ব্যঙ্গ রঙ্গে
বাজেট এবং মরা মানুষের হাসি
আবগারি শুল্ক মানে কি?
বাজেট ঘোষণার দিন অফিস শেষে বাসায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই গিন্নির ঝঙ্কার। আমি ছাপোষা সাংবাদিক মানুষ। সব জ্ঞান ত আমার থাকার কথা না। পরনের শার্টটা খুলে আলমারিতে রাখতে রাখতে শুধু এটুকুই বললাম, এইটা একটা ট্যাক্স।
গিন্নি তুষ্ট হলেন না। এমনিতেই বাজেটের বাজে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আমার নিজের সংসারেই। নানা জিনিসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে ক্ষেপে আছেন গিন্নি। তার ভাবগতিক এমন যে, আমিই যেন এসবের দাম বাড়িয়ে দিয়েছি। তারওপর আবার এই আজগুবি আবগারি শুল্কবিষয়ক প্রশ্ন।
সত্যি আমি নিজেও এই আবগারি কি বস্তু তা জানি না। তাই প্রেস্টিজ রক্ষায় গিন্নিকে বানিয়ে একটা ব্যাখ্যা দিলাম এ রকম: ‘ওই যে একাধিক গাড়ি আছে যাদের, তাদের ওপর যে ট্যাক্স আছে সেইটাই 'আবগাড়ি' ট্যাক্স। দেখছ না, টাইটেলটার মধ্যেই গাড়ি (গারি) শব্দটা আছে।''
শুনে গিন্নি আরো চেতলেন, ব্যাখ্যাটা তার পছন্দ হয়নি বুঝতে পেরে আমি বললাম, 'আরে না না। যারা ব্যাংকে টাকা রাখতে গাড়ি নিয়ে যায়, তাদের ওপর ধার্য করা ট্যাক্সই আবগারি...''
নাহহহ। বেশিক্ষণ এভাবে মানুষকে ভুল ব্যাখ্যা দিলে নিজের কাছেও নিজেকে অপরাধী অপরাধী লাগে। ফলে কম্পুটারে গুগল খুঁজতে বসলাম যেহেতু প্রশ্নটা আমার মাথাতেও ঘুরছিল কিছুদিন ধরে।
গুগলে অনেক খোঁজাখুজি করলাম। কোনো পত্র-পত্রিকার খবরে এটার ব্যাখ্যা পেলাম না। বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়াও ফেল মারল। আমিও নাছোড়বান্দা। আবগারির বংশ পরিচয় বের করবই করব। যেহেতু মাননীয় অর্থমন্ত্রী আমাদের জনগণের সম্মানে ব্যাংক হিসাবে কমপক্ষে ১ লাখ টাকা থাকলে আবগারি শুল্ক দিতে হবে মর্মে ৮০০ টাকা ধার্য্য করেছেন। ফলে এটার মানে বের না করলে এখন সাংবাদিক হিসেবে নিজের ঘরেই ইজ্জত থাকে না।
শেষে আবগারির অর্থ পেয়েও গেলাম, তা-ও অনেক কষ্টে।
কিন্তু একি! আবগারি শুল্ক নাকি মাদক সংক্রান্ত ব্যবসায় পরিচালনার জন্য সরকারের নির্দিষ্ট বিভাগে যে শুল্ক জমা দিতে হয় তা-ই!
এইবার আমি নির্বাক। কেমনে কি! আমি ত মাদকের ম-ও খাই না; ওইটার ব্যবসাও করি না। তাইলে আমার ওপর ক্যান এই শাস্তি হলো? ওদিকে যেখানে মাননীয় মন্ত্রীই বলেছেন চার হাজার কোটি টাকা কিছুই না, সেখানে সামাণ্য লাখ টাকা কীভাবে অনেক টাকা হয়?
গত কয়েকদিন ধরে ছেড়া কাঁথার নিচে শুয়ে শুয়ে হতভাগা লাখ টাকা আর সৌভাগ্যবান কোটি টাকার পার্থক্যের হিসাব বের করার চেষ্টা করতেছি; কোনটা আসলে বড়। এ কাজে মাথা বারবার হ্যাং হয়ে যেতে লাগল।
এ-ই যখন অবস্থা, তখন অর্থমন্ত্রী বাজেট পরবর্তি সংবাদ সম্মেলনে বললেন, এটি নাকি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বাজেট! বাজেটে নানা ভ্যাট-ট্যাক্সে চাপা পড়ে ইতিমধ্যে দেশের আপামর জনগণের মতো আমিও মারা গিয়েছিলাম।কথাটা শোনার পর মরা মানুষের মুখের কোনায় হাসির রেখা দেখা দিল। হাসি সব সময়ই যে ভালো কিছু, তা কিন্তু নয়। এই যেমন ধরেন, হাসিটা জীবিত মানুষদেরকেই মানায়। মরা মানুষ হাসলে কিন্তু বেজায় বিপদ। যেমন ধরুন অনেকেই বলে থাকেন, লোকটা হাসতে হাসতে মারা গেছে। আহা! কিন্তু ধরেন, আপনি একাকি কোনো মর্গে আছেন, সেখানে কোনো লাশ হেসে উঠল! বিষয়টা কেমন হবে?
মৃত্যুর সময় হাসি দেয়া পৃথিবীর অন্যতম কঠিন কাজ। মৃত্যু পথযাত্রীর হাসি যারা দেখেন তাদের জীবনে এটা থাকে তাদের দেখা অনেকগুলো স্মরণীয় ঘটনার একটা। এদেশের প্রখ্যাত একজন সাহিত্যিক একবার এমন অনুভূতির সামনে পড়েছিলেন। তিনি এক বৃদ্ধ ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় ওয়েটিং রুমে পড়ে থাকতে দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তার ভয়ের কারণ ছিল, মৃত ব্যক্তির মুখের কোণায় মৃদু হাসি ছড়ানো ছিল।
একবার চিন্তা করুন, মরা মানুষের সুন্দর হাসিটাও কতটা বিভৎস হতে পারে! দেশে এখন ১৭ কোটি মরা মানুষ হাসতে শুরু করেছে। পরস্পরের এই হাসি দেখে মূর্ছা যাওয়ার জোগাড় এখন সবারই। কার হাসি কে দেখবে?
বাজেট ঘোষণার পর দেশের মানুষ ভ্যাট-ট্যাক্সের নিচে এমনিতেই চাপা পড়ে অলরেডি চেপ্টা হয়ে গিয়েছিল। তারওপর গত এক দশকের ব্যবধানে চালের কেজি ২২ টাকা থেকে ৪৮ টাকা, গরুর মাংস ১৮০ থেকে ৪৮০ টাকা, গ্যাসের চুলা ২৫০ থেকে ৯০০ টাকা, বিদ্যুৎ প্রতি ইউনিট ১.৬০ পয়সা থেকে ৭.০০ টাকায় লাফ দেওয়ায় ১৭ কোটি মানুষই কার্যত মৃত্যুবরণ করে আছেন।
এহেন অবস্থায় অর্থমন্ত্রী বাজেটপরবর্তি সংবাদ সম্মেলনে যখন বললেন, এটি নাকি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বাজেট। এ বাণী শ্রবণের পর থেকে ১৭ কোটি মরা মানুষের মুখে এবার হাসির রেখা ফুটে উঠছে।
পুনশ্চ, শেষ ইচ্ছে :
দুই দুবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন লর্ড পামারস্টন। মৃত্যুর সময়ও তিনি স্বভাবজাত কৌতুক করে তাঁর চিকিৎসকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘প্রিয় ডাক্তার সাহেব, আমি মারা যাচ্ছি! জীবনে এই মরার কাজটাই শুধু আমার করার বাকি ছিল বোধহয়!’
প্রতি বাজেটে বলা নেই, কওয়া নেই ভ্যাট-ট্যাক্স বসিয়ে জনজীবন যাপন দুর্বিষহ করে দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় আমাদের এই দেশের জনগণেরও এখন সত্যি সত্যি মরার কাজটাই বোধ হয় বাকি আছে। না হলে তাদের ওপর এত অত্যাচার হবে কেন?
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।