ব্যাঙ্গ রঙ্গে
প্রশ্ন ফাঁসের আত্মকাহিনী
আমি প্রশ্ন। মনে বড্ড কষ্ট। আমার যাতনার কথা কার কাছে বলবো? বেদনা শোনার মতো কেউ কি আর আছে! অতীতে আমি একাই ছিলাম। দিনকাল বেশ ভালোই ছিল। ছিল না কোনো কলঙ্ক। এখন অপবাদ আর কলঙ্গের দিন। সম্প্রতি আমার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ‘ফাঁস’ শব্দটি। ফলে এখন আমার পূর্ণাঙ্গ নাম ‘প্রশ্ন ফাঁস’। দুঃখ! দিনে দিনে প্রত্যেকের নামের আগে ভালো বিশেষণ যুক্ত হলেও আমার ক্ষেত্রে পড়েছে ঠাডা। আগে নয়, নামের পরে যুক্ত হয়েছে ফাঁস। আগের দিনে পরীক্ষার হলে সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করত। আর আমি থাকতাম শিক্ষকদের হাতে। মনে মনে বলতাম, ‘আইতাছি খাড়া।’ পরীক্ষার হলে অনেকটা আনন্দ বোধ করতাম এই কারণে যে, সবাই আমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এক সময় শিক্ষক আমাকে তুলে দিতেন শিক্ষার্থীদের হাতে। তারপর তারা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে আমাকে পড়ত। লেখা শুরু করত। বারবার তারা আমার দিকে তাকাত। এক প্রশ্নের উত্তর লেখার পর আবার আমার দিকে তাকাত। কিন্তু এখন আমার কপাল খারাপ। আমার সেই সুদিন আর নেই।
এখন পরীক্ষার হলে কেউ আর আমার জন্য অপেক্ষা করে না। আমার দিকে আর কেউ তাকায়ই না। পরীক্ষার খাতায় লেখার ক্ষেত্রে আমার জন্যও আর কেউ অপেক্ষা করে না। আমাকে পাওয়ার আগেই অনেকের লেখা শুরু হয়ে যায়। শিক্ষকের হাত থেকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। কারণ আমি ফাঁস হয়ে গেছি। পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা থেকে শুরু করে সরকারি চাকরির পরীক্ষায় আমাকে ফাঁস করে দেওয়া হচ্ছে। পরীক্ষার আগে আমি সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রত্যেকে আমাকে নিয়ে স্ট্যাটাস দেয়। সমালোচনার ঝড়। আমাকে ফাঁসের এক মহোৎসব। এতে আমি হয়ে পড়ি কারো জীবনে পৌষ মাস, কারো জীবনে সর্বনাশ। আমার ইজ্জত পামচার। আগে হতো নকল এখন আমার পালা। আমার ফাঁস ফুসে বিশেষজ্ঞরা বিস্মিত হয়ে পড়ে। সবাই কুকথা বলে। আমার কী এই সব সহ্য হয়। এবার বলুন তো , আমি কি নিজে নিজে ফাঁস হয়ে যাই। আমাকে কেউ ফাঁস করলেই না আমি ফাঁস হয়ে যাই।
আমি কি বুঝি না একজন শিক্ষার্থীর স্বপ্ন, আশা-প্রত্যাশা। সারা বছর একজন শিক্ষার্থী আমার জন্য পড়াশোনা করে। আমাকে আশ্রয় করে শিক্ষার্থীরা তাদের মেধার বিকাশ ঘটায়। তার স্বীকৃতি মিলে আমার মাধ্যমে। সারা বছর তারা কতই না কষ্ট করে। কিন্তু কতিপয় অসৎ মানুষ আমাকে ফাঁস করে দিয়ে তাদের গলায় ফাঁসির দঁড়ি ঝুলায়। সম্প্রতি একটি ব্যাংকের পরীক্ষায় একজন বেকার ভাইয়ের কষ্ট আমাকে বড্ড পীড়া দিয়েছে। তার কথা আমি এখনো ভুলতে পারছি না। পরীক্ষা শেষ হওয়ার তিন ঘণ্টা পর তিনি মনের দুঃখে আমাকে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে দাহ্য করল। তবে আগেই জানতে পেরেছিলাম তার দুঃখের কথা। সোলাইমান নামে ওই শিক্ষার্থীর সরকারি চাকরির বয়সসীমা শেষ। এই পরীক্ষাই ছিল তার জীবনের সর্বশেষ সরকারি চাকরি পরীক্ষা। তাই জানপ্রাণসহ সর্বত্র দিয়ে শেষ পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করেছিল। বয়স শেষ বিধায় পরিবার এবং প্রেমিকারও চাপ ছিল তার ওপর। ফলে কোমড় বেঁধে পড়াশোনা ছাড়া উপায় ছিল না তার। খুঁটিটিনাটি সব বিষয় অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে আয়ত্ত্ব করতে পেরেছিল সোলাইমান। পরীক্ষার হলে সব প্রশ্ন কমন পড়েছিল তার। অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে পরীক্ষা শেষ করে। পরীক্ষা শেষে সে আত্মবিশ্বাসী এবার তাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না। তার স্বপ্ন এবার ধরা দেবে। কিন্তু তিন ঘণ্টা পর সোলায়মান শুনতে পেল পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। কারণ পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। এতে সে আমাকে টুকরো টুকরো করে ছিড়বে না তো ধুয়ে পানি খাবে। পরীক্ষার আগে আমি কারো হাতে যেতে চাইনি। আমাকে জোর করে অন্যের হাতে তুলে দেওয়া হলো। পরে জানতে পারলাম এতে আদান-প্রদানের কিছু বিষয় হয়েছে। যারা সারাজীবন বইয়ের ধারেকাছেও যায় না, তাদের হাতে আমাকে তুলে দেওয়া হয়। তখন আমার প্রচণ্ড দুঃখ লাগে। তারা তো আমাকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা! আর আমি ফাঁস হবো না কেন? বলুন তো! আমি কি কম হাত বদল হয়ে থাকি।
জন্ম থেকে শিক্ষার্থীদের কাছে হলে পৌঁছা পর্যন্ত আমাকে কতজনই স্পর্শ করে। পরীক্ষক আমাকে প্রণয়ন করে। প্রুফ দেখে। এক সময় আমি প্রেসে যাই। সেখানে থেকে প্যাকেট হয়ে নানা মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ি। আমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই তো আর ভালো মানুষ নয়। সবার উদ্দেশ্য তো আর এক রকম নয়। প্রত্যকটি মানুষ যদি নীতি-নৈতিকতা এবং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করত তাহলে আমার ফাঁস হওয়ার কোনো বিষয়ই উঠত না। কিন্তু দুনিয়ার মানুষ অসৎ। তারাই আমার অপব্যবহার করছে। বিনিময়ে তারা লাভবান হচ্ছে। তবে শিক্ষামন্ত্রী আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন। সব সময়ই তিনি আমার বিষয়ে চিন্তা করেন। আমাকে বাঁচানোর কথা বলেন। কিন্তু তিনি তো আর একা আামাকে বাঁচাতে পারেন না। আজকে আমার এই আত্মজীবনীর মাধ্যমে শিক্ষামন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। তিনি যেমন সৎ ও আন্তরিক। আমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই তার মতো হলে আমার ফাঁস রোধ করা সম্ভব।
কিন্ত আমি ভেবে পাই না, একজন শিক্ষক কি করে আমাকে ফাঁস করতে পারে। শিক্ষক মহান পেশায় জড়িত। সে নীতি নৈতিকতা অতিক্রম করে আমাকে অন্যের হাতে তুলে দেয়। এজন্য শিক্ষামন্ত্রী বারবার বলেছেন কিছু কিছু অসৎ শিক্ষকের জন্য প্রশ্ন ফাঁস দূর করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমাকে ফাঁস করার জন্য সরকারি কর্মকর্তার অনেকেরই হাত রয়েছে। আরেকটি বিষয় আমি ভেবে পাই না, একজন অভিভাবক কী করে এসব কাজে জড়িত হয়। আমাকে পাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে থাকে। কিন্তু এই টাকা শিক্ষার্থীরা কোথায় পায় ? তারা তো চাকরিজীবী নয়। লাখ লাখ টাকা বের করা তো শিক্ষার্থীদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে আমাকে ফাঁস করার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরাও দায়ী। আমাকে পাওয়ার জন্য অভিভাবকরা টাকা দিয়ে থাকে। এতে একজন অভিভাবক তার সন্তানকে অন্যায় অসৎ পথে উৎসাহ এবং অনুপ্রানিত করল। তবে সমাজের প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাসীনদের প্রভাবও আমার ওপর কম নয়। তবে যাই হোক আমি আর ফাঁস হতে চাই না। আমার ব্যবস্থা এখনো মান্ধাতা আমলের। পরীক্ষার হলে প্রেরণ করার জন্য আমাকে ডিজিটালাইজ করা হোক।
আমার সঙ্গে এতো জনবল জড়িত থাকার দরকার নেই। আমি আর গাট্টি ভরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়তে চাই না। কেন্দ্র থেকে পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা আগে আমি কেন্দ্র কেন্দ্র পৌঁছে যেতে চাই। সেখানে প্রিন্টার এবং হাই স্পিডের ফটোকপি মেশিন ব্যবহারের মাধ্যমে আমাকে পরীক্ষার হলে পৌঁছে দেওয়া হোক। সবাই যখন ডিজিটাল হচ্ছে তখন আমি কেন অ্যানালগ থাকব। আমি প্রশ্ন নিজেও বুঝি পরীক্ষার আগে আমাকে ফাঁস করা বর্তমানে মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনোভাবেই আমার ফাঁস ঠেকানো যাচ্ছে না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা। নীতি-নৈতিকতা বহির্ভূত প্রশ্ন ফাঁসের মতো অন্যায় কাজ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অভিসাপস্বরূপ। জাতিকে মেধা শূন্য করার জন্য আমাকে ফাঁস করাই যথেষ্ট। সবার কাছে অনুরোধ আমাকে বাঁচান। আমাকে ফাঁস করবেন না। আপনাদের অপকীর্তি আমার ওপর আর বর্তাবেন না। আমার ফাঁস রোধ করুন, দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করুন।
লেখক : প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়