জঙ্গি সংকট
কমান্ডো অভিযান নিয়ে তর্ক কেন?
বাংলা ভাই-শায়খ রহমানের মতো শীর্ষ জঙ্গিনেতাকে আটক কিংবা হলি আর্টিজানে সফল অভিযানের পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অভিযান নিয়ে নানা মহল থেকেই যে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতায় সিলেটের ‘আতিয়া মহল’ নামের বাড়িতে অপারেশন নিয়েও এ রকম সন্দেহ ওঠার প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিল। যদিও সেনা কমান্ডোরা সেখানে অভিযান শুরুর পর এ নিয়ে সন্দেহ কমতে থাকে।
হলি আর্টিজানের অভিযানও পরিচালনা করছিল সেনা কমান্ডোরা। তবে সেটির তুলনায় সিলেটের আতিয়া মহলে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ নামে পরিচিত এই অভিযান অনেক ব্যাপক, ঝুঁকিপূর্ণ এবং অভূতপূর্ব। কারণ, সেখানে বিপুল পরিমাণে বিস্ফোরক এবং আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) মজুদ রয়েছে, যেগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানো হলে ওই ভবন তো বটেই, আশপাশের ভবনও উড়ে যেত বলে ধারণা করা হয়। ফলে ওই ভবনে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর আগে সেখানকার বাসিন্দাদের নিরাপদে এবং অক্ষত অবস্থায় সরিয়ে আনা ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ ৭৮ জন মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে আনা হয়। এতগুলো মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য ইতিহাসে তাদের নাম নিশ্চয়ই উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। কারণ, জঙ্গিরা যদি এই মানুষগুলোকে জিম্মি করত অথবা হলি আর্টিজানের মতো সেখানে বিপুল রক্তপাত ঘটাত, তাতে কিছু করার ছিল না। জঙ্গিরা শেষমেশ অভিযানে নিহত হলেও নিরীহ সাধারণ মানুষের মৃত্যুর ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ হতো না। অতএব, সেনা কমান্ডো, ফায়ার সার্ভিসসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রত্যেক কর্মী—যাঁরা ওই ভবন থেকে সাধারণ মানুষকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন—তাঁদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা। সেই সঙ্গে এ অভিযানের সংবাদ সম্মেলন চলার সময় অদূরেই বোমা হামলায় সাধারণ মানুষ এবং পুলিশের যে দুই কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন, তাঁদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, সিলেটের শিববাড়ি এলাকার ওই ভবনের নিচতলায় চারটি মরদেহ পাওয়া গেছে। এর মধ্য থেকে দুটি মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশকে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি দুটি মরদেহে আত্মঘাতী বেল্ট লাগানো ছিল। পুরো ভবনে যে পরিমাণ বিস্ফোরক আছে, তা যদি ফেটে যায়, তাতে পুরো ভবন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তাই দেখেশুনে বেশ সতর্কতার সঙ্গে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর।
২৩ মার্চ গভীর রাত থেকে বাড়িটি ঘিরে রাখা হয়। পরদিন সেখানে পৌঁছায় পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াট। শনিবার সকাল থেকে সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো দল ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ নামে অভিযান শুরু করে। এর প্রায় আড়াই দিন পর চার জঙ্গির নিহত হওয়া এবং ভেতরে আর কোনো জঙ্গির না থাকার বিষয়টি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি বলাই সংগত, এখানে যে পরিমাণ বিস্ফোরক মজুদ করা হয়েছিল, সেগুলো নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও হামলায় ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল জঙ্গিদের। সুতরাং অনেক বড় বিপদের হাত থেকে যে দেশ বেঁচে গেছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একইভাবে সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডেও একটি জঙ্গি আস্তানায় বেশ বড়সড় অভিযান চালানো হয়েছে এবং সেখানেও যে পরিমাণ বোমা, বিস্ফোরক ও অস্ত্র মজুদ ছিল, সেগুলোও কোথাও না কোথাও ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল। অর্থাৎ পরপর দুটি বড় অভিযান একদিকে যেমন আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে, তেমনি এক বা একাধিক হামলা ও তার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়েছে। ফলে এসব অভিযান আমাদের আশ্বস্ত করে এবং ভরসা জোগায়।
তবে এও ঠিক যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কর্মকাণ্ড, কিছু অতি উৎসাহ, কখনো নিজেদের সাফল্য প্রমাণের চেষ্টা, এমনকি বিভিন্ন বাহিনীর ভেতরে প্রতিযোগিতা কোনো কোনো অভিযান বা কোনো কোনো ঘটনা প্রশ্নবিদ্ধও করেছে।
বছরের পর বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা রকম বিতর্কিত এবং অসাধু কর্মকাণ্ড তাদের ওপর মানুষের আস্থা কমিয়েছে। এই তীব্র আস্থাহীনতার কারণেই তাদের অনেক সাফল্যও মানুষের কাছে মনে হয়েছে ‘নাটক’ বা ‘সাজানো’।
নারায়ণগঞ্জে সাত খুন, ঝালকাঠির কলেজছাত্র লিমনকে পঙ্গু করে দেওয়া, গাইবান্ধার সাঁওতালপল্লীতে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনায় মানুষ এতটাই ভীত ও সন্ত্রস্ত যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক ভালো কাজ বা অনেক সাফল্যও মানুষ একবাক্যে বিশ্বাস করতে চায় না।
সিলেটে যা হলো সেটি অবশ্যই ‘নাটক’ নয়। কারণ হিসেবে অনেক যুক্তি ও প্রমাণই কিন্তু চোখের সামনে রয়েছে। হলি আর্টিজানের অভিযানও ‘নাটক’ ছিল না।
কিছু কিছু কর্মকাণ্ড পুলিশ বা র্যাবকে বিতর্কিত করেছে, সন্দিহান করেছে। সেই সন্দেহ-সংশয় দূর করার দায়িত্ব তাদেরই। কারণ, সেনাবাহিনী সব সময় সব অভিযান পরিচালনা করবে না; বরং তাদের ডাকা হয় খুব বড় অভিযানে। এর বাইরে জঙ্গিবিরোধী অভিযান সারা বছরই চলবে। সুতরাং সেইসব অভিযান নিয়ে যাতে মানুষের মনে কোনো সন্দেহ তৈরি না হয়, মানুষ যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিশ্বাস করে এবং তাদের ওপর ভরসা করতে পারে, সে জন্য নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি বন্ধ করতে হবে। কোনো নাগরিক আইনি সহায়তা নিতে গেলে বিনা পয়সায় তারা আন্তরিক এবং তাৎক্ষণিক সেবা পাবে, তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। সাধারণ মানুষ পুলিশকে আতঙ্ক নয়, বরং বিপদে যাতে তাদের বন্ধু ভাবতে পারে, সেই পরিস্থিতি পুলিশকেই তৈরি করতে হবে। কারণ যতক্ষণ না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানুষের কাছে পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে, ততক্ষণ জঙ্গিবিরোধী অভিযান নিয়ে মানুষ সন্দেহ করতে থাকবে এবং আখেরে জঙ্গি নির্মূলের পরিবর্তে সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই এটিকে ‘নাটক’ ভাবতে থাকবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।