস্যুতে পরিণত হয়। তাঁর প্রচারণায় ভারতবিরোধী স্লোগান তুলে বলা হয়, ভারতের সঙ্গে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ।
আগস্ট ট্র্যাজেডির পর টানা ২১ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে থাকলেও তাদের বরাবরই ‘ভারতপন্থি’ বলে আখ্যা দিতে থাকে বিরোধীরা, বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াত। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বরাবরই বিএনপিকে পাকিস্তানের দোসর বলে অভিহিত করে।
২০০১ সালের নির্বাচনে ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন একসময় অভিযোগ করলেন যার কিছুদিন পরই তিনি ভারত সফরে যাচ্ছেন এবং ওই সফরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশর একটি সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। যদিও এই চুক্তির ব্যাপারে এখনো কোনো দেশের সরকারের তরফে কিছু বলা হয়নি। তবে চুক্তি না হলেও প্রতিরক্ষা ইস্যুতে একটা সমাঝোতা স্মারকে সই হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে।
এমন একটি সময়ে প্রধানমন্ত্রী কেন ভারতের তথা সে দেশের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর কড়া সমালোচনা করলেন? হতে পারে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার টেবিলে এমন কিছু বিষয় ভারত তুলবে যা বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক নয় এবং সেসব বিষয়ে বাংলাদেশ যে সম্মতি দেবে না, তার একটা আগাম ইঙ্গিত শেখ হাসিনা দিয়ে রাখছেন।
দ্বিতীয় কারণ হতে পারে এই যে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ যে ক্রমেই বিদেশনির্ভরতা কমিয়ে আনছে এবং যার একটি বড় প্রমাণ পদ্মা সেতু, প্রধানমন্ত্রী হয়তো ভারতকে সেই বার্তাটিও দিতে চাচ্ছেন।
প্রশ্ন হলো, ২০০১ সালে ভারতের কাছে মুচলেকা দিয়ে বিএনপির ক্ষমতায় আসার ঘটনা যদি সত্যি হয়, তার মানে কি এই যে, বাংলাদেশের নির্বাচনের ফলাফল ভারতের চাওয়ার উপরে নির্ভর করে? যদি তাই হয়, তাহলে এরশাদের পতনের পর দেশ গণতন্ত্রের পথে হাঁটছে এবং নির্বাচনি ব্যবস্থার যথেষ্ঠ উন্নতি হয়েছে বলে যে দাবি করা হয়, সেগুলো কি অসার হয়ে যায় না? ভারত বা যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই যেকোনো দলকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে পারে? তার মানে আগামী নির্বাচনে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র যে দলকে সমর্থন দেবে, তারাই ক্ষমতায় আসবে? তাহলে জনগণের ভোট দেওয়ার কী দরকার? যদি তাই হয়, তাহলে এটি দেশের কোনো রাজিনৈতিক দলের জন্যই সম্মানজনক বিষয় নয়।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ চাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় বড় দুই দলই সরকারের ওপর চাপ দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানিয়েছিল।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারাঙ্কো বড় দুই দলের মধ্যে মধ্যস্ততা করার ব্যর্থ চেষ্টা করে গেছেন। ওই সময় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রও নিজেদের অবস্থান থেকে নির্বাচনে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছে বলে জানা যায়।
২০১৫ সালের ২ জুন কালের কণ্ঠের একটি খবরে বলা হয়েছে, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের সুযোগ পেলে বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ভারতের হস্তক্ষেপ চাইবে বিএনপি। এ সংক্রান্ত লিখিত একটি প্রস্তাবনা তৈরি করে দলটি মোদির হাতে দেবে। প্রস্তাবনা তৈরির জন্য বিএনপির সাবেক কূটনীতিকরা কাজ করছেন বলে জানা গেছে।’
কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ভারত ফ্যাক্টর কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ? বলা হয়, বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই ভারতবিরোধী মানসিকতা পোষণ করে। এর পেছনে প্রধান যে কারণ চিহ্নিত করা যায়, সেটি সম্ভবত ভারতের কর্তৃত্ব পরায়ণ মানসিকতা। বাংলাদেশ যেহেতু সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে, ফলে বাংলাদেশের মানুষ মনে করে অন্য যেকোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে এই রাষ্ট্রের বন্ধুত্ব হবে যুক্তিপূর্ণ এবং ভারসাম্যপূর্ণ; যেখানে বাণিজ্যের ভারসাম্য যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমীহ।
বাংলাদেশের তিনদিকে ভারতের অবস্থান হওয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারত বরাবরই একটি ‘স্থায়ী ফ্যাক্টর’। স্বাধীনতার পর সীমান্তচুক্তি, গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা, বাণিজ্যিক ভারসাম্য, সমুদ্রসীমা, সীমান্তে বিএসএফের হাতে বাংলাদেশি হত্যাসহ নানা কারণে বাংলাদেশ-ভারত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে টানাপড়েন শুরু হয়। এসব টানাপড়েন স্বভাবতই সাধারণ মানুষকেও উদ্বিগ্ন করে; যার প্রতিফলন হয় বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় কোন দল, সেটি ভারতের কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না। বরং তাদের চাহিদাগুলো যে সরকার বেশি পূরণ করতে পারে, ভারত তাকেই আনুকূল্য দেয়। বাংলাদেশের কাছ থেকে ভারত যা নেয়, দেয় তারচেয়ে অনেক অনেক কম। আবার বন্ধুপ্রতীম বলা হলেও ভারতের মানসিকতা বা আচরণও ঠিক বন্ধুসুলভ নয়। এসব কারণেও বাংলাদেশের মানুষের একটা বড় অংশই ভারতবিরোধী মানসিকতা পোষণ করে। যে কারণে বড় দুটি দলই পরস্পরকে ভারতের দালাল বলে অভিযুক্ত করে। এটি ভোটের মাঠে গরিষ্ঠ মানুষের সহানুভূতি পাওয়ার রাজনীতি বৈ কিছু নয়।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট