অভিমত
বিচারপতি-সংক্রান্ত বিবেচনা ও অন্যান্য তর্ক
আমাদের রাজনীতিবিদরা মাঝেমধ্যে এমন সব সত্য কথা বলেন, যা আরো অনেক বিষয় ও সত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সবশেষ বিচারপতি নিয়োগ প্রসঙ্গে এ রকমই একটি সত্য বললেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, যাকে গত বছর আদালত অবমাননার দায়ে সাজা দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত।
গত ১৯ আগস্ট রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে ১৯৯৯ সালে রাজনৈতিক বিবেচনাতেই বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এ কথাটি তিনি এমন এক সময়ে বললেন, যখন ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সরকার ও বিচার বিভাগ কার্যত মুখোমুখি। এর দুদিন পর ২১ আগস্ট গাজীপুরে এক অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রধান বিচারপতি মানসিক ভারসাম্যহীন কি না, তা জানতে তাঁর ডাক্তারি পরীক্ষার দাবি জানান। মনে রাখা দরকার, আদালত অবমাননার দায়ে এই মন্ত্রীকেও সাজা দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত।
খাদ্যমন্ত্রীর কথায় পুরোনো সেই কথাটিই প্রতিষ্ঠিত যে উচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনাই মুখ্য, বিশেষ করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে। সংবিধান যদিও বলছে, কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁর অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। তার মানে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। যদিও সাংবিধানিকভাবেই আমাদের প্রধানমন্ত্রীগণ এমন ক্ষমতা ভোগ করেন যে, রাষ্ট্রপতির মহোদয় তাঁর পরামর্শ ছাড়া বা তাঁর সঙ্গে আলোচনা ছাড়া (আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ছাড়া) আসলে কিছুই করেন না বা করতে পারেন না। তার মানে, প্রধান বিচারপতি কে হবেন, সেটিও পরোক্ষভাবে নির্বাহী বিভাগই সিদ্ধান্ত নেয়। সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য না আনা পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি নিয়োগের মতো একটি স্পর্শকাতর এবং অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও নির্বাহী বিভাগের হাতেই থাকবে। সংবিধানই বলছে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোনো পরামর্শ দিয়েছেন কি না অথবা কী পরামর্শ দিয়েছেন, কোনো আদালত সে বিষয়ে কোনো প্রশ্নের তদন্ত করতে পারবেন না। অর্থাৎ ক্ষমতাটা ‘অ্যাবসলিউট’।
সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন।’ কিন্তু খাদ্যমন্ত্রীর কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে এটি পরিষ্কার যে ১৯৯৯ সালে বর্তমান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে রাজনৈতিক বিবেচনাতেই বিচারপতি করা হয়েছিল। যদি তাই হয় তাহলে প্রশ্ন, তখন কি সিনহাকে নিয়োগের ব্যাপারে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি তৎকালীন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কোনো আলাপ করেননি নাকি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে সুপারিশ বা ‘ক্লিয়ারেন্স’ গিয়েছিল বলেই এস কে সিনহাকে বিচারপতি করা হয়েছিল? আবার ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এস কে সিনহার ভূমিকা নিয়েও আপিল বিভাগের একজন সাবেক বিচারপতি এবং কোনো কোনো আওয়ামী লীগ নেতা প্রশ্ন তুলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যদি সিনহার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধই হবে, তাহলে আওয়ামী লীগ আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় তাঁকে কীভাবে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হলো?
নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে টানাপড়েন অনেক গণতান্ত্রিক দেশেও হয় এবং এটি দোষের বা বিপদের কিছু নয়। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় প্রকাশের পর থেকে যে ভাষায় প্রধান বিচারপতির বিষোদ্গার করা হচ্ছে, তা কোনো অর্থেই শালীনতার পর্যায়ে পড়ে না। তা ছাড়া ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে এস কে সিনহা দেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র, সংসদ, বিচার বিভাগ ইত্যাদি নিয়ে যেসব পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, সেখানে নতুন কিছু নেই; বরং এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়েও তিনি এ রকমই পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন এসব নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এর একটি কারণ এই হতে পারে যে, ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পরই একটি শীর্ষ সংবাদপত্র রায়ের বিভিন্ন অংশ অনুবাদ করে প্রকাশ করেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যাঁরা এই রায়ের কিছু অংশ নিয়ে এখন রাজনীতির মাঠ গরম করছেন, তাঁরা কেউই পুরো রায়টি পড়েননি বা সে সময়ও তাঁদের নেই। আবার কোনো একটি অধ্যায়ের পুরোটা না পড়েই বা বাক্যের মূল স্পিরিট না বুঝে নিজেদের মতো করে এর শাব্দিক অর্থ করে প্রধান বিচারপতির বিষোদ্গারে নেমেছেন।
এটা ঠিক, বিচারক নিয়োগে যে রাজনৈতিক বিবেচনার কথা খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, সেটি অপ্রিয় হলেও সত্য এবং এই সত্য থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। সে জন্য বিচার বিভাগের আক্ষরিক অর্থেই স্বাধীনতা প্রয়োজন। কাগজে-কলমে ‘সেপারেশন’ বা নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা মানেই বিচার বিভাগ স্বাধীন নয়। স্বাধীনতার এত বছর পরও বিচার বিভাগের জন্য একটি আলাদা সচিবালয় পর্যন্ত করা যায়নি। অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি প্রণয়নে সরকার বারবার সময় নিচ্ছে। সবশেষ আইন মন্ত্রণালয় যে খসড়াটি আপিল বিভাগে দিয়েছে, আদালত তা গ্রহণ করেননি।
সদ্য অবসরে যাওয়া আপিল বিভাগের বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার আজীবন সম্মাননা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের সংখ্যা নির্দিষ্ট করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘হাইকোর্টে বিচারকের সংখ্যা নির্দিষ্ট করা নেই। ফলে প্রতিটি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলেই ইচ্ছেমতো হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগ দিয়ে থাকে।’ তিনি বলেন, বিচারকের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া থাকলে রাজনৈতিক প্রভাব কমে যায়। এই রাজনৈতিক প্রভাব যতই কমবে, ততই বিচার বিভাগের জন্য মঙ্গল। অর্থাৎ হাইকোর্টে যে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচারক নিয়োগ করা হয়, সেটি খোদ প্রধান বিচারপতির কথায়ও স্পষ্ট।
শুধু বিচারক নিয়োগই নয়, বিচারকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পায়। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ঘটনাও দেশে নতুন কিছু নয়। ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াতের পছন্দের লোক হিসেবে পরিচিতি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করতে বিচারপতিদের বয়স পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। সুতরাং বিচারপতি নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনা কিংবা বিচারালয়ে রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে আমরা সাধারণ মানুষ যতই উদ্বেগ প্রকাশ করি না কেন, এটিই সত্য এবং বর্তমান প্রধান বিচারপতির সাম্প্রতিক একটি মন্তব্য (পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকেও আদালত সরিয়ে দিয়েছেন) ঘিরে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে এবং ২১ আগস্টের আলোচনায় খোদ প্রধানমন্ত্রীও যেভাবে সিনহার সমালোচনা করেছেন, তাতে জল কোথায় গিয়ে গড়ায়, তা এখনই বলা মুশকিল।
লেখক : সাংবাদিক।