৫৭ ধারার মজা!
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারার মজাটা এবার খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও পেয়ে গেছেন। কেননা, বাংলাদেশে প্রচলিত আর কোনো আইনেই এত সহজে কারো বিরুদ্ধে মামলা করা যায় না। আবার অভিযোগের পক্ষে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ বা দলিলপত্রও লাগে না। ইন্টারনেটে আপনার যেকোনো লেখার বিরুদ্ধেই মানহানির অভিযোগ তুলে মামলা করা যায়। এমনকি আপনি যা লেখেননি তাও ফটোশপে তৈরি করে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা সম্ভব। সেই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত না হলেও আপনাকে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে এমনকি সামাজিকভাবে যে হয়রানির শিকার হতে হবে, তার ক্ষতিপূরণ রাষ্ট্র আপনাকে দেবে না।
একসময় ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা অর্থাৎ যে আইনের বলে পুলিশ যেকোনো সময় যেকোনো নাগরিককে আটক করতে পারে, তা নিয়ে যত সমালোচনা হয়েছে কিংবা দ্রুত বিচার আইন নিয়ে যত কথাবার্তা হয়েছে, সম্ভবত সেসব ছাড়িয়ে গেছে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের এই ৫৭ ধারা। এখন আর ‘তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা’ পুরোটা বলতে হয় না। শুধু ‘৫৭’ বললেই মানুষ বোঝে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী রীয়াজ এই ধারা নিয়ে সম্প্রতি একটি কবিতাও লিখেছেন, যেটি তিনি তাঁর ফেসবুকে শেয়ার করেছেন।
- ‘চুপচাপ থাকো, ফিসফিস করো’
- ‘না হলে আসবে চিতাবাঘ?’
- ‘বাঘ নয় বোকা, চিতা বাঘ নয়’
- ‘আকারে বিশাল? হাতির মতন?’
- ‘মোটে নয় বড়, আকারে সে ছোট, অতিশয় ছোট’
- ‘তা হলে আমার ভয়টা কিসের? তুমি তো আছোই |
নাম কি তার? তাহার কি রয়েছে অনেক অনেক অস্ত্র?’
- ‘নারে বোকা ছেলে, নাম তার আছে;
দিয়েছে তাহারা সমাজে যাহারা গণ্য এবং মান্য
আমরা না হয় ছোট করে বলি, এর নাম সাত-আন্ন।’
একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যখন এই ৫৭ ধারার কড়া সমালোচনা করছেন, তখন দেশের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে সম্মানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন অধ্যাপক তাঁরই সহকর্মীর বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করে দিয়েছেন। গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, ফেসবুকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণের অভিযোগ তুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হকের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করেছেন তাঁর সহকর্মী অধ্যাপক আবুল মনসুর আহাম্মদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এমএসএস ২০১৬ ষষ্ঠ ব্যাচের পরীক্ষার ফলাফল দিতে দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে কিছুদিন ধরেই ফেসবুকে লেখালেখি হচ্ছে। তার পুরোটা আমরা পাবলিকলি দেখতে না পেলেও ওই গ্রুপের ফেসবুক পেজে (যেটা আসলে সিক্রেট গ্রুপ) নানা ধরনের মত-দ্বিমত প্রকাশিত হয়েছে। সেখানের কোনো একটি কমেন্টে ক্ষুব্ধ হয়ে অধ্যাপক ফাহমিদুল হকের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলাটি করেছেন তাঁর সহকর্মী। যদিও ফেসবুকের সিক্রেট গ্রুপের আলোচনা নিয়ে মামলা করা যায় কি না, তা আইনজীবীরা ভালো বলতে পারবেন।
এই মামলার কারণ যাই হোক, আমরা নাগরিকরা সাধারণ জ্ঞানে যতটুকু বুঝি তাহ হলো, ফাহমিদুল হক যাতে পরীক্ষার খাতা দেওয়ার দীর্ঘসূত্র নিয়ে আর কথা না বলেন, যাতে তিনি চুপ থাকেন এবং ভেতরে একধরনের চাপ অনুভব করেন, সে কারণেই তাঁর বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছে।
যে শিক্ষক তাঁর বিরুদ্ধে মামলাটি করেছেন, তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে আলাপ-পরিচয় নেই। কিন্তু ফাহমিদুল হককে চিনি বহু বছর ধরে। সামাজিক নানা আন্দোলনে সোচ্চার, একজন ক্ষুরধার লেখক ও গবেষক––বিশেষ করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও গণমাধ্যম নিয়ে তাঁর যে অনবদ্য কাজ, তা আমাদের ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত করে। মাঝেমধ্যে টেলিভিশনেও তিনি বিভিন্ন আলাপচারিতায় অংশ নেন। কখনো কাউকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেছেন বলে দেখিনি। ব্যক্তিজীবনে একজন সজ্জন মানুষ বলেই তাঁকে আমরা চিনি।
বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর বিরুদ্ধে এই মামলার খবর শুনে যখন তাঁকে ফোন করি, তিনি তখন মহাখালী থেকে ক্যাম্পাসে বাসায় ফিরছিলেন। অনেকক্ষণ কথা হয়। তাঁর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, মামলাটি ‘শুভ আর অশুভর লড়াই’। এখন প্রশ্ন হলো, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে শুভ আর অশুভর লড়াই করতে হবে তারই সহকর্মীর বিরুদ্ধে? তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শব্দটি শুনলেই আমাদের যেরকম মাথা নত হয়ে আসার কথা, সেটি আর হবে কেন?
প্রসঙ্গত, কয়েকদিন আগে আরেক প্রখ্যাত লেখক, গবেষক ও শিক্ষক আফসান চৌধুরীর বিরুদ্ধেও এই ৫৭ ধারায় মামলা করেছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, যিনি ওয়ান-ইলেভেনের সময় বেশ আলোচিত ছিলেন। মি. চৌধুরী সেই মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছেন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে এই যে, এটি এমন একটি বীভৎস আইন যার প্রয়োগ করে যে কেউ যেকোনো সময় যে কারো বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিতে পারে এবং অভিযোগ সত্য হোক কিংবা মিথ্যা, অভিযুক্ত ব্যক্তিটি হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
এ রকম একটি বাজে আইন বাতিলের পক্ষে খোদ আইনমন্ত্রীও। তিনি এ পর্যন্ত বহুবার বলেছেন যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়ে গেলে ৫৭ ধারা রহিত হয়ে যাবে। কিন্তু সেটি কবে হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। যদিও ওই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেরও কিছু বিধান নিয়ে বিতর্ক আছে এবং ৫৭ ধারা রহিত হলেও আখেরে এই জাতীয় মামলার প্রবণতা কতটুকু বন্ধ হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
তার মানে হলো, সমাজের মধ্যে একটা আতঙ্ক জারি রাখা, মানুষকে কথা বলতে না দেওয়ার জন্য একটা জুজুর ভয় রাষ্ট্র বরাবরই দেখিয়ে যায়। এ রকম আইনগুলো এমনভাবে ত্রুটিপূর্ণ এবং ধোঁয়াশাচ্ছন্ন করে রাখা হয় যে, যাতে করে যেকোনো সময় যেকোনো বিরুদ্ধবাদীর গলায় ছুরিটি চালানো যায়। যার সুযোগ নিয়ে কখনো একজন মন্ত্রীর পক্ষে তাঁর অনুসারী, কোনো এমপির পক্ষে তাঁর ভক্ত মামলা ঠুকে দিতে পারেন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। পরপর বেশ কিছু ভিকটিম এরই মধ্যে আমাদের সামনে তৈরি হয়েছে।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, যেদিন অধ্যাপক ফাহমিদুল হকের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করলেন তাঁরই সহকর্মী, তার কয়েকদিন আগেই এই বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী এবং যমুনা টেলিভিশনের সাংবাদিক নাজমুল হোসেনের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলার প্রতিবাদ ও ৫৭ ধারা বাতিলের দাবিতে বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করেছেন।
লেখক : সাংবাদিক।